ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অমিয় চক্রবর্তী ॥ দ্বন্দ্বমুখর, অনুভূতির কবি

প্রকাশিত: ২১:৩২, ১১ জুন ২০২১

অমিয় চক্রবর্তী ॥ দ্বন্দ্বমুখর, অনুভূতির কবি

বাংলা কবিতা-সাহিত্যে পঞ্চপাণ্ডব ও তিরিশের কবিদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিশেষ করে, আধুনিক কবিতায় নতুনত্ব আনার ক্ষেত্রে পঞ্চপাণ্ডবের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। রবীন্দ্রবলয় থেকে বেরিয়ে এসে কবিতায় নতুন স্বর সৃষ্টি করেছেন তাঁরা। এ সময়ের অনেক কবিই ইংরেজী-সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা ভাল ছিল; চর্চাও করতেন। ফলে বিদেশী সাহিত্যের প্রভাব রয়েছে তিরিশের কবিদের; পঞ্চপাণ্ডবের। পঞ্চপাণ্ডবের একজন হচ্ছেন- কবি অমিয় চক্রবর্তী। অমিয় চক্রবর্তী (জন্ম : ১০ এপ্রিল, ১৯০১ - মৃত্যু : ১২ জুন, ১৯৮৬) বাংলা সাহিত্যের শীর্ষস্থানীয় আধুনিক কবি। তিরিশের দশক এবং বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দের সঙ্গে কবি অমিয় চক্রবর্তীর নামও আবশ্যিকভাবে চলে আসবে। আজকের আলোচনা তাকে নিয়েই; ফলে তাঁর জনপ্রিয় ও বহুল পঠিত একটি কবিতাংশ দিয়েই শুরু করেছি। পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে দ্বন্দ্বমুখর। তিনি কবিতায় টানাপড়েন বদলে দিয়েছেন। প্রেমের কবিতাতেও ভিন্ন স্বাদ পাওয়া যায়। বৃষ্টির সুরে প্রেমের সুবাস। চকিত অনুভূতিতে রোমান্টিকতা। ধরি, ‘ধক করে লাগে বুকে-/-তুমি-/খুঁজি চারদিকে।/ আমি/ রোদ্দুরে দরজা-খোলা ঘরে।/উঠোন, আকাশ,/ একেবারে/ ধুয়ে মোছা শেষ।’ বস্তুচেতনা ও গতিচেতনা ধরা দিয়েছে অমিয়র কবিতায়। সাধারণ শব্দে অসাধারণ প্রকাশ করতে যথেষ্টই পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন তিনি। ‘নীল কল।/লক্ষ লক্ষ চাজা। মর্চেপড়া শব্দের ভিড়ে/পুরনো ফ্যাক্টরি ঘোরে।/নিযুত মজুরি খাটে পৃথিবীকে/বালি বানায়, গ্রাস করে মাটি, ছেড়ে দেয়, দ্বীপ রাখে,/দ্বীপ ভাঙে; পাহাড়, প্রবালপুঞ্জ, নুনযন্ত্রে ঘর্ঘর ঘোরায় (সমুদ্র)। কবি-সাহিত্যিকরা জীবন-জীবিকাকে এড়িয়ে যেতে পারেন না। জীবন ও সংসারের জটিল হিসাব-নিকাশ কবিতাঁর ছত্রে ছত্রে উঠে আসে কবির কবিতায়। অমিয় চক্রবর্তীও ব্যতিক্রম নয়। প্রেম-ভালোবাসার সঙ্গে ছোটদের জন্য শুভকামনাও রয়েছে। ‘পিঁপড়ে’ কবিতায় এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়। জীবন-জীবিকা বা জটিল হিসাবের কিছু কবিতাংশ তুলেই ধরা যাক- (১) ‘তালিকা প্রস্তুত/কী কী কেড়ে নিতে পারবে না-/হই না নির্বাসিত-কেরানি।/বাস্তুভিটে পৃথিবীটার সাধারণ অস্তিত্ব।/যার একখণ্ড এই ক্ষুদ্র চাকরের আমিত্ব।/যতদিন বাঁচি, ভোরের আকাশে চোখ জাগানো,/হাওয়া উঠলে হাওয়া মুখে লাগানো।/কুয়োর ঠাণ্ডা জল, গানের কান, বইয়ের দৃষ্টি/গ্রীষ্মের দুপুরে বৃষ্টি।/আপনজনকে ভালোবাসা,/বাংলার স্মৃতিদীর্ণ বাড়ি-ফেরার আশা।/তোমায় শোনাই, উপস্থিত ফর্দে আরও আছে-/দূর-সংসারে এলো কাছে/বাঁচবার সার্থকতা...’-(বড় বাবুর কাছে নিবেদন) (২) ‘গেলো/গুরুচরণ কামার, দোকানটা তাঁর মামার,/হাতুড়ি আর হাপর ধারের (জানা ছিল আমার)/দেহটা নিজস্ব।/রাম নাম সত হ্যায়/গৌর বসাকের প’ড়ে রইল ভরন্ত খেত খামার।/রাম নাম সত হ্যায়।।/আমরা কাজে রই নিযুক্ত, কেউ কেরানি কেউ অভুক্ত,/লাঙল চালাই কলম ঠেলি, যখন তখন শুনে ফেলি/রাম নাম সত হ্যায়/শুনবো না আর যখন কানে বাজবে তবু এই এখানে/রাম নাম সত হ্যায়...’-(সাবেকি) (৩) ‘আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে ঘুরুক দেখুক থাকুক/কেমন যেন চেনা লাগে ব্যস্ত মধুর চলা-/স্তব্ধ শুধু চলায় কথা বলা-/আলোয় গন্ধে ছুঁয়ে তাঁর ঐ ভুবন ভ’রে রাখুক,/আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে ধুলোর রেণু মাখুক...’ -(পিঁপড়ে) অমিয় চক্রবর্তীর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৫টি। তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই ‘কবিতাবলী’ (১৯২৪)। অন্যান্য গ্রন্থ : উপহার (১৯২৭), খসড়া (১৯৩৮), এক মুঠো (১৯৩৯), মাটির দেয়াল (১৯৪২), অভিজ্ঞান বসন্ত (১৯৪৩), পারাপার (১৯৫৩), পালাবদল (১৯৫৫), ঘরে ফেরার দিন (১৯৬১), হারানো অর্কিড (১৯৬৬), পুষ্পিত ইমেজ (১৯৬৭), অমরাবতী (১৯৭২), অনিঃশেষ (১৯৭৬), চলো যাই (১৯৬২), সাম্প্রতিক (১৯৬৩) উল্লেখযোগ্য। শিক্ষকতা ও কর্মসূত্রে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন কবি অমিয় চক্রবর্তী। এর প্রভাব তাঁর অনেক কবিতায় দেখা যায়। পর্যটনস্থানকেন্দ্রিক অনেক কবিতা রয়েছে। তাঁর কবিতায় আন্তর্জাতিক বিশ্ব পরিবেশের অনেক ভৌগোলিক স্থানের নাম, বর্ণনা ও চিত্র লক্ষ করার মতো। এই কারণে কবির ভ্রামণিক কবিতার বেশিরভাগই অনন্য হয়েছে। এমন একটি কবিতাংশ তুলে ধরার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। তাঁর ‘ওক্লাহোমা’ কবিতা থেকে- ‘সাক্ষাত সন্ধান পেয়েছ কি ৩-টে ২৫ বিকেলের উইলো বনে রেড এরো ট্রেনের হুইসিল/শব্দ শেষ ছুঁয়ে গাঁথে দূর শূন্যে দ্রুত ধোঁয়া নীল;/মার্কিন ডাঙার বুকে ঝোড়ো অবসান গেল মিশে।/অবসান গেল মিশে।/মাথা নাড়ে ‘জানি’ ‘জানি’ ক্যাথলিক গির্জাচুড়া স্থির,/পুরনো রোদ্দুরে ওড়া কাকের কাকলি পাখা ভিড়;/অন্যমনস্ক মস্ত শহরে হঠাৎ কুয়াশায়/ইস্পাতি রেলের ধারে হুহু শীত-হাওয়া ট’লে যায়...’ ‘কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে।/ফালগুন বিকেলে বৃষ্টি নামে।/শহরের পথে দ্রুত অন্ধকার।/লুটোয় পাথরে জল, হাওয়া তমস্বিনী;/আকাশে বিদ্যুতজ্বলা বর্শা হানে/ ইন্দ্রমেঘ;/ কালো দিন গলির রাস্তায়।/কেঁদেও পাবে না তাকে অজস্র বর্ষার জলধারে...(বৃষ্টি)’। রোমান্টিসিজম ধরা দিয়েছে ধরা দিয়েছে অমিয় চক্রবর্তীর কোন কোন কবিতায়। তিনি বৃষ্টির কবি, বৃষ্টির সুর তাঁর কবিতায়; রাত্রির নিস্তব্ধতাগুলো দারুণ ব্যঞ্জনাময় হয়েছে কবিতার ছত্রে। ‘রাত্রি’’ কবিতায় প্রেম ধরা দিয়েছে এভাবে, অতন্দ্রিলা-য়- ‘অতন্দ্রিলা,/ঘুমোওনি জানি/তাই চুপি চুপি গাঢ় রাত্রে শুয়ে/বলি, শোনো,/সৌরতারা-ছাওয়া এই বিছানায়-/সূক্ষ্মজাল রাত্রির মশারি-/কত দীর্ঘ দুজনার গেল সারাদিন,/আলাদা নিঃশ্বাসে-/এতক্ষণে ছায়া-ছায়া পাশে ছুঁই/কী আশ্চর্য দু-জনে দু-জনা/অতন্দ্রিলা,/হঠাৎ কখন শুভ্র বিছানায় পড়ে জ্যোৎস্না,/দেখি তুমি নেই...’। ‘চাঁপার কলিতে, কবি, ধরো অণুবীক্ষণ যন্ত্র।/খুলে যাবে কোমল দিগন্তে-দিগন্তে/জ্যামিতিক গড়নের অঙ্গন(পুষ্পদৃষ্টি)’, ‘চোখের সৃষ্টিকে দেখি ট্রেনের জানালা দিয়ে/মধ্যাহ্নে আদিম অচেতন/মাটির বিস্তৃতি (চলন্ত)’, ‘মাছ চলে নীল ঢেউ-এ ডাক দিয়ে/কাঁকড়া ছায়ার হাঁটা/রেখার মাঠের সুর, স্বচ্ছতাল।/সময় ঘুমোয় রোদে (কালান্তর)’, ‘চারপয়সার নাগরদোলায় কে দুলিবি আয় (নাগরদোলা)’, ‘ছোটো জলের আয়না,/টুকরো আকাশ লুকিয়ে রাখো/বুকে ঢাকো (পুকুর)’, ‘আশ্চার্য এই পৃথিবী, স্বীকার করি।/-কিছুই চেনা নেই, গেল না জানা-/বলতে বলতে ট্রামে উঠে পড়ি (আশ্চর্য)’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে কাক্সিক্ষত অর্থ প্রকাশে অমিয় চক্রবর্তী যথেষ্ট পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। সাধারণ শব্দ ব্যবহারে যে এমন সব ভালো ভালো কবিতা লেখা যায় তা অমিয় দেখাতে পেরেছেন। উল্লিখিত কবিতাংশ, অলঙ্কার, শব্দবুনন কবির প্রতিনিধি হিসাবে উল্লেখ করলাম। তাঁর বেশিরভাগ কবিতায় এমন। তাঁর কবিতা পড়লে পাথক ঠকবেন না, কবিরা সমৃদ্ধ হতে পারবেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছিলেন ‘অনুভূতির বিচিত্র সূক্ষ্ম রহস্য’, বিশ্বসাহিত্যের স্পর্শ। তাঁর কবিতায় আবেগের সঙ্গে মিশে গেছে মননশীলতা। কবি আল মাহমুদ অমিয় চক্রবর্তী স¤পর্কে বলেছেন, ‘ঋণগ্রস্ত না করে করেছিলেন বিস্মিত ও অভিভূত। তাঁর মিল ও পঙক্তি বিন্যাসের অনভ্যস্ত প্রয়োগ আমার কাছে কিছু দিন অত্যন্ত লোভনীয় মনে হলেও এর দুরূহতা শেষ পর্যন্ত আমাকে নিশ্চেষ্ট না করে ছাড়েনি। এমন কী পয়ারের কারুকাজেও।’ সমালোচক ও কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ অমিয় চক্রবর্তীর অনন্যতা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা একেবারেই অন্যরকম। কোন পোগান বা চিৎকৃত বাক্যের থেকে অনেক দূরে : মননাশ্রিত, এ্যাবস্ট্রাক্ট অথচ মমতার ঘন নিবিড়...।’ বেশি বেশি উপমা ব্যবহার ছাড়াও যে অসাধারণ কবিতা লেখা যায়, তা দেখিয়েছেন চক্রবর্তী। তাঁর কবিতার ছন্দ, শব্দ চয়ন, শব্দ ব্যবহারের কৌশল, পঙ্ক্তি গঠন ইত্যাদি অসাধারণ হয়েছে। সংস্কৃত শব্দগুলোও তাঁর কবিতায় প্রবেশ করেছে সহজে; তবে এসব শব্দচয়নে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর কবিতায় সাধারণ ভাষা; কিন্তু বক্তব্য হালকা হয়ে যায়নি। তাই তো বলা যায়, সাধারণ শব্দ-চয়নে তাঁর কবিতাগুলো অসাধারণ হয়েছে, অনন্য হয়েছে। তাঁর বেশিরভাগ কবিতা এখনও প্রাসঙ্গিক- এখানেই তিনি স্বতন্ত্র।
×