ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুলতানী বাংলায় মধ্যযুগের সাহিত্য

প্রকাশিত: ২১:৩০, ১১ জুন ২০২১

সুলতানী বাংলায় মধ্যযুগের সাহিত্য

মুসলমানগণ বাংলায় বিজয়ীর বেশে আগমন করার পর মনেপ্রাণে ভাল বেসেছিলেন এদেশকে, স্থায়ী আবাস ভূমি হিসেবে গ্রহণ করেন এ দেশকে। এ দেশের অমুসলিম অধিবাসীদের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করতে চেয়েছিলেন। শাসক হিসেবে শাসিতের উপরে কোন অন্যায় আবদার কিংবা অবিচার তাঁরা করেছেন বলে ইতিহাসে পাওয়া যায় না। ফলে জনসাধারণও তাদের শাসন মেনে নিয়েছিল দ্যর্থহীণভাবে। ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি বাংলা বিজয়ের পর আভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। বিজয়ের পরপরই তিনি নিজে ও তাঁর আমীরদের সহযোগিতায় বাংলায় মানুষের জন্য মসজিদ, মাদরাসা ও উপাসনালয় দ্রুত সুন্দরভাবে নির্মাণ করেন। একজন বিজেতা হিসেবে বাংলার অমুসলিমদের প্রতি তিনি উদার নীতি অবলম্বন করেন। যদুনাথ সরকার তাঁর The History of Bengal গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ....But he was not blood-thirsty, and took no delight in massacre or inflicting misery on his subjects. The problems of internal administration and the conciliation of his military chiefs were together solved by the establishment of a sort of feudal government in the country.” মুসলমান শাসকরা যেমন মকতব, মাদ্রাসা ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছিলেন, তেমনি হিন্দু শিক্ষার্থীদের জন্যও শিক্ষার দরজা অবারিত রেখেছিলেন। হিন্দু বালকগণ পাঠশালায় তাদের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করতো। এসব পাঠশালা বিত্তবান ব্যক্তিদের গৃহ-সংলগ্ন থাকত কিংবা গুরুগৃহের নিকটবর্তী কোন এক গাছের নিচে বসত। গুরু একটি টুলের ওপর বসতেন। শিক্ষার্থীরা বসত তাদের নিজ নিজ মাদুরের ওপর। কখনও কখনও মুসলমানদের মক্তব এবং হিন্দুদের পাঠশালা একই ছাদের নিচে বসত। মুসলিম শিক্ষক যিনি মুনশি হিসেবে পরিচিত হতেন তিনি সকালে পড়াতেন এবং হিন্দুদের শিক্ষক গুরু পড়াতেন বিকেলে। বিত্তবান হিন্দুরা পাঠশালার রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্য থেকে জানা যায় যে, চাঁদ সওদাগর বড় ধরনের একটি পাঠশালার ব্যয়ভার বহন করতেন এবং সেখানে তাঁর ছয় পুত্র সোমাই পণ্ডিত নামক এক গুরুর নিকট শিক্ষালাভ করত। হিন্দু বালিকারাও পাঠশালায় পড়াশোনা করতে যেত। ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের ‘বঙ্গসাহিত্য পরিচয়’ সূত্রে জানা যায় যে, ময়নামতি নামক একজন রাজকন্যা তাঁর পিতার গৃহসংলগ্ন পাঠশালায় গুরুর নিকট শিক্ষা লাভ করত। এ ধরনের অনেক তথ্য মধ্যযুগের সাহিত্য থেকে জানা যায়। সুতরাং সহজে অনুমান করা যায় যে, এ সময়ে হিন্দু বালিকারাও পড়াশোনা করত এবং প্রাথমিক পর্যায়ে সহশিক্ষার প্রচলন ছিল। সে সময়ে সাধারণ বালিকারাও যে পড়াশোনা করতো তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায়। ‘সারদামঙ্গল কাব্যে’র উদ্ধৃতি দিয়ে ড. দীনেশ চন্দ্র লিখেন যে, একটি পাঠশালায় হিন্দু রাজার ছেলেমেয়েরা অন্যদের সঙ্গে শিক্ষালাভ করেছিল। এই পাঠশালায় পাঁচ রাজার কন্যাসন্তান অন্যান্য বালক ছাত্রের সঙ্গে অধ্যয়নরত ছিল। এই বর্ণনা থেকে হিন্দু সমাজের দুটি বিষয়ের চিত্র ফুটে উঠে। প্রথমত, স্বতঃস্ফূর্ত নারী শিক্ষা প্রচলন, দ্বিতীয়ত, সহশিক্ষার প্রসার। হিন্দু সমাজের উচ্চ শিক্ষিতা মহিলাদের সম্পর্কেও বহু তথ্য বিভিন্ন উপাদানে উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে রামী, মাধবী, চন্দ্রাবতী, খনা, বিদ্যা, রানী ভবানী প্রমুখ মহিলা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন। বাংলার সুলতানী শাসনামলে কয়েকটি সংস্কৃত শিক্ষার কেন্দ্র খুবই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ কেন্দ্র ছিল নবদ্বীপ। বৃন্দাবন দাস নবদ্বীপের খ্যাতি সম্পর্কে চৈতন্যভাগবতে উল্লেখ করেন যে, নবদ্বীপে বহু টোল ছিল এবং সেখানে ছিলেন হাজার হাজার খ্যাতনামা পণ্ডিত, বিদ্বান ব্যক্তি ও অধ্যাপকবৃন্দ যাঁরা সে সময়ের জ্ঞান ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন। মুহম্মদ এনামুল হক লিখেন যে, হুসেন শাহী আমলে বাংলায় সংস্কৃত চর্চার প্রধানতম কেন্দ্র ছিল নবদ্বীপ। এখানে বড় বড় হিন্দু পণ্ডিতগণ জমায়েত হতেন। এখানে সাধারণত ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের হিন্দুদেরই শিক্ষা দেয়া হতো। এসব টোলে সংস্কৃতের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ও ফারসী শিক্ষা দেয়া হতো। এখানে ইতিহাস, কালিদাসের গ্রন্থাবলি, চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থ মধুকোষ, অমর কোষ, ব্যাকরণ বা ধর্মগ্রন্থ রামায়ণ ও মহাভারত, ব্যবসার হিসাব-নিকাশ, রাজস্বের হিসাব ইত্যাদি পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। সংস্কৃত শিক্ষার প্রসিদ্ধ কেন্দ্র হিসেবে নবদ্বীপের এ গৌরবময় ঐতিহ্য সারা মুসলিম আমলেই টিকে ছিল। কবি বিজয়গুপ্তের জন্মস্থান ফুল্লশ্রী গ্রাম (বরিশাল জেলায়) ষোলো শতক থেকে হিন্দু শিক্ষার একটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র ছিল। বিজয়গুপ্তের লিখিত ‘পদ্মপুরাণ’ কাব্যে দেখা যায় যে, ফুল্লশ্রী গ্রামের ব্রাহ্মণগণ বেদ সম্পর্কিত জ্ঞানে পারদর্শী এবং বৈদ্যগণ চিকিৎসা শাস্ত্রের পেশায় দক্ষ ছিলেন। সে স্থানের কায়স্থরা অভিজ্ঞ লেখক এবং অন্য লোকেরা তাদের নিজ নিজ পেশায় নিপুণ ছিলেন। বর্ধমান সংস্কৃত শিক্ষার একটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র ছিল। নোয়াখালীর যুগদিয়াও ছিল সে যুগের হিন্দু শিক্ষার আরও একটি কেন্দ্র। এ ছাড়া, সিলেট, চট্টগ্রাম এবং বিষ্ণুপুরেও (বাকুড়া জেলা) হিন্দু শিক্ষার আরও কয়েকটি কেন্দ্র ছিল। এই সময়ে বেশ কিছু সংখ্যক সংস্কৃত পুস্তক রচিত হয়েছিল। সুলতানী শাসনামলে সুলতানগণ সংস্কৃত শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। জানা যায় যে, সে সময়ে কিছু সংখ্যক মুসলিম সংস্কৃত শিক্ষা করেছিলেন। শুধু তাই না তাঁরা সংস্কৃত ভাষায় গ্রন্থও রচনা করেন। এভাবে সুলতানী আমলের বাংলায় ধর্মীয় উদার নীতির ফলে সংস্কৃত শিক্ষার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়। এভাবে মুসলিম শাসকগণ হিন্দুদের শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক অবদান রেখেছিলেন। বাংলায় হিন্দুদের যে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা হতো তাঁর ব্যয় নির্বাহ হতো সাধারণত রাষ্ট্র অথবা জমিদার ও অবস্থাপন্ন লোকদের প্রদত্ত ভূমির আয় থেকে। শিক্ষার্থীদের কোন রকম বেতন প্রদান করতে হতো না। তবে, টোলে তাদের শিক্ষাজীবন শেষ হলে তাঁরা গুরুকে দান-দক্ষিণা উপহার দিত। বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্য থেকে জানা যায় যে, চাঁদ সওদাগর বড় ধরনের একটি পাঠশালার ব্যয়ভার বহন করতেন এবং সেখানে তাঁর ছয় পুত্র সোমাই পণ্ডিত নামক এক গুরুর নিকট শিক্ষালাভ করত। ত্রয়োদশ শতকে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুলতানদের সুশাসন এবং বিদেশাগত সুফি-সাধক কর্তৃক ইসলাম ধর্ম প্রচারের ফলে শুরু থেকে বাংলা হিন্দু-মুসলিম সুসম্পর্ক স্থাপিত হতে শুরু করে। মুসলমান শাসকদের এমন উপলব্ধি ছিল যে, তাঁরা শাসক সম্প্রদায় হিসেবে সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলিম এবং প্রজাসাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু। সুতরাং বাংলায় মুসলিম শাসন দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে প্রথমেই হিন্দুদের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা অতি জরুরী। এরূপ উপলব্ধি সুলতানগণ মনেপ্রাণে করেছিলেন। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের সহযোগিতা কামনা, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম সুসম্পর্ক রক্ষা এবং ইসলাম নির্দেশিত প্রজাসাধারণের কল্যাণ কামণায় উদ্বুদ্ধ হয়েই সুলতানগণ হিন্দুদের সঙ্গে সহৃদয় আচরণ অবলম্বন করে। সুলতানগণ হিন্দুদের উচ্চ রাজপদে নিয়োগ, স্বাধীনভাবে ধর্মপালন, শিক্ষাক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতাসহ সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেছে। বাংলায় মুসলিম আধিপত্য বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে সুলতানগণ উচ্চশিক্ষিত স্থানীয় হিন্দুদের শাসনকার্যে সম্পৃক্ত করে। মুসলমান সুলতানদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বহু হিন্দু শাসক, সেনাপতি মুসলিম শাসনে নিযুক্ত হয়ে বিশ্বস্ততার পরিচয় দেয়। মুসলমান সুলতানগণ প্রতিভাবান ও শিক্ষিত হিন্দুদেরকে গুরুত্বপূর্ণ পদ, রাষ্ট্রীয় উপাধী, এবং সরকারী জমি দান করেন। তাঁরা বিশ্বস্ততার সঙ্গে মুসলিম সুলতানদের সহযোগিতা করে। বাংলার ইলিয়াশ শাহ দিল্লীর সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের বিরুদ্ধে যখন বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে লিপ্ত তখন বাংলায় হিন্দু সামন্ত, সেনাপতি সহদেবসহ সাধারণ সৈনিকগণও অস্ত্রধারণ করেছিল। হিন্দু সেনাপতি সহদেব এই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন। ইলিয়াস শাহ যুদ্ধ শেষে এসব হিন্দু যোদ্ধাদের পুরস্কৃত করেছিলেন। মুসলিম শাসকগণ রাজ দরবারে হিন্দু পণ্ডিত ও কবিদের আহ্বান করে তাদের সঙ্গে হিন্দু শাস্ত্র সম্পর্কে আলোচনা করতেন। হিন্দুদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে গভীর আগ্রহ উপলব্ধি করে তাঁর তাদের মাধ্যমে রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত ও অন্যান্য সংস্কৃত গ্রন্থ বাংলা অনুবাদ করান। সংস্কৃত ভাষার মরমীবাদ গ্রন্থটিও আরবি ও ফারসী ভাষায় অনূদিত হয়। হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থসমূহে মুসলমানদের এ ধরনের আগ্রহের পশ্চাতে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে উন্নততর সামাজিক সমঝোতা সৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। সুলতানী শাসকগণ হিন্দুদের ধর্মীয় ব্যাপারে কোনরূপ হস্তক্ষেপ না করার নীতি অনূসৃত হয়। ফলে হিন্দুগণ ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি উদযাপনে, শিক্ষায় ও ধর্মপ্রচারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতেন। আলাউদ্দীন হোসেন শাহ হিন্দু সংস্কারবাদী বিপ্লবী শ্রী চৈতণ্যের বিপ্লবী মতবাদ প্রচারে কোন ধরনের বাধা প্রদান না করে সহযোগিতা করার জন্য তাঁর প্রশাসনকে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। সামাজিকভাবেও মুসলমানরা হিন্দু প্রতিবেশীদের প্রতি অত্যন্ত সহনশীল ছিল। একবার হিন্দু সম্প্রদায়ের দুই গ্রুপের মধ্যে এক সমস্যা ও সংঘর্ষের বিচার করতে গিয়ে কাজী সাহেব এক গ্রুপের পক্ষে রায় প্রদান করলে অপর গ্রুপ ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর বাড়ি পুড়িয়ে ফেলে। কাজী সাহেব চাইলে এর উপযুক্ত প্রতিশোধ নিতে পারতেন কিন্তু তিনি আপোষমুলক নিষ্পত্তির অভিপ্রায়ে দোষী হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধানের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে ভাগ্নে সম্বোধন করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। চৈতন্যচরিতামৃত কাব্যে সেই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। কবি কাজী সাহেবের কথাগুলোকে কাব্যাকারে উল্লেখ করেন, গ্রাম সম্বন্ধে চক্রবর্তী হয় মোর চাচা দেহ সম্বন্ধে হৈতে হয় গ্রাম সম্বন্ধ সাঁচা নীলাম্বর চক্রবর্তী হয় তোমার নানা সে সম্বন্ধে হও তুমি আমার ভাগিনা। [ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রাচীন যুগ, পৃ: ৩২৫] এই ঘটনা থেকে ধারণা হয় যে, মুসলমানগণ তাদের হিন্দু প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভ্রাতা-ভগ্নি, ভাগ্নে ইত্যাদি স্নেহ-প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন করতেন। দীর্ঘ সুলতানী আমলের দুই একটি ঘটনা ছাড়া হিন্দুরা মুসলমানদের বন্ধুসুলভ মনোভাবের প্রতি সম্মান দেখিয়েছে। বাংলার সাধারণ স্বার্থ রক্ষায় তাঁদের জমিদার, শাসক ও অন্যান্যরা মুসলমানদের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছেন। মুসলমান সুলতানগণ যেমন তাঁদের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানে ও কার্যে হিন্দুদের নিয়োগ দিতেন, হিন্দু জমিদাররাও তাঁদের বিভিন্ন কার্যে মুসলমান কর্মচারী নিয়োগ করতেন। তাঁরা মুসলমান রাজদরবারের শিষ্টাচার ও আনুষ্ঠানিকতায় মুগ্ধ হয়ে সেগুলো নিজেদের দরবারে অনুসরণ করতেন। সুলতানী শাসনকালে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। হিন্দুরা তাঁদের বিভিন্ন সামাজিক ও পারিবারিক উৎসবাদিতে মুসলমানদের নিমন্ত্রণ করত, মুসলমানরাও তাঁদের এই সমস্ত আনন্দ উৎসবে যোগ দিত। কবি বিজয়গুপ্ত বলেন, চাঁদ সওদাগরের পুত্র লক্ষ্মীন্দরের বিয়েতে নয় শ মুসলমান গায়ক যোগদান করেছিলেন। [বিজয়গুপ্ত, মনসামঙ্গল, পৃ. ১৭৯] মুসলমানগণও তাঁদের সামাজিক উৎসবাদিতে হিন্দুদের আমন্ত্রণ জানাতেন। এভাবে সামাজিক লেনদেন ও চিন্তাধারার আদান-প্রদানের ফলে হিন্দু ও মুসলমানরা একে অন্যের সম্বন্ধে ভালভাবে জানতে পারে। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থের প্রতি মুসলমানদের অনুরাগ স্বভাবতই মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থের প্রতি শিক্ষিত হিন্দুদের ভক্তি জাগরিত করেছিল। একে অন্যের সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহের ফলে বাংলার দুই প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পথ প্রশস্ত হয়। মুসলিম পীর দরবেশ অলী আওলিয়ার প্রতি হিন্দুদের যথেষ্ট শ্রদ্ধা ছিল। সে সময়ের অনেক ব্রাহ্মণ ব্যবসা-বাণিজ্য শুরুর শুভক্ষণে ও পুত্র সন্তান কামনায় আল্লাহর নাম নেয়ার পরামর্শ দিতেন। মুসলমানদের পীর দরবেশদের দরগাহসমূহের শিরনি বা উপঢৌকন প্রদান হিন্দুদের মধ্যেও সমানভাবে প্রচলিত ছিল। পীর দরবেশকে তাঁরা গভীর শ্রদ্ধা ও প্রীতির চোখে দেখতেন, তাঁদের আশীর্বাদ কামনা করতেন। যুগ যুগ ধরে শেখ জালালউদ্দীন তাবরিজীর প্রতি হিন্দুদের ভক্তি, শ্রদ্ধা প্রদর্শন শেখ শুভোদয়া গ্রন্থে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁরা কবিতার প্রারম্ভে মুসলমান পীর দরবেশদের প্রস্বস্তি লিখে শুরু করতেন। বাংলাদেশে মুসলমান রাজত্বকালে সামাজিক মেলামেশা এবং সাধারণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে সে সময়ের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বমুলক সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যে দেখা যায় যে, দুটো সম্প্রদায়ের সম্প্রীতিমুলক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কখনও কখনও শত্রুতামুলক ঘটনা দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু এগুলো দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্যবিধ সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টি করতে পারেনি। মনসামঙ্গল কাব্য পাঠে জানা যায় যে, ষোড়শ শতকে সর্পদেবতা মনসার পূজার সময় হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে কিছুটা গোলযোগ দেখা দেয়। কিন্তু মুসলিম শাসকদের দূরদর্শিতার ফলে এ গোলযোগ অতি সত্তর নিষ্পত্তি হয়ে যায় এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অক্ষুণ্ন থাকে। মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় জীবনে ভেদাভেদ থাকলেও বিরোধ ছিল না। এর প্রমাণ পাওয়া যায় মুসলমানদের আল্লাহ রাসূল এবং প্রধান ধর্মগ্রন্থ আল কুরআনের প্রতি হিন্দু সমাজ মানসের সুগভীর শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে। কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসা মঙ্গল কাব্যের নায়ক শৈব সাধক ভাগ্য বিড়ম্বিত চাঁদ সওদাগর পুত্র লক্ষ্মীন্দরকে সর্পদেবী মনসার আক্রোশ থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে এ কারণেই লক্ষ্মীন্দরকে লৌহ বাসরে অন্যান্য হিন্দুস্থানী রক্ষাকবচের সঙ্গে একখানা কোরআন শরীফও রাখা হয়েছিল।[দীনেশচন্দ্র সেন, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, পৃ:৩১৯০]। অপুত্রক লক্ষপতি সওদাগর তাঁর অপুত্রক হওয়ার কারণ জানতে ব্রাহ্মণদের ডাকলে তাঁরা আল কুরআন দেখে অঙ্কপাত করেন। অনুরূপ লক্ষপতি সওদাগরের পুত্র বাণিজ্য যাত্রাকালে হিন্দু দেবদেবীকে স্মরণ করার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকেও স্মরণ করেছেন। [Azizur Rahman Mallick, British Pokicy and the Muslims in Bengal, (Dhaka, 1965), p. 9]. সামাজিক জীবনের এই প্রভাব হয়ত সর্বব্যাপী ছিল না, তবে মুসলিম সমাজের ধর্মকর্মের প্রতি কিছু কিছু হিন্দুর যে উদার মনোভাব ছিল এ কথা অস্বীকার করা যায় না। সমকালীন হিন্দু কবিদের কেউ কেউ হিন্দু মুসলিম চরিত্র চিত্রায়নে অনেক সময় সাম্প্রদায়িকতার প্রাচীর অতিক্রমে ব্যর্থ হয়েছিলেন। মুসলমান শাসক ও ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন নিয়মনীতি, এমনকি নবী রাসূল এবং মুহম্মদের (স.) দৌহিত্র হাসান হোসেনকে আক্রমণ করতেও তাঁরা ছাড়েননি। জবাবে মুসলমান কবিরা অনেক সময় তাদের মনোভাবের জবাব তাঁদের রচনার মাধ্যমেই ব্যক্ত করেছেন। এই সমস্ত বিরোধ সমাজকে তেমনভাবে আলোড়িত করেনি, বরং সমাজের মানুষকে ধর্মসচেতন জাতিতে পরিণত করেছিল। চৈতন্য মঙ্গলের কবি জয়ানন্দ এই সমস্ত বিষয় লক্ষ্য করে লিখেছিলেন, ‘ব্রাহ্মণে-যবনে বাদ যুগে যুগে আছে।’ [জয়ানন্দ, চৈতন্যমঙ্গল, (নগেন্দ্রনাথ বসু ও কালিদাস নাগ সম্পাদিত) (কলিকাতা : বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, ১৩১২ সন), পৃ.১১।] দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর বঙ্গভাষা ও সাহিত্য পুস্তকে বাংলায় মুসলমানদের আগমনের পরে এখানকার হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন, ‘মুসলমানগণ ইরান, তুরান প্রভৃতি যে স্থান হইতেই আসুন না কেন, এ দেশে আসিয়া সম্পূর্ণরূপে বাঙালী হইয়া পড়িলেন। তাঁহারা হিন্দু প্রজামণ্ডলী পরিবৃত হইয়া বাস করিতে লাগিলেন। মসজিদের পার্শ্বে দেব মন্দিরের ঘণ্টা বাজিতে লাগিল; মহরম, ঈদ, সবেবরাত প্রভৃতির পার্শ্বে দুর্গোৎসব, রাস, দোলোৎসব প্রভৃতি চলিতে লাগিল। রামায়ণ ও মহাভারতের অপূর্ব প্রভাব মুসলমান সম্রাটগণ লক্ষ্য করিলেন। এদিকে দীর্ঘকাল এ দেশে বাসকরার ফলে বাঙ্গালা তাহাদের একরূপ মাতৃভাষা হইয়া পড়িল। হিন্দুদিগের ধর্ম, আচার, ব্যবহার প্রভৃতি জানিবার জন্য তাহাদের পরম কৌতূহল হইল। ...গৌড়ের সম্রাটগণের প্রবর্তনায় হিন্দু শাস্ত্র গ্রন্থের অনুবাদ আরম্ভ হইল। গৌড়েশ্বর নসরত শাহ মহাভারতের একখানি অনুবাদ সংকলন করাইয়াছিলেন। সেই মহাভারতখানি এখনও প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই, কিন্তু পরাগল খাঁর আদেশে অনূদিত পরবর্তী মহাভারতে তাহার উল্লেখ দৃষ্ট হয়। কবি বিদ্যাপতি ও নাসির শাহ এবং গৌড়েশ্বর প্রভু গিয়াস উদ্দীন সুলতানের প্রশংসা করেন। গৌড় বা লাখনৌতিকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজের বিকাশ শুরু হয় বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের মাধ্যমে। সমগ্র বাংলাদেশে মুসলিম শাসন স্থাপিত হয় ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহী বংশের উত্থানের মধ্য দিয়ে। সুতরাং বখতিয়ারের বিজয় থেকে শামসুদ্দীন ইলিয়াশ শাহের উত্থানকালকে মুসলিম সমাজ গঠনের প্রস্তুতিপর্ব বলা চলে। মুসলমান সমাজের সঙ্গে উপাসনাগৃহ মসজিদের সম্পর্ক ছিল আঙ্গাআঙ্গিভাবে জড়িত। যেখানেই মুসলমান বসতি গড়ে উঠত, সেখানেই ধর্মীয় প্রয়োজনে গড়ে তোলা হতো মসজিদ, মাদ্রাসা ও দরগাহ। সমাজের সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের কল্যাণে মুসলমান সুলতান এবং তাদের কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে কূপ, জলাধার, পুকুর খনন অথবা সেতু নির্মাণ ইত্যাদি জনহিতকর কাজ করা হতো। মুসলিম দেশের জনগণ হিসেবে হিন্দুরাও এ জনহিতকর কাজের সুবিধা পেয়েছিল। এ প্রেক্ষিতে মুসলিম সুলতানদের সঙ্গে হিন্দু জনসাধারণের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কথা বিবেচনা করা যায়। এ কথাও উপলব্ধির বিষয় যে, বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানরা ছড়ি হাতে শাসনকার্য শুরু করে দিতে পারেনি এবং তা তাঁরা চায়ওনি। বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হিসেবে সুলতানদের প্রথমত হিন্দু জনগোষ্ঠীর আস্থা ও সন্তুষ্টি অর্জন করতে হয়েছিল। নিজেদের শাসনকার্যে দক্ষতা প্রদর্শন, সকল কার্যে সমভাবে সকলের সন্তুষ্টি অর্জন সর্বোপরি অধিকার, সম্মানহারা অবহেলিত হিন্দু জনগোষ্ঠীকে সম্মান প্রদানের মাধ্যমে মুসলমান শাসকগণ নিজ ধর্মে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল। এক্ষেত্রে এ কথা বলা যায়, বাংলায় তলোয়ারের মাধ্যমে নয়, আদর্শের মাধ্যমেই মুসলমানরা সংখ্যায় ধীরে ধীরে গরিষ্ঠতা অর্জন করতে থাকে। লাখনৌতিতে মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দুশো বছরের মধ্যে সমগ্র বাংলার উপর মুসলমান সুলতানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলায় মুসলমান সমাজ সম্প্রসারণের প্রধান কারণ ছিল বহুসংখ্যক হিন্দুর ইসলাম গ্রহণ। এর ফলে মুসলমান সমাজ গ্রাম অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহ প্রভৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সমাজের হিন্দুদের সঙ্গে বাংলায় আগত মুসলমান জনগোষ্ঠীর পারস্পরিক লেনদেনের মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতির গ্রহণ ও বর্জন সাধিত হয়েছে এ কথা বলাবাহুল্য। মুসলমান সুলতানগণ বাংলার শাসনকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে হিন্দুদের পূর্বের কিছু কিছু নিয়ম, রীতি-নীতি পরিবর্তন করতে চাননি। এই সমস্ত বিষয়ের উপর উদার নীতি অবলম্বন করেছিলেন। যেমন, বখতিয়ার খলজির প্রাপ্ত মুদ্রায় একজন অশ্বারোহীর চিত্র খোদিত আছে। বাংলার আরও ক’জন মুসলিম শাসনকর্তার মুদ্রায় অনুরূপ অশ্বারোহীর চিত্র সংযোজিত দেখা যায়। জালাল উদ্দীন ফতেহ শাহের একটি রৌপ্য মুদ্রায় সাতরশ্মি সংযুক্ত সূর্যেও প্রতীক উৎকীর্ণ রয়েছে। এ দেশের জীবন ধারায় হিন্দু ধর্ম ও সমাজে মূর্তি পূজা ও মূর্তি তৈরি, অঙ্কন এবং সংরক্ষণ একটি আবশ্যকীয় ধর্মীয় কাজ। আবার সূর্যের প্রতীকের সঙ্গে সূর্য পূজার সম্পর্কও জড়িত রয়েছে। মুসলিম মুদ্রায় তাই লক্ষী দেবীর মূর্তি, নাগরী লিপি বিন্যাস, অশ্বারোহীর মূর্তি অঙ্কন এবং সূর্যের প্রতিকৃতি খোদাই বিশেষ তাৎপর্যের দাবি রাখে। বাংলার সুলতানদের মধ্যে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার চেয়ে স্থানীয় সংস্কৃতির প্রাধান্য ছিল বেশি। ফলে ধর্মীয় বিধি নিষেধকে উপেক্ষা করে সহজেই তাঁরা তাদের মুদ্রায় অশ্বারোহী অথবা সূর্যের প্রতিকৃতি খোদাই করতে পেরেছেন। এ থেকে মুসলিম সুলতানদের দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মীয় রক্ষণশীলতার চেয়ে উভয় ধর্মের মধ্যে সাদৃশ্যকরণের দিকে যে ঝুঁকেছিল তাঁরই ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
×