ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

নিয়তির পরিহাস

প্রকাশিত: ২১:১৮, ১১ জুন ২০২১

নিয়তির পরিহাস

ভর দুপুরে বিজয়সরণির ফাইটার শোভিত গোল চত্বরটি থেকে ডানে মোড় নিতে গিয়েই বিপত্তি। মাঝারি সাইজের একটা জটলা, মূলত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র সংলগ্ন চন্দ্রিমা উদ্যানের অংশটিতে। ওই জটলারই কেউ-কেউ অবস্থান নিয়েছেন রোকেয়া সরণির ওপরে। আর তাই করোনার কঠোর বিধি-নিষেধের মধ্যেও গ্রীষ্মের রোদজ্বালা দুপুরে মোড়টাকে কেন্দ্র করে ছোটখাটো, কিন্তু অপ্রত্যাশিত একটা ট্রাফিক জ্যাম। প্রথমে পিকনিক-পিকনিক ভাবটা দেখে জ্যামের কারণটা ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারছিলাম না। মোবাইলের স্ক্রিনে তারিখটা চোখে পরতেই অবশ্য বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল। তারিখটা ৩০ মে, ১৯৮১-এর এই দিনেই চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে একটি সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন সাবেক রাষ্ট্রপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জিয়াউর রহমান। তারিখটা মনে পড়তেই কেন যেন মাথায় খেলে গেল কিছু এলোমেলো চিন্তার শৃঙ্খল। গ্রীস্মের প্রচণ্ড রোদে সম্ভবত সহসা দার্শনিকতায় পেয়ে বসা টাইপ কিছু একটা। আমাদের জীবনটা তো আসলে ভীষণ সংক্ষিপ্ত। অথচ আমরা কেন যেন এই একটি বিষয়ই ভুলে যাই, জেনেও না জানার ভান করি। ১৯৭৭ সালের এই দিনটিতেই জিয়াউর রহমান একটি প্রহসনের ‘হ্যাঁ-না’ গণভোটের মাধ্যমে তার অবৈধ ক্ষমতায় জনগণের বৈধতার সিল-ছাপ্পর এটে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আর তারও দুটি বছর আগে তার প্রশ্রয়ে আর ছত্রছায়ায় একদল সামরিক অফিসারের হাতে সপরিবারে শাহাদাতবরণ করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাবছিলাম, যার কবরটিকে ঘিরে এই মাতামাতি, তিনি যদি সত্যিই সেখানে শায়িত থাকেন, মাত্র ছয় বছরের মাথায় ৮১-তে এসে তাকে এহেন করুণ পরিণতি বরণ করতে হবে জানলে তিনি সেদিন ওই খুনীগুলোকে এতটা তো দূরে থাক, আদৌ কোন প্রশ্রয় দিতেন কিনা? ‘না’ বাক্স শিকায় তুলে, শুধু ‘হ্যাঁ’ বাক্সের যে জননিন্দিত গণভোটটি দিয়ে জিয়া ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার প্রক্রিয়াটি শুরু করেছিলেন, তার মাত্র এক বছরের মাথায় ১৯৭৮-এর ৩ জুন বাংলাদেশ দেখেছিল নির্বাচনী প্রহসনের আরেক দফা মহড়া। এদিন ধানের শীষ প্রতীকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘সার্ভিং’ কমান্ডার ইন চীফ এবং দেশের ‘অবৈধ’ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়া। নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারী হেলিকপ্টার থেকে শুরু করে সরকারী প্রশাসন এমনকি সেনাবাহিনীকেও যে ব্যবহার করা যায়, তার এক ন্যক্কারজনক উদাহরণ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে এই নির্বাচনটির মাধ্যমে আকিকা হয় আমাদের রাজনীতিতে ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ নামের অগণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রহসনের। এই নির্বাচনে জিয়ার সমর্থকদের হাতে নিহত হন বিরোধী দলের ৪০ জন সমর্থক আর পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া হয় কমপক্ষে ২০০টি সেন্টার থেকে। এমনি সব খবর নির্বাচনটির পরদিন ছাপা হয়েছিল নিউইয়র্ক টাইমসে। আর নির্বাচনটির ক’মাস আগে লন্ডনের ‘দি গার্ডিয়ান’ জানায়, দেশের কারাগারগুলোয় প্রায় ৪০ হাজার রাজবন্দীকে জায়গা দিতে গিয়ে অপরাধীদের জন্য জায়গা সঙ্কট দেখা গিয়েছে। এই নির্বাচনটির ক’মাসের মধ্যেই সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ ক্ষমতায় থেকে জিয়াউর রহমান জন্ম দেন তার প্রিয় রাজনৈতিক সংগঠন বিএনপির আর সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পর ব্যাকডেটে নিজেকে প্রমোশন দেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে। ঘটনাগুলো মনে পড়ছিল আর ভাবছিলাম জাতীয় সংসদের ছায়ায় তিনি যদি আজ সত্যি সত্যিই এই সুরম্য সমাধিটিতে শুয়ে থাকেন, কেমন লাগছে আজ তার হাতে গড়া এই সংগঠনটির পিকনিক পার্টিসুলভ এই দৌড়ঝাঁপ? জেনারেল জিয়ার শাসনকালে বিনা বিচারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আর ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলিতে উড়িয়ে খুন করা হয়েছে হাজার-হাজার দেশপ্রেমিক সেনা ও বিমানসেনা ও কর্মকর্তাকে। তাদের অনেকের পরিবার আজও জানেন না কবে কোথায় কার্যকর করা হয়েছিল তাদের প্রিয়জনদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ? কিংবা কোথায়ই বা তাদের সমাধিস্থ করা হয়েছে? যদি সত্যি সত্যি জিয়া এখানে শুয়ে থাকেন, তাহলে হয়ত শুয়ে শুয়েই ভাবছেন নিয়তির কি নির্মমই পরিহাস! তিনি সত্যিই এখানে শায়িত কিনা তা নিয়েও সন্দিহান দেশের মানুষ। জ্যামটি ছেড়ে দিতে গাড়ি যখন আবার চলতে শুরু করেছে, আমিও ফিরে আসি বাস্তবতার জায়গাটায়। কিন্তু দার্শনিকতার রেশটুকু কেন যেন রয়ে যায়। জীবনের এই ক্ষণস্থায়ীত্বটুকু একটু মাথায় রেখে চললেই তো আমাদের একেকটি জীবন কত শত জীবনকে জীবনময় করে তুলতে পারে। মরহুম জিয়া সেটা বোঝেননি। আমাদের যাদের এখনও বোঝার সময় ও সুযোগ আছে, তারাও সবাই কি বুঝছি? লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় ও সদস্য সচিব,সম্প্রীতি বাংলাদেশ
×