ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ চাই আবাসযোগ্য সবুজ পৃথিবী

প্রকাশিত: ২১:১৫, ১১ জুন ২০২১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ চাই আবাসযোগ্য সবুজ পৃথিবী

উত্তপ্ত ভূমণ্ডল শঙ্কিত জীবন- এ কথাটি আজ পৃথিবীর সর্বত্রই জোরেসোরে আলোচিত। গ্রীন হাউস এফেক্টের ভয়াবহতা বিশ্বমানবতাকে ভবিষ্যত নিয়ে ভাবিয়ে তুলছে। তবে বলতে হয়, কিছুটা দেরিতেই এ বোধোদয় হয়েছে মানুষের। রোগীর দেহে যখন ভাইরাস ব্যাধি অতিরিক্ত মাত্রায় ছড়িয়ে যায়, তখন ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হলে যেমন তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সম্ভব হয় না, মানব বসতি এবং পরিবেশ অতিরিক্ত মাত্রায় দূষণ কবলিত হওয়ার পর হঠাৎ করে দূষণ মুক্ত বিশ্ব গঠন প্রচেষ্টাও অনেকটা সে রকমই। ইসলাম ধর্ম প্রকৃতিবান্ধব। ইসলামের মহান নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিভিন্নভাবে পরিবেশকে আবাসযোগ্য রাখার জন্য জোর তাগিদ দিয়ে গেছেন। পরিবেশ দূষণজনিত কারণে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ১০টি মারাত্মক ব্যাধির কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশভিত্তিক এক সমীক্ষায় কয়েকজন পরিবেশ বিজ্ঞানী জানিয়েছেন, সার, কীটনাশক ও কলকারখানায় বর্জ্য পদার্থ এদেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। ব্যাপক আকারে মাছের মড়ক এবং বিভিন্ন রোগ ব্যাধি এরই আলামত। আবার বাংলাদেশ এখন কীটনাশকের রমরমা বাজার। বাংলাদেশের কীটনাশক কোম্পানিগুলো কৃষকদের আকৃষ্ট করার জন্য কীটনাশক সম্পর্কে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। কোন কোন কোম্পানি কীটনাশক বিক্রির ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনে এমন ধারণা দেয় যে, এই কীটনাশক বাংলাদেশকে ধান দিয়ে ঢেকে দিতে পারে। তাছাড়া কীটনাশকের অসর্তক ব্যবহারে নানা ধরনের কীটপতঙ্গ নষ্ট হচ্ছে। এতে শুধু যে ক্ষতিকর পোকা-মাকড়ই ধ্বংস হচ্ছে তা নয়। বিষের ছোঁয়ায় মারা যাচ্ছে বহু উপকারী পোকাও যারা শস্যের ক্ষেতে ফুলের ও ফলের বিস্তৃতি ঘটাতে সাহায্য করে। এ ছাড়াও বিষের বিষাক্ত ছোবলে খাল-বিল-নদী মাছশূন্য হচ্ছে। পবিত্র ইসলাম ধর্মসহ সকল মানবিক সংস্থা প্রকৃতির সঙ্গে মিতালি করে বসবাসের দিকনির্দেশনা দিয়েছে। আল্লাহ পাক উদ্ভিদ, তৃণলতা, গাছপালাকে মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এগুলো আল্লাহর বড় নেয়ামত ও অনুকম্পা। বন জঙ্গল হলো মানুষের অক্সিজেন গ্রহণের মাধ্যম। সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন- মা’ মিন মুসলিমিন ইয়াগরিসু গারসান আও ইয়াযরাও যারআন ফাআকালা মিনহু তয়রুন আও ইনসান আও বাহিমা ইল্লা কানা লাহু সাদাকা...।’ অর্থাৎ কোন মুসলমান একটি গাছ রোপণ করেছে এই গাছ রোপণ করার পর সেখানে ফল ধরেছে। সে ফল কোন মানুষ বা কোন প্রাণী খেয়েছে। যে কয়টা ফল গাছে ধরবে মানুষ বা পাখি কিংবা প্রাণী তা ভক্ষণ করবে, সব কিছুই সদকার সওয়াব হিসেবে তার আমলনামায় সংরক্ষিত হবে।’ (সুবহানাল্লাহ)! গাছ রোপণের পর গাছ বড় হবে, মানুষকে ছায়া দেবে, সে ছায়ায় ক্লান্ত পথিক এসে বিশ্রাম নেবে, সে যতক্ষণ মনকে তৃপ্ত করবে তার বিনিময়ে আল্লাহ পাক আমার আমল নামাতে সদকার সওয়াব লিখে দেবেন। যদি আমার আম গাছের পাশ দিয়ে একজন ক্লান্ত পথিক যাওয়ার সময় একটি আম খায় আর তাতে তার মনে তৃপ্তি আসে তবে একজন মুসলমানকে আনন্দ দেয়ার কারণে আমি সওয়াব পাব । একটি আম সদকা করার জন্যও আমি সওয়াব পাব। একটি পাখি গাছে বসে ফল খেয়েছে। তাছাড়া ফলের গাছ থেকে পশু-পাখির খাদ্যও জুটে। রাসূল (সা.) গাছ রোপণের ব্যাপারে এত বেশি উৎসাহিত করেছেন যে, কোন মুসলমান জীবনে বৃক্ষরোপণের কাজ হতে বিরত থাকতে পারে না। হাদিসে আছে, একজন মুসলমান হাতে একটি চারা পেল, এই সময়ে সে দেখল যে, ইসরাফিল (আ.) সিঙ্গায় ফু দেবে বা কেয়ামত কায়েম হবে, একটু পরেই পৃথিবী ধ্বংস হবে, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন- কিয়ামত হয়ে যাবে বা তুমি মারা যাবে, তোমার জীবনের শেষ মুহূর্ত! খবরদার সে চারাকে তুমি ফেলে দেবে না বরং তোমার মৃত্যুর আগে আগে সে চারাকে তুমি রোপণ কর।’ গাছ রোপণ করে চলে গেলেই দায়িত্ব শেষ হয় না। রোপণের পার এর পরিচর্যা করতে হয়। পৃথিবীর কোন খাস জমিকে অনাবাদী রাখা যাবে না। মহানবী (সা.)-এর যুগে মদীনার অনেক জায়গা ছিল অনাবাদী, কোন চাষ করা যেত না। মহানবী (সা.) ঘোষণা করলেন--‘যে ব্যক্তি কোন মৃত, অনাবাদী জমিনকে চাষাবাদ করবে, সে জমির মালিক সে নিজেই হয়ে যাবে।’ ইসলামের সোনালী যুগে মুসলিম বিজেতাদের একের পর এক দেশ জয় করার ইতিহাস রয়েছে। সেখানে দেখা যায় সেনাপ্রধানরা বার বার সৈনিকদের নির্দেশ দিতেন তারা যেন যাত্রাপথে কোন মানুষের গাছপালা নষ্ট না করে, শস্যক্ষেত বিরান না করে। কখনও কখনও এ নির্দেশ অমান্যকারীদের শাস্তি পেতে হয়েছে এবং ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে ফসলী জমি বিনষ্টের। আজ জনসংখ্যা, আবহাওয়া ও পরিবেশগত যে সব সমস্যার সম্মুখীন আমরা, তার অনেক কিছুই সমাধান সম্ভব সবুজ বিপ্লবকে ত্বরাম্বিত করার মধ্য দিয়ে। তাই আমরা বলব, বিয়ে-শাদী, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে কোন ক্ষেত্রে বৃক্ষরোপণের ব্যাপারটি গুরুত্বসহ আলোচিত হওয়া উচিত। বৃক্ষ, কৃষি, খামার আমাদের জীবন ও জীবিকার আরও বহু উপকার সাধন করে। বিশেষ করে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটায়। এক এক জাতের গাছের উপকারিতা একেক ধরনের এবং মানুষ যুগ যুগ ধরে সে সব বহু মাত্রিক উপকারিতা পেয়ে ধন্য হয়ে আসছে। সবুজ বনানী বৃক্ষরাজি মহান স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালার এক অপরূপ দান ও দয়া। সুরা ওয়াক্বিয়াতে আল্লাহ বৃক্ষরোপণকে মানুষের জন্য তাযকিরাহ বা স্মরণিকা এবং মরুবাসীর জন্য পরম আশ্রয় বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন : আমি বৃক্ষকে করেছি স্মরণিকা এবং মরুবাসীদের জন্য (আশ্রয়) সামগ্রী। সুতরাং এর শোকরিয়া স্বরূপ তুমি তোমার মহান প্রভুর নামে পবিত্র তাসবিহ পাঠ কর।’ (আয়াত নং ৭৩, ৭৪)। হাদিস শরীফে হযরত রাসুলে কারীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, যখন কোন মানুষ মারা যায় তার পুণ্য প্রাপ্তির সকল দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তবে হ্যাঁ তিনটি মাধ্যমে তখনও তার কাছে সাওয়াব পৌঁছাতে থাকে। প্রথমত, সদকায়ে জারিয়াহ মাধ্যমে, দ্বিতীয়ত, এমন সৎ সন্তান যদি থাকে যে তার জন্য দোয়া করে এবং তৃতীয়ত, এমন ইলম বা জ্ঞান প্রচারের ব্যবস্থা করে- যা মানুষের উপকারে আসে।’ এ হাদিসে সাদকায়ে জারিয়াহকে মানুষের জন্য চিরস্থায়ী পুণ্য প্রাপ্তির মাধ্যম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর বৃক্ষরোপণ একটি অন্যতম ও উৎকৃষ্ট সাদকায়ে জারিয়াহ। গাছ লাগানোর জন্য যেমন ইসলামে উৎসাহিত করা হয়েছে, তেমনি অকারণে বৃক্ষ ধ্বংস করার ক্ষেত্রেও ইসলামে নানা শাস্তিমূলক ঘোষণা প্রদান করা হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ বিন হাবশি (রাঃ) হযরত মুহাম্মদ (সা.) উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন : যে ব্যক্তি অযথা ফুল গাছ কাটে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে মাথা উপুড় করে দোযখে নিক্ষেপ করবেন। মুহাদ্দিসগণ বলেছেন, ফলদানকারী গাছের বেলায়ও কথাটি প্রযোজ্য হবে। আমাদের উচিত জীবন ও জগতের স্বার্থে আমরা বৃক্ষরোপণ করব। অন্যদের এ কাজে উৎসাহিত করব, প্রয়োজনে একে অপরকে চারাগাছ উপহার দিয়ে সর্বত্র সবুজ বিপ্লবকে ত্বরাম্বিত করব। লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব [email protected]
×