ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

থামছে না নারী পাচার

প্রকাশিত: ২১:১১, ১১ জুন ২০২১

থামছে না নারী পাচার

নারী নির্যাতন-নিপীড়ন সমাজের এক চিরায়ত অভিশাপ। সেই পুরাকাল থেকে আজ অবধি সভ্যতার বিকাশমান ধারায় আধুনিকতার অনবদ্য সম্মিলন ছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ বিস্তারের সুবর্ণ সময়েও অর্ধাংশ এই গোষ্ঠীর অসহায় এবং মানবেতর জীবনযাপন ইতিহাসের বাস্তবতা। ক্রম বিবর্তনের ধারায় নতুন সমাজ যুগে যুগে সভ্যতার বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছে। কিন্তু শ্রেণী বিভাজনকে সে মাত্রায় বিলুপ্ত করতে পরাভূত হওয়ার দৃশ্যও হতবাক করে দেয়। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে অর্থ, বিত্ত, সম্মান কিংবা ক্ষমতার ফারাকই থাকে না, তার চেয়েও বেশি চরম আকার ধারণ করে নারী-পুরুষের অসাম্য এবং বৈষম্য। যা আধুনিক শিল্পোন্নত সমাজেরও এক অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। সামাজিকভাবে অপেক্ষাকৃত অসহায় এবং দুর্বল এই নারী গোষ্ঠীকে আজও মানুষের মর্যাদায় বেঁচে থাকার অধিকারের লড়াইকে চালিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এটা শুধু বৃহত্তর সমাজ নয়, ক্ষুদ্র পরিবারেও একটি কন্যা শিশু বড় হয় তার নাগরিক অধিকার বিসর্জন দিয়েই। নিগৃহীত হওয়ার অশুভ সূচনা সেখান থেকেই। সঙ্গতকারণে প্রায় নারী পাচার শব্দটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রথমেই আলোকপাত করা জরুরী নারীর সামাজিক অবস্থান কতখানি সহনীয় কিংবা মানবিক, তারা কেন কুচক্রী মহলের খপ্পরে পড়ে? পাচারকারীর সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের আবর্তে তলিয়ে যায়। আধুনিক প্রযুক্তির বিশ্বে এমন পাচার কার্যক্রম অনলাইন জগতে আরও বেশি সক্রিয় এবং শক্তিশালী। কম সময়ে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে শিকার ধরা পড়ে ফাঁদ পাতা জালে। ভালবাসার বাক্য বিনিময় থেকে শুরু করে বিদেশে পাড়ি জমানোর প্রলোভন ছাড়াও বিনোদনের জগতে হাতছানিও অসহায় তরুণীদের বিভ্রান্ত করে, বিপথগামী করতেও সময় লাগে না। বর্তমানে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে অন্য মালামালের সঙ্গে নারী পাচারও এক সর্বনাশা অপকর্ম। এক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক কার্যক্রমের মাধ্যমে এমন অশুভ পাচার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের। বিভিন্ন স্থানে। কলকাতা, হায়দ্রাবাদ, মুম্বাই এবং মধ্যপ্রাচ্য হচ্ছে পাচারের মূল গন্তব্য। পাচারকারীরা হাজার হাজার তরুণীকে নিজেদের খপ্পরে নিয়ে আসে তথ্যপ্রযুক্তির বলয়ের মাধ্যমে। সীমান্ত পার করা হয় দুস্থ-দরিদ্র নারীর পরিচয়ে ছেঁড়া কাপড় পরিয়ে। সম্প্রতি পাচারকারী দলের এক চক্র ভারতীয় সীমান্তে ধরা পড়লে তাদের জবানবন্দীতেই এমন সব তথ্য উঠে আসে গণমাধ্যমে। একটি মেয়েকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতেও পাচার চক্রকে অনেক কূটকৌশল অবলম্বন করতে হয়। যেমনÑ মেয়েটির কোন অশ্লীল ছবির ফুটেজ দেখিয়ে তাকে কাবু করার অপপ্রয়াসে দুর্বৃত্তরা শেষ অবধি সফলকামও হয়। নিরাপদ, নির্বিঘ্নে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে পার হয়ে তারা ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করে। সেখানেও তরুণীদের ওপর চলে অকথ্য শারীরিক নির্যাতন। সংঘবদ্ধ চক্রের হাতে সম্প্রতি শক্তিশালী এই পাচারকারীদের কয়েকজন পুলিশের হাতে আটক হয়। আটক হওয়ার পর তাদের সমস্ত চক্রান্ত জনসমক্ষে ফাঁসও হয়ে যায়। গত কয়েক বছর ধরেই এই নারী পাচার চক্র দুর্বৃত্তায়নকে লাগাম ছাড়া করে হাজার হাজার তরুণীর চরম সর্বনাশ। তবে সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে ভারতের ভূখণ্ডে ঢোকা কি করে সম্ভব সে প্রশ্ন থেকেই যায়। আইন কি যথেষ্ট সাবধানতায় পর্যাপ্ত নজরদারি করে না? নাকি কতিপয় অপশক্তির সম্মিলিত সহযোগিতায় এমন জঘন্য এবং রোমহর্ষক নৃশংসতা ঘটেই যাচ্ছে। এদিকে সাগর পথে মানব পাচারও থামানো যাচ্ছে না। করোনার চরম দুর্ভোগেও মানব পাচারকারীরা তাদের সক্রিয় অপকর্মকে প্রবলভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গারাও পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে পাড়ি দিচ্ছে সমুদ্র। যে কালো ছায়ার হাতছানি সমাজকে সুস্থভাবে টিকে থাকতে বার বার বিঘ্নিত করে, তাকে কঠোরহস্তে দমন করা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সচেতন দায়বদ্ধতা।
×