ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মঞ্চ নাটক লেখক প্রতিক্রিয়া নাসরীন মুস্তাফা

সাড়া জাগিয়েছে মঞ্চনাটক ‘বাঘ’

প্রকাশিত: ২১:২৯, ১০ জুন ২০২১

সাড়া জাগিয়েছে মঞ্চনাটক ‘বাঘ’

‘বাঘ’ নিয়ে অসাধারণ গল্পটি প্রথম শুনেছিলাম লেখক সৈয়দ নাজমুন নাহারের কাছে। আমি তখন শিশুকিশোর পত্রিকা ‘নবারুণ’-এর সম্পাদক হিসেবে কর্মরত। লেখা নিয়ে এসেছেন নাজমুন আপা। গল্প হচ্ছিল নানা বিষয় নিয়ে। তখনি তিনি স্মৃতি হাতড়ে অমূল্য রতন তুলে আনার মতো করে জানালেন এক বাঘের কথা। ষোলো বছর মাটির নিচের অন্ধকার ঘরে বন্দী ছিল বেচারা। শুনতে শুনতে সেই দুপুরে আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম, আমার অফিসের ছোট্ট ঘরটার দেয়ালগুলো থরথর করে কাঁপছে, কেননা অদৃশ্য থেকে ভেসে আসছে সুন্দরবনের এক বাঘ, বাংলাদেশের গর্ব রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আকাশ কাঁপানো গর্জন- ‘হালুম’! এই শ্রবণ অভিজ্ঞতায় সাক্ষী ছিলেন আরেকজন লেখক। বেগম মমতাজ হোসেন। কিছু দিন আগে মমতাজ আপাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি আমরা। আর সৈয়দ নাজমুন নাহার আপা ‘বাঘ’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছেন শিশুকিশোরদের জন্য। বইটি উৎসর্গ করেছেন আমাকে। কেননা, সেই ‘বাঘ’ আমি মঞ্চে হাজির করেছি বলে এই উপহার আমার প্রাপ্য বলে আপা মনে করেছিলেন। ‘বাঘ’-এর খোঁজ দেয়ার জন্য আমি কৃতজ্ঞতায় নতজানু এই লেখকের কাছে। মঞ্চে একটি বাঘ চলে আসবে, এ রকম অসম্ভব কল্পনা বাস্তবে সম্ভব হবে মোটেও ভাবিনি। আমি আমার শ্রবণ অভিজ্ঞতার ভার নিতে না পেরে ‘বাঘবন্দী’ নামে একটি গল্প লিখে ফেলেছিলাম। মঞ্চ আমার ভালবাসার জায়গা বলে মঞ্চায়িত হতে পারবে কি পারবে না, তা না ভেবেই নাটক লিখে ফেলার ‘বদঅভ্যাস’ আমার আছে। সে কারণেই লিখেছিলাম ‘বাঘবন্দী’ নামের মঞ্চনাটক। ড্রয়ারে ঘুমিয়ে থাকা নাটকের পাণ্ডুলিপি থেকে মাঝে মাঝেই সেই বাঘ আমাকে অস্থির করে তুলত। মনে করিয়ে দিত, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার অপরাধে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নামের ভয়ঙ্কর এক সুবেহ সাদেকের সময় প্রিয়তমা স্ত্রী-পুত্রদের-আত্মীয়দের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জীবন দিতে হয়েছিল ঘাতকের বুলেটের আঘাতে। বাংলাদেশ নামের দেশটার খোলসে ফিরে এসেছিল পাকিস্তানের পোকারা, যারা বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়া নিষিদ্ধ করেছিল বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে বিচারের নামে ফাঁসি দেয়া হলো। সাধারণ মানুষদের বুকের ভেতরে থাকা প্রিয় নেতার জন্য বেদনামথিত ভালবাসার উচ্চারণ ঠোঁটে যাতে না আসে, তার জন্য ভীতিকর সময় তৈরি করা হয়েছিল। এরপরও ভয় পাননি অনেকেই। সেই দুঃসহ সময়ের সাহসী যোদ্ধাদের প্রতি ভালবাসা জানাতে আকুল ছিলাম আমি। এই আকুলতা টের পেয়েছিলেন প্রিয় নাট্য নির্দেশক ড. আইরিন পারভীন লোপা আপা। পাণ্ডুলিপিটা পড়তে চাইলেন। এবং পড়ার পর আমাকে বিস্মিত করে জানালেন, তিনি ‘বাঘ’ আনবেন মঞ্চে। অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার অদম্য প্রচেষ্টায় লোপা আপার নির্দেশনায় ‘দৃশ্যকাব্য’ রিপার্টেরি থিয়েটার দল ‘বাঘ’ নাটকের রিহার্সেল শুরু করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের নাট্য আয়োজনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে মঞ্চে এল ‘বাঘ’। এই সবকিছুর জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই গুণী নির্দেশক ড. আইরিন পারভীন লোপা আপাকে, ‘দৃশ্যকাব্য’ রিপার্টেরি থিয়েটারের সকল সদস্যকে, মঞ্চের পেছনে থাকা সকল কুশীলবকে এবং অবশ্যই নাটকের সব দর্শককে, যারা ‘বাঘ’-এর প্রতিটি শোতে চোখ ভিজিয়েছেন, বুকের গহীনে অনুভব করেছেন বাঙালীকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতে পারা বাঙালীর পিতাকে, যিনি কিছুতেই বিশ্বাস করেননি তাঁর বাঙালী তাকে মারতে পারে! এক রাষ্ট্রীয় সফরে বান্দরবান গিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এক নেতা বঙ্গবন্ধুকে একটি বাঘের বাচ্চা উপহার দিয়েছিলেন। ঢাকা চিড়িয়াখানাকে বাঘের বাচ্চাটি উপহার দিয়েছিলেন প্রিয় নেতা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শহীদ হলেন বঙ্গবন্ধু আর তাঁর সেই বাঘটির ঠাঁই হয়েছিল ঢাকা চিড়িয়াখানার মাটির নিচের এক বদ্ধ কারাগারে। ১৯৯০-৯১ সালের দিকে হাইকোর্টে রিট মামলা হয়েছিল বাঘটির মুক্তি চেয়ে আর সেই খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক সংবাদে। এই তথ্যটুকুর নাট্যরূপ দিতে নাটকের চরিত্র হিসেবে কারাবন্দী এক কবিকে এনেছিলাম, যিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখে তাতে সুর দিয়ে গান গাওয়ার অপরাধে শাস্তি পাচ্ছিলেন সেই বদ্ধ ঘরে, যেখানে আঁধারের বেষ্টনী ভেদ করে হঠাৎ হঠাৎ জেগে ওঠে হারিয়ে যাওয়া সেই বাঘের গর্জন। বদ্ধঘরে বাঘ কীভাবে আসবে, দর্শকদের এই কৌত‚হল এক সময় উৎকণ্ঠায় পরিণত হয়, যখন সেনা কর্মকর্তা হাতামাথা কবিকে অত্যাচার করে জানতে চায়, কেন সে বাঘের কথা বলেছে? বন্দী কবির সংলাপে উঠে আসে এ রকম কথামালা-‘পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলা হলেই যেমন মনে পড়ে যায়, তেমনি মনে পড়ে যায় সব। অনেকেই বলতে শুরু করেছিল, হ্যাঁ, জোর দিয়েই বলছিল, খেলার সঙ্গে রাজনীতি টেনে আনা ঠিক না। খেলা ইজ গেম। ইটস নট পলিটিক্স। যে দেশ আমাদের ত্রিশ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী, এবং এর জন্য তাদের ভেতর কোন অনুশোচনা নেই, তাদের সঙ্গে খেলাও একটা যুদ্ধ। আমার কাছে, আমাদের কাছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কাছে, গোটা বাংলাদেশ জুড়ে শুয়ে থাকা গণকবরের কাছে, কিছুই খেলা নয়, কিছুই নয় পলিটিক্স। মুক্তিযুদ্ধের ছোট ভার্সন। সবকিছুই সত্য। বেঁচে থাকলে হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি যেমন সত্য, ঠিক তেমনি সত্য এই দেশ, দেশের জন্মের ইতিহাস, আর সেই তিনি বঙ্গবন্ধু। যে দেশে শ্বাস নিচ্ছি, সে দেশের জন্ম যিনি দিলেন, তাঁর নাম নিতে পারব না, একি মানা যায়?’ বাঘের কথা বলা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর কথা বলা যাবে না। কেবল মাত্র তোতাপাখির মতো তা-ই বলতে হবে, যা তারা বলতে বলবে। সেই রকম সময়ে ‘বাঘ’ হয়ে ওঠে বাঙালীর সামগ্রিক প্রতিবাদের প্রতীক। অদৃশ্য থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঘ, সেনা শাসনকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিতে চায়, যদিও সেনাশাসনের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয় বন্দী কবিকেই। নির্দেশক বিচারহীনতার সেই সময়কে উপস্থাপন করতে বিচারকের এজলাসে তাস পেটানো আজ্ঞাবহ কর্মচারীর দল ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অসহায়ত্বকে এমনভাবে তুলে এনেছেন, তাতে স্পষ্ট বোঝা যায় সাধারণ মানুষের আবেগ, চাওয়া-পাওয়াকে কোন্ এজলাশে দাঁড়াতে হতো তখন। বিচার কি আদৌ পাওয়া সম্ভব ছিল? তাহলে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি হয়েছিল কেন? আমরা আসলে আজকের প্রজন্মকে সেই কঠিন সময়ের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চেয়েছিলাম। গুণী আলোক নির্দেশক অঞ্চন বিশ্বাস মঞ্চে কেবলমাত্র আলো-ছায়ার খেলা আর একটি সিঁড়ির ব্যবহার করে সেই সময়কে একেবারে সামনে এনে ফেলেছেন বলে দর্শকও অস্থির হয়ে মুক্তির পথ খুঁজতে থাকেন। বন্দী চরিত্রে দক্ষ অভিনেতা মোতালেব হোসেন খালি গলায় ফুঁপিয়ে গেয়ে ওঠেন, ‘তুমি বিনে রে মুজিব’! গুণী সঙ্গীত নির্দেশক ইয়াসমীন আলীর ছোঁয়ায় এই হাহাকার সত্যি হয়ে ওঠে আজকের বাস্তবতায়। তুমি বিনে মুজিব আমাদের এই বাস, তুমি বিনে কত দেরি হয়ে গেছে আমাদের, তুমি বিনে আমরা ভুলে গেছিলাম আমাদের জাতিসত্তাকে। নাটকটি লিখতে গিয়ে পুরনো সেই সময়ের পত্রিকার খবর খুঁজতে গিয়ে বহুবার থমকে গেছি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি জোরদার ঘৃণা অপপ্রচারের মোড়কে সাজিয়ে ছুড়ে মারার নির্লজ্জ অপপ্রয়াস খুঁজে পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর নাম, তাঁর ছবি মুছে ফেলার জন্য বর্বর সেনাদের হামলা হয়েছে পত্রিকার অফিসে, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর তথা ডিএফপিতে, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে। খণ্ড খণ্ড ছায়া জোড়া দিয়ে হারিয়ে ফেলা ইতিহাসকে দাঁড় করাতে হয়, কল্পনার আশ্রয় নিতে হয় অসহায়ের মতো। উপায় কি? এখনও ডিএফপির পুকুরে জাল ফেললে ওঠে আসে ফিল্মের স্ট্রিপ, যেন তা বঙ্গবন্ধুর পবিত্র আত্মার দীর্ঘশ্বাসের টুকরো টুকরো রূপ। করোনা ভাইরাস মহামারীর বিপদে ফেলে না দিলে ‘বাঘ’ আরও অনেক বেশি বার মঞ্চায়িত হতে পারত, আরও অনেক বেশি দর্শককে অনুভব করাতে পারত সত্যের কদর্য রূপকে। এর পরও বিজয় দিবসের মতো বিশেষ দিবসে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে, মহিলা সমিতিতে ‘বাঘ’ গর্জে উঠেছে অনেক বার। মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ মনসুর আলম খান মুজিববর্ষ উপলক্ষে ‘মুজিববর্ষে শতঘণ্টা মুজিবচর্চা’ শিরোনামে চমৎকার অনলাইন সিরিজ আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করছিলেন বছরজুড়ে। এরই অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সংস্কৃতিচর্চায় ‘বাঘ’ নাটকের দুটি মঞ্চায়ন সম্ভব হয় মেহেরপুরে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিতসংখ্যক দর্শকের সামনে মঞ্চায়িত নাটকটি অনলাইনেও উপভোগ করা গেছে।
×