ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রায়হান আহমেদ তপাদার

ভ‚মিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় পূর্ব পরিকল্পনা জরুরী

প্রকাশিত: ২১:০৬, ১০ জুন ২০২১

ভ‚মিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় পূর্ব পরিকল্পনা জরুরী

ভ‚তাত্তি¡ক ও ভ‚মির গঠন অনুসারে বাংলাদেশ ভ‚মিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। বিগত ২০০ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৮টি বড় ধরনের ভ‚মিকম্প হয়েছিল। এর মধ্যে ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভ‚মিকম্প ও ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভ‚মিকম্পের উৎসস্থল ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। বাংলাদেশের অভ্যন্তর ও চারপাশে বেশকিছু সিসমিক গ্যাপ আছে। একে ভ‚মিকম্পের উৎসস্থল বলা হয়। ভ‚তত্ত¡বিদ ও সিসমোলজিস্টদের হিসাব মোতাবেক, বাংলাদেশে যে কোন সময় মাঝারি কিংবা বড় মাত্রার ভ‚মিকম্প সংঘটিত হতে পারে। এ জন্য আমাদের কাঠামোগত এবং অকাঠামোগত প্রস্তুতি এখনই বাড়ানো দরকার। এ ধরনের প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে ভ‚মিকম্প দুর্যোগের ঝুঁকি বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। ভ‚মিকম্প সৃষ্টির প্রধান কারণ হলো পৃথিবীর বিভিন্ন স্তরের শিলাখণ্ডের স্থিতিস্থাপকীয় বিকৃতি। তদুপরি বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানীরা ভ‚মিকম্প সৃষ্টির অন্য এক কারণও উদ্ভাবন করেছেন, সেটা হলো জলাশয় বেষ্টিত কম্পন। ভারতের মহারাষ্ট্রের শিবাজিসাগর জলাশয়ের সন্নিকটবর্তী অঞ্চলে ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ৬.৫ রিখটার স্কেলের মাপে বেশ কয়েকটা ভ‚মিকম্প অনুভ‚ত হয়। বিশ্বের বেশকিছু জলাশয় অঞ্চল যেমন- ভাগরাও লেক (সুইজারল্যান্ড), মারাথান লেক এবং ক্রেমাস্টা লেক (গ্রিস), গ্র্যান্ড ভেল লেক, (ফ্রান্স), লেক মিয়াড (যুক্তরাষ্ট্র), কাভিরা লেক (রোডেসিয়া-জিম্বাবুয়ে) প্রভৃতি অঞ্চলে এ রকম ভ‚মিকম্প হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও আগ্নেয়গিরির উৎপত্তির স্থলে চুনাপাথরে দ্রবণ ক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট গহŸরে স্তর পতনের ফলে ভ‚মিকম্পের উৎপত্তির সম্ভাবনা থাকে। অগ্ন্যুৎপাতের সঙ্গে ভ‚মিকম্পের সম্পর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জসহ ফিলিপিন্স অর্থাৎ প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। ১৯৬০ সালে গামবেল নামের জনৈক বিজ্ঞানী একটা নতুন পরিসংখ্যান তত্ত¡ উদ্ভাবন করেন। তাতে দেখা যায়, বৃহৎ ভ‚মিকম্পের সংখ্যা ক্ষুদ্র ভ‚মিকম্পের চেয়ে অনেক কম। গুটেনবার্গ নামের একজন বিজ্ঞানী ভ‚মিকম্পের সংখ্যা এবং রিখটার স্কেলে দেখা ভ‚মিকম্পের মাত্রার মধ্যে একটা সমীকরণ উদ্ভাবন করেন; যার দ্বারা ভ‚মিকম্পের পূর্বাভাস দেয়া কিছুটা সম্ভব হয়। ভ‚মিকম্প শব্দটি দ্বারা যে কোন প্রকার ভ‚কম্পনজনিত ঘটনাকে বোঝায়, সেটা প্রাকৃতিক অথবা মনুষ্য সৃষ্ট যাই হোক না কেন। বেশিরভাগ ভ‚মিকম্পের কারণ হলো ভ‚গর্ভে ফাটল ও স্তরচ্যুতি হওয়া। সেটা অন্যান্য কারণ যেমন অগ্ন্যুৎপাত, ভ‚মিধস, খনিতে বিস্ফোরণ বা ভ‚গর্ভস্থ নিউক্লিয়ার গবেষণায় ঘটানো আণবিক পরীক্ষা থেকেও হতে পারে। ভ‚মিকম্পের প্রাথমিক ফাটলকে বলে ফোকাস বা হাইপোসেন্টার। ভ‚-অভ্যন্তরে শিলায় পীড়নের জন্য যে শক্তির সঞ্চয় ঘটে, সেই শক্তির হঠাৎ মুক্তি ঘটলে ভ‚পৃষ্ঠ ক্ষণিকের জন্য কেঁপে ওঠে এবং ভ‚ত্বকের কিছু অংশ আন্দোলিত হয়। এইরূপ আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী কম্পনই ভ‚মিকম্প। ভ‚মিকম্প সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে ১/২ মিনিট স্থায়ী হয়। মাঝেমধ্যে কম্পন এত দুর্বল হয় যে, তা অনুভব করা যায় না। কিন্তু শক্তিশালী ও বিধ্বংসী ভ‚মিকম্পে ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে। পৃথিবীর অভ্যন্তরে যেখান থেকে ভ‚কম্প-তরঙ্গ উৎপন্ন হয়, তাকে ভ‚মিকম্পের কেন্দ্র বলে। এই কেন্দ্র থেকে কম্পন ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গের মাধ্যমে সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর এই কম্পনই ভ‚মিকম্পরূপে আমাদের কাছে আবির্ভ‚ত হয়। কখনও কখনও আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ও গলিত লাভা উৎক্ষিপ্ত হওয়ার কারণে ভ‚মিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে। কখনও পাহাড় কিংবা উঁচুস্থান থেকে বৃহৎ পরিসরে শিলাচ্যুতিজনিত কারণে ভ‚মিকম্প হতে পারে। ভ‚ত্বক তাপ বিকিরণ করে সঙ্কুচিত হয়ে পড়লে ফাটল ও ভাঁজের সৃষ্টি হয়ে ভ‚মিকম্প হয়। ভ‚গর্ভে বাষ্প ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলে তা ভ‚ত্বকের নিম্নভাগ ধাক্কা দেয় ফলে প্রচণ্ড ভ‚কম্পন অনুভ‚ত হয়। বাংলাদেশে ৮টি ভ‚তাত্তি¡ক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে। যথাÑ বগুড়া চ্যুতি এলাকা, রাজশাহীর তানোর চ্যুতি এলাকা, ত্রিপুরা চ্যুতি এলাকা, সীতাকুÐ টেকনাফ চ্যুতি এলাকা, হালুয়াঘাট চ্যুতির ডাওকি চ্যুতি এলাকা, ডুবরি চ্যুতি এলাকা, চট্টগ্রাম চ্যুতি এলাকা, সিলেটের শাহজীবাজার চ্যুতি এলাকা এবং রাঙ্গামাটির বরকলে রাঙ্গামাটি চ্যুতি এলাকা। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লেমন্ট-ডোহের্টি আর্থ অবজারভেটরির ভ‚তাত্তি¡করা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের নিচে জমে ওঠা টেকটনিক প্লেটে চাপ জমে উঠছে কম করে বিগত ৪০০ বছর ধরে। এই চাপ যখন মুক্ত হবে, তখন সৃষ্ট ভ‚মিকম্পের মাত্রা দাঁড়াবে প্রায় ৮.২ রিখটার, এমনকি তা ৯ রিখটারেও পৌঁছতে পারে। প্রায় ১৪ কোটি মানুষ এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে ৭.৬ মাত্রার ভ‚মিকম্প হয় এবং ২০০৭ সালের নবেম্বর মাসে হয় ৬.০ মাত্রার ভ‚মিকম্প। এমনকি বুয়েটের মানমন্দিরে ২০০৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ৪ বছরে রিখটার স্কেলে ৪ মাত্রার ৮৬টি ভ‚কম্পন নথিভুক্ত করা হয়। এই সময়ের মধ্যে ৫ মাত্রার চারটি ভ‚কম্পনও ধরা পড়ে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের মানমন্দিরে ২০০৭ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত কমপক্ষে ৯০টি ভ‚কম্পন নথিভুক্ত করা হয়। তন্মধ্যে ৯টিরই রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫-এর ওপরে এবং সেগুলোর ৯৫ শতাংশ-এরই উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা শহরের ৬০০ কিলোমিটারের মধ্যে। অতীতের এসব রেকর্ড থেকে দেখা যায়, ভ‚মিকম্পের মাত্রা না বাড়লেও ১৯৬০ সালের পর থেকে ভ‚মিকম্প সংঘটনের হার বেড়েছে। অর্থাৎ ঘন ঘন স্বল্প মাত্রার ভ‚মিকম্প হচ্ছে। সম্প্রতি সিলেটে যা হয়েছে। মতবিরোধ থাকলেও অনেক ভ‚তাত্তি¡ক ছোট ছোট ভ‚মিকম্প সংঘটন বড় ধরনের ভ‚মিকম্পের পূর্বাভাস বলে উল্লেখ করেন। অতীতের এসব রেকর্ডকে প্রাধান্য দিয়ে গবেষকরা জানিয়েছেন, যে কোন সময় বাংলাদেশে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভ‚মিকম্প আঘাত হানতে পারে। সরকারী তথ্যসূত্র মতে, ঢাকায় রাতের বেলায় ৭ থেকে ৭.৫ মাত্রার ভ‚মিকম্প হলে লক্ষাধিক লোক হতাহত হবে। দিনেরবেলায় হলে হতাহতের সংখ্যা হবে কিছুটা কম। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন অঞ্চলের ৩,২৬,০০০ ভবনের ওপর পরিচালিত সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, এমন তীব্রতার ভ‚মিকম্পে প্রায় ৭২,০০০ ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে, আরও ৮৫,০০০ ভবন মাঝারি ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুধু দালান ভাঙ্গার কারণে ক্ষয়ক্ষতি হবে ৬-১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য সম্পদ। এমনকি জাতিসংঘ পরিচালিত রিস্ক এ্যাসেসমেন্ট টুলস ফর ডায়াগনসিস অব আরবান এরিয়াস এগেইন্সট সিসমিক ডিজাস্টার জরিপে ভ‚তাত্তি¡ক ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকাও অন্যতম। যদিও ভ‚মিকম্পের সময় সুরক্ষার কোন গ্যারান্টি নেই, তবে আগাম পরিকল্পনার সম্ভাব্য বিপদগুলো চিহ্নিতকরণ জীবন বাঁচাতে পারে এবং আঘাত ও সম্পত্তির ক্ষতি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে পারে। উল্লেখ্য, সিলেটে পরপর পাঁচ মাত্রার মৃদু ভ‚কম্পন অনুভ‚ত হয় অতি সম্প্রতি। ভ‚মিকম্পগুলোর উৎপত্তিস্থল জৈন্তাপুর উপজেলার সারি নদীর উজানে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পাহাড়ী অঞ্চলে, যা ডাউকি ফল্ট লাইনের পূর্বপ্রান্ত। ডাউকি ফল্ট লাইন বা ফাটল রেখার অবস্থান সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের উত্তরে সীমান্তজুড়ে, যা ভারতের শিলং মালভ‚মির দক্ষিণ সীমানা। ১৮৯৭ সালে ডাউকি ফল্ট লাইনে ৮ রিখটার স্কেলের বেশি মাত্রার ভ‚মিকম্প হয়, যার তীব্রতা কলকাতা ছাড়িয়ে আরও পশ্চিমে এবং মিয়ানমার পর্যন্ত অনুভ‚ত হয়। সাম্প্রতিককালে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, পললভ‚মির নিচে অবস্থিত টেকটনিক প্লেটগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হয়ে থাকে। ভ‚ত্বকের নিচের অবস্থা জানতে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ‚পদার্থবিদ মাইকেল স্টেকলারের নেতৃত্বে গবেষক দল বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় অতি সংবেদনশীল বেশ কিছু জিপিএস যন্ত্র স্থাপন করে। ২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ওই গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকও অংশ নেন। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারেও এ রকম কিছু যন্ত্র বসিয়ে সমগ্র ফল্ট অঞ্চলের একটি মানচিত্র তৈরি করা হয়। গেøাবাল পজিশনিং সিস্টেমসের (জিপিএস) দেয়া তথ্য অনুযায়ী, একটি টেকটনিক প্লেট আরেকটির নিচের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আর সেগুলোর অবস্থান বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও পূর্ব ভারতজুড়ে বিস্তৃত একটি অঞ্চলের নিচে। ফল্টের উপরের স্তরে দুটি প্লেট পরস্পর লেগে আছে। এতে সৃষ্ট চাপের প্রভাবে প্রচÐ শক্তিশালী ভ‚কম্পন হতে পারে। স্টেকলার বলেন, বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে নানা সমস্যা ধরা পড়েছে। সেখানে বালু ভরাট করে ২০ তলা ভবন নির্মাণ করতেও দেখা যায়। ভ‚মিকম্প হলে এ রকম ভবন সহজেই ধসে পড়বে। এ ছাড়া অতিরিক্ত জনবহুল হওয়ায় সেখানে ভ‚মিকম্প হলে প্রাথমিক উদ্ধার তৎপরতায় বিঘœ হতে পারে। এখন স্বাভাবিক অবস্থায়ই ঢাকা শহরে যানবাহন চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে। সেখানকার রাস্তায় যদি ভ‚মিকম্পের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়ে, ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো এবং উদ্ধার তৎপরতা চালানো সত্যিই অসম্ভব কাজ হবে। তবে এই ভ‚মিকম্প ঠিক কখন হতে পারে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। এটা আগামীকালও হতে পারে, আবার ৫০০ বছর পরেও হতে পারে। গবেষণাপত্রটি আরও বলছে, অনিয়ন্ত্রিত ভবন ছাড়াও ভ‚মিকম্পে ভারি শিল্প-কারখানা, বিদ্যুতকেন্দ্র এবং প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রগুলো ধ্বংস হতে পারে। তবে ভ‚মিকম্প হওয়ার আশঙ্কায় অযথা আতঙ্কিত না হয়ে যাতে ভ‚মিকম্পের পরবর্তী দুর্যোগের মোকাবেলায় যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, সে বিষয়ে ব্যাপক চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। বিভিন্ন কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরী। জেলা প্রশাসন, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন ও নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিধিবহির্ভ‚তভাবে নির্মাণ করা এবং ভ‚মিকম্প ডিজাইন না থাকা ঘরবাড়িগুলো শনাক্ত করে বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করাও আবশ্যক। লেখক : গবেষক [email protected]
×