ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অপরাধ ও সামাজিক আন্দোলন

প্রকাশিত: ২১:০৪, ১০ জুন ২০২১

অপরাধ ও সামাজিক আন্দোলন

সামাজিক আন্দোলনের বেশকিছু সুনির্দিষ্ট ও গ্রহণযোগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যে বিষয়গুলোকে উপজীব্য করে আন্দোলনের সূত্রপাত করা হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাক স্বাধীনতা, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান ইত্যাদি নাগরিক অধিকারগুলো বাস্তবায়নের জন্য জনগণকে আন্দোলন করতে হয়েছে। ধারাবাহিকতায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ভোট প্রদানের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় জনগণকে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। বিংশ শতকে ব্যক্তির ন্যূনতম পর্যায়ে অর্থনৈতিক সুরক্ষা ও সমাজের সার্বিক কর্মকাÐে স্বতঃস্ফ‚র্ত অংশগ্রহণের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনের সাহায্য নিতে হয়েছে। এছাড়াও সুনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনের ঘটনাটি সমগ্র বিশে^ আলোড়িত। কিছুদিন আগেও বাংলাদেশে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরী নির্ধারণের ক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলনের ঘটনাটি বেশ গুরুত্ব বহন করে থাকে। সমগ্র বিশে^ শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের অধিকার সুরক্ষার নিমিত্তে সর্বতোভাবে সাধারণ মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিতে বিশ^ব্যাপী জনমত গড়ে তুলতে হয়েছে। কাজেই বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন জায়গায় যে বিষয়াদির মাধ্যমে নাগরিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়ে অগ্রাধিকার পায়, সেসবই সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমসাময়িককালেও বাংলাদেশ থেকে অপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, সামাজিক অসংহতি, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, অপসংস্কৃতি, অধিকার হরণের সংস্কৃতি থেকে উত্তরণের জন্য সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। একবিংশ শতাব্দীর সামাজিক আন্দোলনের ব্যাপক বৈচিত্র্য রয়েছে। কেননা, এ সময়ের আন্দোলনের উদ্দেশ্যের ব্যাপকতা থাকতে হবে, সমাজ তথা রাষ্ট্রের স্বশিক্ষিত নাগরিকদের দৃষ্টি আকর্ষণের মতো ইস্যুকে আলোচনায় নিয়ে আসতে হবে এবং সর্বোপরি বিষয়টির আন্তর্জাতিকীকরণের সম্ভাবতা যাচাই করার উপজীব্য থাকতে হবে। তাহলে যে কোন বিষয় সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে আলোচনায় নিয়ে আসা যাবে। বিশেষ করে সামাজিক আন্দোলন মানবাধিকারকে সুসংহত করে তোলে, ন্যায়বিচারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে, ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষালম্বন করে থাকে, অধিকন্তু সামাজিক আন্দোলন বিশে^র শান্তি, নিরাপত্তা এবং পরিবেশের সামঞ্জস্যতা বজায় রাখতে ব্যাপকভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে বেশ কিছু সামাজিক আন্দোলন রয়েছে, যেগুলো বিশেষ কিছু গ্রæপের স্বার্থ সংরক্ষণ করে থাকে। যেমনÑ নারী আন্দোলন, সমগোত্রীয় শ্রেণীর মিলনের বৈধতা ইত্যাদিসহ বেশ কিছু আন্দোলন রয়েছে, যেগুলো বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার্থে করা হয়ে থাকে। পরিবর্তনশীল বিশে^ সামাজিক আন্দোলনের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমত, সামাজিকভাবে শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানবাধিকার সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বিষয়াদির সঙ্গে সমতা বিধান করে আন্দোলনের আলোচ্য বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা। দ্বিতীয়ত, শিক্ষক, প্রফেসর, সাংবাদিক, আইনজীবী, সমাজকর্মী, চিত্রশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, শিক্ষানবিশ প্রত্যেককে একত্রিত করে আন্দোলনের আহŸান করা। তৃতীয়ত, আন্দোলনের বিষয়বস্তুর আন্তর্জাতিকীকরণ থাকতে হবে। চতুর্থত, দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে আন্দোলনের ফলে আহ‚ত সমাধানের গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। কাজেই সামাজিক আন্দোলন সফলতার মুখ দেখবে যদি উল্লেখিত বিষয়গুলো তথা ব্যক্তিবর্গকে আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত করা যায়। অন্যভাবে যদি বলা হয় তাহলে বলতে হবে, সামাজিক আন্দোলন হতে হবে সামষ্টিক, সুসংগঠিত, দৃঢ়, অপ্রাতিষ্ঠানিক (সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে), কল্যাণকর ও সার্বজনীনভাবে সকলের নিকট বোধগম্য। তাহলেই সামাজিক আন্দোলনের যথার্থতা পরিলক্ষিত হবে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে সামাজিক আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তবে আমাদের মধ্যে সয়ে যাওয়ার একটি প্রবণতা বিদ্যমান, যার প্রেক্ষিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংঘটিত হয় না। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, আপনি আপনার কর্মস্থলে কোনভাবে ভিক্টিম (ক্ষতিগ্রস্ত) হয়েছেন। বিষয়টি আপনার সহকর্মীর সঙ্গে শেয়ার করলেন, তিনি শুনে আফসোস করলেন, কিন্তু কোন প্রতিবাদ করলেন না। ফলে আপনার অধিকারও সুরক্ষিত হলো না। এমন পরিস্থিতিই সর্বত্র ঘটছে, কেউ সৎসাহস নিয়ে প্রতিবাদ করায় আগ্রহ দেখাচ্ছে না। খুবই ভাল হতো যদি সহকর্মীটি অন্যদের সঙ্গে নিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন, তাহলে নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি পরবর্তীতে এমন জঘন্য সিদ্ধান্ত নিতে সাহস দেখাতেন না এবং ভিক্টিম হওয়া ব্যক্তিটির অধিকার সুরক্ষিত হতো। নীতিগতভাবে আপনি যে বিষয়টি অর্জনের যোগ্যতা রাখেন সেখান থেকে আপনাকে বঞ্চিত করার প্রেক্ষিতে আপনার সহকর্মীরা যদি প্রতিবাদমুখর হয়ে না ওঠে তাহলে এমন ঘটনার প্রতিরূপ পর্যায়ক্রমে ঘটেই যাবে। কাজেই, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি পর্যায়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদ করা দোষের কিছু নয়। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, গা বাঁচিয়ে চলার হীনম্মন্যতা সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। স্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে। জীবনযাপনের অনিয়ন্ত্রিত ঘেরাটোপে অপরাধ প্রবণতায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে। করোনাকালীন কিশোর গ্যাংয়ের সচিত্র প্রতিবেদন পত্রিকার পাতায় ফলাও করে প্রচার হচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, সমাজের সর্বত্র অবক্ষয়ের নমুনায়ন বিদ্যমান। কিশোররা জাতির আগামী দিনের ভবিষ্যত। তাদের অপরাধ প্রবণতা থেকে যে কোন মূল্যে নিবৃত্ত করতে হবে। উল্লেখ করা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করে সমাজ থেকে কিশোর অপরাধ নির্মূল করা প্রায় অসম্ভব। আর সেজন্যই সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। সামাজিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে পারিবারিক কাঠামো, সামাজিক কাঠামো ও সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার উপর শিশু কিশোরদের অভ্যস্ত করার উদ্দেশ্যে সামাজিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেখানে কিশোরদের চিত্ত বিনোদনের জন্য মোবাইল ফোন ইন্টারনেটের ব্যবহার ব্যতিরেকে চিরায়ত বাঙালীর সংস্কৃতির ওপর ভরসা করার উৎসাহ প্রদান করতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রতুলতায় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন গেমসে আসক্ত হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি অনলাইন ভিত্তিক গ্যাং গ্রæপের সঙ্গে মনের অজান্তেই যোগাযোগ গড়ে তুলছে। গ্যাং গ্রæপের মধ্যস্থতায় অনেকেই ভয়ঙ্কর অপরাধ সংঘটিত করছে। অন্যদিকে মাদকের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে একশ্রেণীর কিশোর। শিল্পায়ন ও নগরায়ণের বিকাশ, ডিজিটালাইজেশন, অপরাধ করার সম্ভাব্য সুযোগ, মনস্তাত্তি¡ক চাপ, সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার অভাব, পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন ইত্যাদি কারণে কিশোররা অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে। পর্যায়ক্রমে সমাজে একটি অস্থিতিশীল, শ^াপদসংকুল পরিস্থিতির আবির্ভাব হয়েছে। এহেন পরিস্থিতি কোনক্রমেই কাম্য নয়। কাজেই, সামাজিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে ইন্টারনেট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নিকট জবাবদিহির প্রসঙ্গে এলাকাভিত্তিক ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। মাদক সরবরাহকারীদের চিহ্নিত করে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। না হয় মাদক সরবরাহকারী ও বাজারজাতে সংশ্লিষ্টদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করতে হবে। সামাজিক রীতি-নীতি ও মূল্যবোধে আদিষ্ট হওয়ার শিক্ষা পরিবার থেকে নিশ্চিত করতে হবে। পরিবারের সঙ্গে শিশু-কিশোরদের সুসম্পর্ক বজায় রাখার উদ্দেশ্যে অভিভাবকদের সচেতন ও যুগোপযোগী হতে হবে। কিশোর অপরাধী হয়ে ওঠার সকল সুযোগ বিনষ্ট করে দিতে হবে। নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে কিশোরদের প্রতি। সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজার রাখার ক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো সর্বপ্রথম একটি সংস্থা হিসেবে কাজ করে, পর্যায়ক্রমে সদস্য সংগ্রহের অভিযানে নেমে পড়ে এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়া পদ্ধতি অবলম্বন করে তারা তাদের সংগঠনের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে থাকে। সন্ত্রাসবাদ এবং সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ার বিশাল পরিমÐলে তাদের অবস্থান তৈরি করার সুযোগ পায়। অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রও তাদের অবস্থান তৈরি করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। সন্ত্রাসী সংগঠনসমূহের সমষ্টিগত পরিচয় থাকে সম্ভবত নতুন সামাজিক আন্দোলনের ন্যায় এবং তারা প্রায়ই নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত করে সংগঠনের সদস্য অন্তর্ভুক্ত করে থাকে। তাৎক্ষণিক পরিবর্তনে বিশ^াসী জঙ্গীরা রাষ্ট্রের বাধা মোকাবেলায় আন্দোলন চক্র ব্যবহার করে। দ্বি-পাক্ষিক সন্ত্রাসবাদ কার্যকর হয় প্রকৃতপক্ষে সামষ্টিক আন্দোলনের মাধ্যমে। অবশ্য তার মধ্যে আন্তর্জাতিক ইন্ধনও কাজ করে থাকে। অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদের প্রক্রিয়াটি একটি সামগ্রিক ও সমষ্টিগত বিষয়। এহেন সন্ত্রাসবাদের শিকড়কে চিরতরে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে ধূলিসাত করার নিমিত্তে সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। রাষ্ট্রে বসবাসরত মানুষকে যদি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে শামিল করানো সম্ভব হয়, তাহলেই সন্ত্রাসবাদসহ যে কোন ধরনের ঘৃণিত কর্মকাÐ থেকে রাষ্ট্রকে নিরাপদ রাখা যাবে এবং জনগণও নিরাপদে নিরাপত্তাসহ বসবাস করতে পারবে। লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়
×