ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাফাত রেজা অনতু

তাঁত শিল্পে দুর্দিন

প্রকাশিত: ২২:০৯, ৬ জুন ২০২১

তাঁত শিল্পে দুর্দিন

বিশ্ব অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত। ঠিক সে সময়ে বাংলাদেশ সমগ্র প্রতিকূল প্রতিবেশ মোকাবেলা করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে যার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ হলো বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে উর্ধ্বগতি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ এমনিতেই শীর্ষ সারিতে রয়েছে। এ অবস্থায় সামনের দিনগুলোতে সামগ্রিক বিবেচনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি একটা সাবলীল ধারায় প্রবাহিত হলেও- ক্ষেত্রবিশেষে কিছু সঙ্কট পেশাগত জীবনে অনেককেই নাজুক অবস্থায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের তাঁত শিল্প প্রবল সঙ্কটের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে। তাঁত শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী ও তাঁত শ্রমিকরা এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিন যাপন করছে। ২০২০ এর মার্চ থেকে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ এর ধাক্কায় তছনছ হয়ে গেছে তাঁত শিল্প ব্যবসার সুস্থির প্লাটফর্মটি। সারা দেশের মধ্যে টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত তাঁত শিল্প এক কঠিন সময় পার করছে। মহামারীর পূর্বে টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জের তাঁত শিল্প যেখানে সারা দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও শাড়ি, থ্রি-পিস ও অন্যান্য বস্ত্রাদি তৈরির পর বিপণন করে সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছিল। কোভিড-১৯ সেই পথচলায় এক বিরাট ছন্দপতন ঘটিয়ে দিয়েছে। যা ছিল একেবারেই অনাকাক্সিক্ষত। তাই গত ১৫ মাস যাবত এ তাঁত শিল্প টিকে থাকার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে পড়েছে। কতদিন এই সংগ্রাম চলবে তারও নেই কোন পূর্বাভাস। কোভিড-১৯ এর কারণে বিগত ১৫ মাসের মধ্যে পার হওয়া ঈদসহ বেশকিছু বড় বড় উৎসব হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় হাজারো কোটি টাকার ব্যবসায়িক লেনদেন থেকে বঞ্চিত হয়েছে অত্র অঞ্চলের তাঁত ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে টাঙ্গাইলের শাড়ির বাজারে নেমে এসেছে ভয়াবহ ধস। যে ধস থেকে উত্তরণে লাগবে যথেষ্ট সময়। টাঙ্গাইলের শাড়ির রয়েছে দীর্ঘ সময়ের ঐতিহ্য। বাঙালী সংস্কৃতির ধারার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত এই শিল্প। বিগত ২৫ বছর ধরে টাঙ্গাইল শাড়ির বাজারটা ধারাবাহিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ এর প্রবাবে সীমাহীন অর্থ সঙ্কট চলে আসে এই শিল্পে। টাঙ্গাইলের শাড়ির বাজার সারাদেশজুড়ে হলেও পাইকারি বাজার হিসেবে খ্যাতি লাভ করে করটিয়ার হাট (মঙ্গলবার) এবং বাজিতপুরের হাট (শুক্রবার)।দুই হাটকে ঘিরেই সারাদেশ থেকে ক্রেতারা টাঙ্গাইলের শাড়ি, থ্রি-পিসসহ বিভিন্ন বস্ত্রাদি সংগ্রহ করে। করটিয়া হাটের বিপণন তথ্য মতে প্রায় প্রতি হাটে ২০-২৫ কোটি এবং বাজিতপুর হাটে ২০-৩০ লাখ টাকার ক্রয়-বিক্রয় হয়। কিন্তু বিগত ১৫ মাস ধরে তা-প্রায় অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। এই পরিস্থিতি থেকে কিভাবে উত্তরণ ঘটা যায় সে চিন্তাই এখন তাঁত শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী ও তাঁত শিল্পীদের ভাবিয়ে তুলেছে। যে তাঁত শিল্প স্বকীয়তা নিয়ে বাংলা দেশের অর্থনীতিতে একটি নিজস্ব ধারা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিল। সেই ধারায় তৈরি হয়েছে অভাবনীয় প্রতিবন্ধকতা। আঠারো শ শতকে ব্রিটিশ যুগের কলের তাঁতে শাড়ি বুনন শুরু হলে হাতে বোনা দেশীয় তাঁতের শাড়ি বিলুপ্তির কিনারে চলে আসে। তারপর ব্রিটিশদের শাসন অবসানের পরে ১৯৪৭ এ দেশভাগ হলে পাকিস্তান সৃষ্টি, অতঃপর ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তাঁত শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। দেশ স্বাধীনের পর বিগত ৫০ বছরে এসে তাঁত শিল্প একটা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়ালেও সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ একটা অশনি সংকেত হয়ে দেখা দেয়ায় এই শিল্পের অবস্থা ক্রমশ: নাজুক পরিস্থিতির কবলে পড়ে যায়। বর্তমান সরকার অন্যান্য শিল্পের পাশাপাশি তাঁত শিল্পকেও প্রণোদনার মাধ্যমে সার্বিক সহায়তার ব্যবস্থা অব্যাহত রেখেছে। ফলে তাঁত শিল্পের দুর্দিন অচিরেই কেটে যাওয়ার প্রত্যাশা সকলের। তাঁত শিল্পের অতীত বর্তমানের নানা বিষয় নিয়ে এক সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতা হয় টাঙ্গাইলের বিশিষ্ট তাঁত ব্যবসায়ী, ফ্যাশন ডিজাইনার মনে মন্টু বসাকের সঙ্গে। তিনি বলেনÑ সারা পৃথিবী এক মাহদুর্যোগের মধ্য দিয়ে গত এক বছর ধরে সময় পার করছে। এই দুর্যোগের কবলে পড়ে বাংলাদেশের মানুষও রয়েছে মহাসঙ্কটে। স্বাভাবিক জীবনযাপন, ব্যবসা, বাণিজ্য, অফিস-আদালত সবখানেই বিরাজ করছে কঠিন পরিস্থিতি। অর্থনীতিতে বিপর্যয় ডেকে এনেছে এই মহামারী। টাঙ্গাইলের তাঁত ব্যবসায়ী ও এই পেশার সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার পরিবার আজ দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। কবে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে কেউ জানে না। এই অবস্থার মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত আমাদের অর্থনীতিকে গতিশীল রেখেছে। টাঙ্গাইলের শত শত ব্যবসায়ী এবং সংশ্লিষ্ট তাঁত শ্রমিকরা বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছে। মনে মন্টু বসাক বলেছেন- আমরা মনে করেছিলাম গত পহেলা বৈশাখ ও ঈদে এক বছরের বিপর্যয় কিছুটা কাটিয়ে উঠে যাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় মহামারীর কারণে দেশজুড়ে নতুন করে চলছে এখন লকডাউন ফলে আমরা আবারও অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা তাঁত ব্যবসায়ীদের দিকে যদি বাড়িয়ে দেন। তাঁর সহানুভূতির দৃষ্টি যদি তাঁত শিল্পের দিকে নিবদ্ধ হয়। তাহলে বাঙালীর হাজার বছরের এ ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা টিকে থাকার সুযোগ পাবে। তাই আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করব- যেন টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পকে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়ে সুদমুক্ত ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করে এবং কয়েক বছরের জন্য তাঁত শিল্পকে করের আওতা বহির্ভূত রাখার ব্যবস্থা করা হয়। তাহলে এই শিল্প টিকে থাকার প্রচেষ্টায় সক্রিয় থাকবে। তাই সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ সরকার যেন বাঙালী সংস্কৃতির এই ঐতিহ্যকে এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
×