ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পবান্ধব বাজেটে ॥ কর্মসংস্থানের নতুন সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ২২:০৯, ৬ জুন ২০২১

শিল্পবান্ধব বাজেটে ॥ কর্মসংস্থানের নতুন সম্ভাবনা

বছর ঘুরে আবার এসেছে নতুন অর্থবছরের (২০২১-২২) বাজেট। ৩ জুন থেকে শুরু হয়েছে বাজেট অধিবেশন। এক বছরের আয়-ব্যয়ের এই হিসাব-নিকাশ নি¤œ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জীবনে কি আদৌ প্রভাব পড়বে? এ নিয়ে রয়েছে নানা মতভেদ। চক্রাকারে ঘুরছে অর্থনীতির চাকা তবে বৈষম্যের কারণে সেই চাকায় পৃষ্ঠ হচ্ছে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজ। মুখ বুঝে নানা যাতনা সহ্য করা এসব মানুষের ব্যক্ত করার ভাষা নেই। তাদের জন্য এ বাজেট কতটা সুফল নিয়ে আসবে তা বুঝতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন। বৈশ্বয়িক এই মহামারীতে চাকরি হারিয়ে আজ অনেক পরিবার দিশেহারা। প্রতিবছর লাখ লাখ কর্মক্ষম মানুষ যোগ হচ্ছে আমাদের শ্রম বাজারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ এর হিসাব বলছে, দেশে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, দেশে শ্রমশক্তির মোট পরিমাণ ৫ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে কাজ করছে ৫ কোটি ৫১ লাখ ৮০ হাজার জন। এর অর্থ বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার। দরিদ্রতার কষাঘাতে জীবন যেন বিপন্ন না হয় তার জন্য প্রয়োজন বিপুল কর্মসংস্থান। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট শিল্পবান্ধব হওয়ায় ব্যবসার পরিধি বাড়বে ও বেকার শ্রমশক্তির কাজের সুযোগ হবে। তবে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বেকার ভাতা অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে গতানুগতিক বাজেট থেকে বেরিয়ে আসা সময়ের দাবি। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত মধ্যবিত্তদের রক্ষা না করলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার বাধাগ্রস্ত হবে। বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীভুক্ত প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশনের (আইএফসি) এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, কোভিড-১৯-এর কারণে দেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে (এমএসএমই) কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছেন। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২৫ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। বাজেটে গরিব মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তামূলক নানা কর্মসূচি থাকলেও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য তেমন কিছুই থাকে না। কিন্তু অর্থনীতিতে চাহিদা তৈরির নেপথ্যের এই কারিগরদের রক্ষা করা না গেলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সফল হবে না। মধ্যবিত্তরা সমাজকে টিকিয়ে রাখে। এই মাঝের স্তরটির অবক্ষয়ের অর্থ সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক এবং সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘যারা নিম্নমধ্যবিত্ত ছিলেন, তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছেন। এ মুহূর্তে তাদের অর্থ ও খাদ্য সহায়তা দরকার। নতুন করে যারা দরিদ্র হয়েছেন, বাজেটে তাদের জন্য বরাদ্দ থাকতে হবে। রাষ্ট্রের অবকাঠামো ও এডিপিতে বড় বড় আর্থিক খরচ হচ্ছে। ফলে আমাদের এই সময় মানুষের জীবন ও জীবিকা বাঁচানো সম্ভব নয়। তাই কিছু প্রকল্প সাময়িকভাবে বন্ধ রেখে অর্থ বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। তিনি আরও বলেছেন, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য তথা সম্পদের সুষম বণ্টন নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু এটি নিয়ে বাস্তব কোন ধরনের প্রতিফলন দেখা যায় না। নতুন বাজেট থেকেই প্রপার্টি ট্যাক্স নিয়ে একটি দিকনির্দেশনা দেয়া উচিত।’ অর্থনীতিবিদরা বৈষম্য কমানোর তাগিদ দিচ্ছেন। কেননা এক শ্রেণীর হাতে প্রচুর অর্থ আর এক শ্রেণী দারিদ্রসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। এই শ্রেণীকে রক্ষা করতে না পারলে চাহিদা তৈরি হবে না। চাহিদা না বাড়লে বাজার ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। আশার কথা হলো, দক্ষিণ এশিয়ায়, এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের করপোরেট করহার সবচেয়ে বেশি। ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে এই হার কমানোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন। অর্থমন্ত্রী পরপর দুই অর্থবছর কর্পোরেট হার কমালেন। এবারও গতবারের মত কমানো হলো আড়াই শতাংশ। এর ফলে দুই বছরে কর্পোরেট কর কমেছে ৫ শতাংশ। এতে ব্যবসায়ীরা বেশ খানিকটা ছাড় পাবেন। অর্থমন্ত্রী এবার স্থানীয় শিল্পকেও বড় হারে ভ্যাট ছাড় দিয়েছেন। গৃহস্থালি নানা ধরনের পণ্যের আমদানিনির্ভরতা কমাতে ভ্যাট ছাড়াও আগাম কর থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। নতুন নতুন কর-সুবিধা দেয়া হয়েছে দেশে উৎপাদিত মোবাইল ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে। তাই নতুন বাজেট প্রস্তাবে খুশি হবেন ব্যবসায়ীরা। করপোরেট করহার কমানো ও সুরক্ষা দেয়া হয়েছে স্থানীয় শিল্পকে। কমেছে ব্যবসায়িক টার্নওভার করহার। নানাভাবেই ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু বাজেটে নেই সাধারণ মানুষের জন্য বিশেষ কোন সুবিধা। তবে ব্যবসার পরিবেশ ভাল হলে এবং বিনিয়োগ বাড়লে পরোক্ষভাবে হলেও মধ্যবিত্ত শ্রেণী উপকৃত হবে। আমাদের জানা প্রয়োজন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত কারা? অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন, যারা নির্ধারিত আয়ের মানুষ, মাসিক বেতনের ভিত্তিতে কাজ করে, যাদের বেতনের বাইরে বাড়তি আয় নেই, উচ্চবিত্ত বাদ দিয়ে দারিদ্র্যসীমার ওপরে যাদের বসবাস, তারাই মধ্যবিত্ত; যার মাসিক আয় ৪০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা, সে-ই মধ্যবিত্ত। এটা বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৩০ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি। এর মধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ ভাগ আর উচ্চবিত্ত ২০ ভাগ। মাঝের যে ৬০ ভাগ এরা নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্ত। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর সাম্প্রতিক জরিপে বলা হচ্ছে, করোনায় এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে, দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে গেছে। তাই এখন দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা পাঁচ কোটির বেশি। পিপিআরসি এর নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘মধ্যবিত্তের একটা অংশ নতুন দরিদ্রদের মধ্যে ঢুকে গেছে। এমনও আমরা দেখেছি, শিক্ষক ছিল কিন্তু কাজ না পেয়ে অদক্ষ একটা কাজ করতে হচ্ছে।’ তিনি মনে করেন, তাদের জন্য মূলত খাদ্য বা ভাতা নয় প্রয়োজন নগদ অর্থ সহায়তা, ‘এককালীন একটা টাকা দেয়া গেলে তাদের জন্য সঙ্গত হতো। এরা অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে চায়। সেখানেও সহযোগিতা দরকার,’ বলেন এই অর্থনীতিবিদ। উল্লেখ্য, আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট হবে বাংলাদেশের ৫০তম বাজেট। অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালের তৃতীয় বাজেট এবং বর্তমান সরকারের টানা ১৩তম বাজেট। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেট যার আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। যা ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট থেকে ৩৫ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা বেশি। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) এর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ । মোট আয় ৩ লাখ ৯২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। ঘাটতি (অনুদানসহ) ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। এটি মোট জিডিপির ৬ দশমিক ১ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, নতুন বাজেট হবে করোনা মোকাবেলা করে এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ প্রত্যয়ের বাজেট। আগামী বাজেট হবে সাধারণ মানুষের বাজেট। দেশের মানুষ বাঁচানোর ও ব্যবসায়ী বাঁচানোর বাজেট। অর্থমন্ত্রী নতুন অর্থবছরের বাজেটের শিরোনাম দিয়েছেন, ‘জীবন-জীবিকার প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’। অর্থাৎ জীবন বাঁচাতে হবে, রক্ষা করতে হবে জীবিকাকেও।
×