ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইমন মাহমুদ

শখ থেকেই শুরু হলো ‘ঈধা’

প্রকাশিত: ২১:৪৫, ৩০ মে ২০২১

শখ থেকেই শুরু হলো ‘ঈধা’

প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রাও সহজ হচ্ছে দিন দিন। এখন চাইলে ঘরে বসেই বিশ্বকে হাতের মুঠোয় পাওয়া যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দেশব্যাপী সহজলভ্য হওয়ার পর থেকে বাড়ছে অনলাইন ব্যবসা। সেই সঙ্গে বাড়ছে ক্রেতাও। খাদ্যদ্রব্য, পোশাক, প্রসাধনী, স্পোর্টস, ওষুধ, সার্জিক্যাল আইটেমসহ এমন কিছুই নেই যা অনলাইনের মাধ্যমে কেনা যায় না। ঘরে বসেই কাক্সিক্ষত পণ্য কিনছেন গ্রাহকরা। সফল উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তরুণ-তরুণীসহ প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোও অনলাইন ব্যবসার দিকেই ঝুঁকছেন। অনলাইনে ব্যবসা করতে গেলে ব্যবসায়ীকে বড় শোরুম, গোডাউন এবং একাধিক বেতনভুক্ত কর্মচারী রাখার প্রয়োজন হয় না। পণ্য, কম্পিউটার বা স্মার্টফোন থাকলেই হয়। ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেজে পণ্যের ছবি ও পরিচিতি তুলে ধরার মাধ্যমে চলে পণ্যের প্রচারণা। বর্তমানে উদ্যোক্তারা মূলধনের চেয়ে নিজেদের প্রতিভা ও সে বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি নিজ শিক্ষাকে সামনে রেখে কৌশলেই নিজের স্বতন্ত্র পেশা তৈরি করছেন। অনেকেই সফল হচ্ছেন। করোনা মহামারীর এই দুর্যোগ পরিস্থিতিতে মানুষ যখন কাজ হারিয়ে বেকার, একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানের দুয়ার, তখন দেশজুড়ে তৈরি হচ্ছে এমন অসংখ্য আশার গল্প। করোনা মহামারী যখন অনেকের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করেছে, তখন কেউ কেউ আবার এটাকে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের সুযোগ হিসেবে লুফে নিচ্ছেন। করোনাকালীন সময়ে একাকীত্বের বিপরীতে অনেকে আবার ব্যবসাকে তাদের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। কেউ প্রয়োজনে আবার কেউ বা শখের বশেই তাদের কাজ করছেন। তবে অধিকাংশই তাদের ভাল লাগার কাজগুলো ভালবেসে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এমনই তিনজন শিক্ষার্থী মহিমা আখতার আদরিতা, ঐশ্বর্য আনোয়ার আরশি এবং নাইমা ইসলাম যারা শখের বশেই হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা এবং ভালবেসে মেধা ও শ্রম দিয়ে গড়ে তুলেছেন তাদের অনলাই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘ঈধা’। ঈধা মূলত যাবতীয় পোশাক সামগ্রী বিক্রয়কারী অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এখানে শাড়ি, কুর্তি, থ্রিপিচ, পাঞ্জাবি থেকে শুরু করে বাচ্চাদের পোশাকও পাওয়া যায়। পোশাকের বেশিরভাগ কাজই তারা করেন হাতে। আর বাকিটা কারগিরের সহায়তায়। এবং কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে সারাদেশে পণ্য পৌঁছে দেন গ্রাহকের কাছে। তারা তিনজনই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী। আদরিতা এবং আরশি পড়ছেন ইংরেজী বিভাগে। নাইমা পড়ছেন নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগে। শুরুটা কিভাবে হলো জানতে চাইলে আদরিতা বলেন, ‘আমি এবং আরশি ২০১৯ সাল থেকেই চিন্তাভাবনা করছিলাম কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু কি করবো সেটা ভেবে পাচ্ছিলাম না। পরে আর শুরু করা হলো না। করোনাকালে ঘরবন্দী এমন অবস্থা যে কিছু না করলেই না।’ এদিকে নাইমা এবং আদরিতার বন্ধুত্বটাও জমে উঠেছিলো মূলত শাড়ির আলাপের ভিতর দিয়েই। নাইমা এবং আদরিতা দুজনেরই শাড়ি পরতে অনেক ভাল লাগে। তাদের দু’জনের মধ্যে প্রায় সময়ই শাড়ি নিয়ে আলাপ হতো। নাইমা এবং আরশিকে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার কাজটা মূলত করেছেন আদরিতা। পেছনের গল্প টেনে আদরিতা বললেন, ‘নাইমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা অনেকটা শাড়ির সূত্রেই। আমরা দু’জন একবার নিজেদের জন্য শাড়ি বানাইতে চেয়েছিলাম। তখন শাড়ির ব্যাপারে অনেক খোঁজ খবর নিয়েছিলাম। তারপর থেকেই শাড়ি নিয়ে ব্যবসার চিন্তাটা মাথায় আসে।’ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নাইমা ইসলাম বলেন, ‘ওইসময় নিজের জন্য একটা শাড়ি ডিজাইন করতে গিয়ে আশপাশে অনেক জায়গায় অনেক খোঁজ নিতে হয়েছিল। সেখানেই একজন উদ্যোক্তা হঠাৎ করে আমার কাজের প্রশংসা করে বসে এবং তার সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দেয়। তখন থেকেই শুরু। তার সঙ্গে কাজ করা হয়ে ওঠেনি, কিন্তু ঈধার কাঁচামাল, কারিগর খোঁজে তিনি সাহায্য করেছেন আমাদের।’ এভাবে তিনজনের মধ্যে তৈরি হলো মেলবন্ধন। তিনজন একত্রিত হলেও কিভাবে কি শুরু করবেন এসব চিন্তা করতে করতেই সময় গড়িয়ে চলছিল। পরে তিনজন মিলে নিলেন কঠিন সিদ্ধান্ত। কোন কিছুর অপেক্ষায় আর বসে থাকা নয়, শুরু করে দিবেন। করলেনও তাই। এভাবেই গত বছরের ১৯ আগস্ট যাত্রা শুরু করল নাইমা, আদরিতা এবং আরশির স্বপ্নের ‘ঈধা’। মোট সাড়ে সাত হাজার টাকা দিয়ে যাত্রা শুরু হয় ঈধার। প্রথম বর্ষে ভাল রেজাল্টের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেধাবৃত্তি পান আদরিতা। প্রথম বর্ষের বৃত্তির আড়াই হাজার টাকা তিনি বিনিয়োগ করেন তাদের ব্যবসায়। একইভাবে নাঈমা তার জমানো টাকা এবং আরশির টিউশনির টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকা করে বিনিয়োগ করেন। প্রথম বিনিয়োগের টাকা দিয়ে তারা কেনেন তিনটা শাড়ি ও কুর্তির কাপড় এবং বাকি টাকা দিয়ে ঈধার জন্য ব্যাগ তৈরি করেন। তাদের পণ্যের ডিজাইন থেকে শুরু করে ছোটখাটো হাতের কাজগুলো মূলত তারাই করে থাকেন। টাঙ্গাইল বা ইসলামপুর থেকে কাঁচামাল কিনে সেগুলোতে আবার নিজদের পছন্দসই ডিজাইন করে পোশাকগুলোকে নতুনরূপে সাজিয়ে তোলেন তারা। কারিগরের কাছে তারা ডিজাইনটা বুঝিয়ে দিলে তারা ডিজাইন অনুযায়ী কাপড় প্রিন্ট করে দেন। তারা তিনজনই ডিজাইনের কাজ করেন। এ ছাড়া হাতের কিছু কাজ থাকে যেমন সেলাই, এ্যাম্ব্রয়ডারিসহ আরও ছোট ছোট কাজগুলোও তারা নিজেরাই করেন। কাজ শুরু করার পর নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত আদরিতা বললেন, নতুন পেজ হিসেবে আমাদের পেজের রিচ বেশ ভাল। আমরা আশা করিনি যে এত অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের পেজটাতে এত বেশি লাইক পড়বে। আমাদের বিক্রিও বেশ ভাল, সন্তোষজনক। প্রথমদিকে পরিচিতদের মধ্যে তুলনামূলক বেশি বিক্রি হলেও আস্তে আস্তে বাইরের ক্রেতারাও আগ্রহ প্রকাশ করছে। শুরু থেকেই অপিরিচতদের মধ্যে বিক্রি হতো। তবে আনুপাতিকহারে একটু কম হতো। তবে এখন বেশ ভাল বিক্রি হয়।’ ‘ঈধার বিশেষত্ব হলো আমরা কারিগরদের ওপর নির্ভরতার চেয়েও নিজেরাই বেশি করতে চেষ্টা করি। প্রত্যেকটা পণ্যের প্রতি আমার ইমোশনটা বেশি থাকে। আমরা এমনভাবে কাজ করার চেষ্টা করি যেন আমাদের প্রতিটা ক্ষুদ্র ক্ষদ্র জিনিসই মানুষের পছন্দ হয়। নিজের হাতে কাজ করার কারণে পণ্যের প্রতি আলাদা ভালবাসা কাজ করে,’ যোগ করলেন তিনি। আরশির কাছে তাদের ব্যবসাটা অনেকটা স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার মতো উদ্যোগ। ‘ঈধাকে ঘিরে আমাদের তিন জনের পরিকল্পনার শেষ নেই। আমাদের স্বপ্নকে কেবল দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে নয়, আন্তর্জাতিক দরজায় পৌঁছে দেওয়ার আকাক্সক্ষা। মানুষ যেন আমাদের পণ্যগুলো আমাদের মতোই আপন করে নেয় বিশ্বাসের সঙ্গে,’ তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ে তার স্বপ্নের কথা জানচ্ছিলেন তিনি। আরশির মতো নাইমাও ঈধাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন। আর আদরিতার স্বপ্ন, ঈধা ভবিষ্যতে আরও বড় হবে, এত বড় হবে যেন তারা ভবিষ্যতে একটা শোরুম দিতে পারেন।
×