ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

টিকা দেয়ার পরই খুলুক বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ২১:২৪, ৩০ মে ২০২১

টিকা দেয়ার পরই খুলুক বিশ্ববিদ্যালয়

করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকা সাপেক্ষে ১৩ জুন থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সব স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি। তবে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের টিকা না দেয়া পর্যন্ত বিশ^বিদ্যালয় না খোলার কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। শিক্ষামন্ত্রী ঘোষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানোর ওই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে ওইদিনই (২৬ মে) ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী’ ব্যানারে কিছু শিক্ষার্থী সংবাদ সম্মেলন করেন। তারা ছুটি বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বর্ধিত করার পেছনে শিক্ষামন্ত্রী করোনা পরিস্থিতি ও টিকার অপর্যাপ্ততাকে দায়ী করেছেন। অথচ করোনা পরিস্থিতিতে কলকারখানা, অফিস, শিল্প প্রতিষ্ঠান; এমনকি গণপরিবহন কোন কিছুই থেমে থাকেনি। এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ আছে কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অপরদিকে টিকা নিয়ে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, তার জন্য দায়ী স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের কিছু নীতিনির্ধারক ও তাদের করপোরেট প্রতিষ্ঠান। গত বছর মার্চে করোনা সংক্রমণে মৃত্যুর ঘটনায় কঠোর লকডাউনের পর ধীরে ধীরে জীবন ও জীবিকার কথা ভেবে সরকার একে একে অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানা, শপিংমল ও গণপরিবহন খুলে দিতে থাকে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে পুনরায় সংক্রমণ উর্ধগামী হলে আবার লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। যদিও সেটা আর আগের মতো কঠোর থাকেনি, ঢিলেঢালাভাবেই চলেছে। মূলত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের জীবিকার কথা ভেবেই সরকার ওই সিদ্ধান্ত নেয়। গত বছর লকডাউন শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত বহু প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মস্থল থেকে কর্মী ছাঁটাই করেছে। আবার যাদের চাকরি সৌভাগ্যক্রমে রয়ে গেছে তাদের অনেকেরই বেতন অর্ধেক করে দেয়া হয়েছে। উৎপাদন বন্ধ থাকলে আয় বন্ধ থাকে। আয় বন্ধ থাকলে বেতন-ভাতাও বন্ধ থাকতে বাধ্য। সুতরাং অনেক কিছু ভেবেই সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। অফিস, কল-কারখানা চালু রাখতে হয়েছে। অফিস, শিল্প-কারখানায় যারা কাজ করেন কিংবা দিনমজুর হিসেবে দিন এনে দিন খান তাদের জন্য সরকার কর্তৃক জারিকৃত নিয়মের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যার যার মতো করে বাঁচা! নিয়মগুলো মানা তাদের জন্য যতটা সহজ, ঠিক তাদেরই স্কুল-কলেজপড়–য়া কোমলমতি শিশু কিংবা কিশোর-তরুণদের পক্ষে ততই দুরূহ। এই কথাই কয়েক মাস আগে স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ক্লাস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে কোন শিশু যদি করোনাক্রান্ত হয় তার দায়-দায়িত্ব কে নেবে? কিছুদিন আগে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে খুলে দেয়া হয়েছে হোটেল-রেস্তরাঁ। দূরপাল্লার বাস, লঞ্চ এবং ট্রেনও চলছে। এখন খোলার অপেক্ষায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দেশে করোনার সংক্রমণ ধরা পড়ার পর গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয় সব প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। চলতি বছর মার্চে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে কয়েক দফা ছুটি বাড়িয়ে ২৯ মে পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই সঙ্গে মেডিক্যাল শিক্ষাও বন্ধ রাখা হয়। উদ্ভূত ওই পরিস্থিতিতে চরম ক্ষতির শিকার হয় প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থী ও ৫০ লাখ শিক্ষক। এমন অবস্থায় ব্যাপক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কার পাশাপাশি বেড়ে যায় বাল্যবিয়েও। শহুরে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা ঘরে বন্দী হয়ে থাকায় দেখা দিয়েছে মানসিক সমস্যা। গবেষণায় দেখা গেছে, মহামারীতে মানসিক চাপে রয়েছে শহরের ১৫.৭ এবং গ্রামের ৮.৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ৫ শতাংশের নিচে এলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সীমিত আকারে খুলে দিয়ে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার জন্য তৈরি সংক্ষিপ্ত সিলেবাস শুরু করা হবে। করোনা সংক্রমণ এখনও ৮ শতাংশের ওপরে রয়েছে। তারপরও শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়ার কথা ভাবছে। তবে শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকা সাপেক্ষে।’ পরিকল্পনা অনুযায়ী সরকার মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়ে কলেজ খুলে দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে আগে থেকেই। দেশে আবারও করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেলে যেন শিক্ষার্থীদের হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের সেবার কাজে লাগানো যায়, সেই উদ্দেশ্যেই ওই সিদ্ধান্ত নেয়া। পরিকল্পনা মতো ইতোমধ্যে সরকারী মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের চীন থেকে আসা টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, চীনের উপহারের টিকা থেকে দেড় লাখ টিকা দেয়া হবে সরকারী মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের। এছাড়া আগে বাদ পড়া স্বাস্থ্যকর্মী ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও এখান থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা পাবেন। এক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, গত বছর এপ্রিল থেকে করোনা আতঙ্কের জেরে বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ পাঠ মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেছে। অথবা কোন না কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। আর্থিক অনটনের কারণে অনেক শিক্ষার্থীকেই উচ্চ শিক্ষার পাঠ মাঝপথেই ছাড়তে হতে পারে বলে ওই সমীক্ষায় ধারণা করা হয়। সমীক্ষাটির দাবি, ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বের নি¤œ ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে সামগ্রিকভাবে শিক্ষাখাতে প্রায় ৫ লাখ ৮১ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি দেখা দিতে পারে, যার সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে শিশু শিক্ষার ওপর। এতে বলা হয়, অনেক পড়ুয়া পারিবারিক আকস্মিক আর্থিক সঙ্কট সামাল দিতে পড়াশোনা ছেড়ে উপার্জনের চেষ্টা শুরু করবে। অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দেয়ার প্রবণতা বাড়তে পারে পরিবারগুলোতে। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আগের তুলনায় বেশিসংখ্যক শিশু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে বলে সিঙ্গাপুরে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সশরীরে পাঠদান কর্মসূচী বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দ্রুততম সময়ে শিশুদের করোনা প্রতিরোধী টিকা দিতে আরও বেশি উদ্যোগী হয়েছে সিঙ্গাপুর সরকার। ইউরোপে স্কুল খোলার পর করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আবার স্কুল বন্ধ করতে হয়েছে। তবে সংক্রমণের এই বৃদ্ধি যে শুধু স্কুল খোলার কারণে হয়েছে তা নয়। অন্য কারণও বিদ্যমান ছিল। ইতোমধ্যে করোনার ভারতীয় ধরন বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছে। এটি অতি দ্রুত বিস্তার ঘটায় এবং তীব্র সংক্রামক। ভারতে করোনার ইউকে ভ্যারিয়েন্ট ও ডাবল মিউটেশন ভ্যারিয়েন্ট (ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট) একযোগে সংক্রমিত করেছে। এ কারণে শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবকসহ সব বয়সী মানুষ মারাত্মকভাবে সংক্রমিত হচ্ছে। যার ভয়াবহ চিত্র আমরা প্রতিদিনই জানতে পারছি। এরই মধ্যে দেশের সীমান্তবর্তী ১৫ জেলায় করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। বিষয়টি আবারও ভাবিয়ে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের। স্কুল-কলেজের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার একটি পার্থক্য রয়েছে। স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের বিরাট অংশ বাড়িতে থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসা করে থাকে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিকভাবে থেকেই শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে শিক্ষার্থীরা কিভাবে কষ্টের মধ্যে গাদাগাদি করে থাকেন, সেটি প্রায় সবাই অবগত। সেই বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের টিকা নিশ্চিত না করে হলগুলো খুলে দেয়া হলে তা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। যেটি সরকার করতে চায় না। আবার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের ছাত্রজীবন ও চাকরি জীবনে যে দুর্দশার সৃষ্টি হয়েছে সেটি সরকারকে গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছাত্র বা ছাত্রীটি টিউশনি করে নিজের খরচ জোগাতেন কিংবা পার্টটাইম অন্যকিছু করে উপার্জন করতেন তার সবই বন্ধ হয়ে গেছে করোনার থাবায়। এমন নানা সঙ্গত কারণেই তারা হতাশ, ক্ষুব্ধ। এদিকে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের আর্থিক প্রণোদনার বিষয়টি সরকার বিবেচনা করতে পারে। আপৎকালীন এমন সহায়তা তাদের কিছুটা হলেও উপকারে আসবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের করোনা টিকার আওতায় আনার জন্য নিবন্ধন শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন দ্রুতই তাদের টিকার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলার সব বাধা দূর হবে। বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার জন্য আন্দোলনের দিকে যেতে চাচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের একটি অংশ। যা অনভিপ্রেত। তাদের মনে রাখা উচিত, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট দূর হয়েছিল। সুতরাং শিক্ষা বিষয়ে বিশ্বজুড়ে সৃষ্ট যে সমস্যা বাংলাদেশও অচিরে সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠবে এমন প্রত্যাশা রাখি। লেখক : সাংবাদিক
×