ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রাম বে-টার্মিনাল হবে আগামীর বন্দর

প্রকাশিত: ২৩:৫০, ২৭ মে ২০২১

চট্টগ্রাম বে-টার্মিনাল হবে আগামীর বন্দর

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ দেশের আমদানি-রফতানি, শিল্পায়ন ও অর্থনীতির কলেবর যেভাবে বাড়ছে তাতে করে ২০৪০ সালের মধ্যে বার্ষিক অন্তত ১০ মিলিয়ন কন্টেনার হ্যান্ডলিং করতে হবে। এরমধ্যে অন্তত ৫ মিলিয়ন কন্টেনার হ্যান্ডলিং করার টার্গেট চট্টগ্রাম বন্দরের। সে লক্ষ্য নিয়ে বিদ্যমান বন্দরের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি নির্মাণ করা হচ্ছে বে-টার্মিনাল। সাগরপাড়ের সাড়ে ৬ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই টার্মিনালকে বলা হচ্ছে আগামীর বন্দর। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে চূড়ান্ত সম্মতি আসার পর ২০২৪ সালের মধ্যে টার্মিনালটির একাংশের কাজ শেষ করে অপারেশনে যেতে চায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার নির্মাণে সহায়তা দিতে সম্মতি দিয়েছে বিশ^ব্যাংক। চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনালের পরিকল্পনা প্রায় একদশক আগের। ভূমি অধিগ্রহণসহ নানা কারণে দীর্ঘসূত্রতায় পড়েছিল প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ। কিন্তু এখন সকল প্রতিবন্ধকতা অপসারিত হয়েছে। টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার (ঢেউ নিয়ন্ত্রণ) কাজের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে রাজি হয়েছে বিশ^ব্যাংক। বে-টার্মিনালে থাকবে মোট ৩টি টার্মিনাল, যারমধ্যে একটি নির্মাণ করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বাকি দুটির কাজ হবে কোন বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) ভিত্তিতে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মোঃ জাফর আলম জনকণ্ঠকে জানান, বর্তমানে বন্দর ৩ মিলিয়ন বা ৩০ লাখ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করছে। শিল্পায়ন এবং আমদানি-রফতানি যেভাবে বাড়ছে তাতে করে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ১০ মিলিয়ন কন্টেনার হ্যান্ডলিং করতে হবে। এরমধ্যে কমপক্ষে অর্ধেক কন্টেনার অর্থাৎ ৫০ লাখ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করবে চট্টগ্রাম বন্দর। সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার বে-টার্মিনাল নির্মাণে হাত দিয়েছে। তিনি জানান, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টের পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে বে-টার্মিনাল নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। তবে তিনটির মধ্যে যে একটি টার্মিনাল বন্দর করবে, যাতে ২০২৪ সালের মধ্যে জাহাজ ভেড়াবার টার্গেট রয়েছে। চট্টগ্রাম ইপিজেড থেকে দক্ষিণ কাট্টলী রাশমনির ঘাট পর্যন্ত সাগরপাড়ে সাড়ে ৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ২ হাজার ৩শ’ একর এলাকাজুড়ে হবে বে-টার্মিনাল। এতে একটি টার্মিনাল চট্টগ্রাম বন্দরই বাস্তবায়ন করবে। বাকি দুটির জন্য সিঙ্গাপুর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠান আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। ওই দুই প্রতিষ্ঠানকে পৃথকভাবে টেকনিক্যাল ও ফিন্যান্সিয়াল প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে। যেহেতু দেশের অর্থনীতির কলেবর বাড়ার কারণে চাহিদা বাড়ছে, সেহেতু এক্ষেত্রে বিলম্ব করার অবকাশ নেই। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, বে-টার্মিনালের তিনটি টার্মিনালই হবে সমান আয়তনের। এরমধ্যে দক্ষিণ পাশের টার্মিনালটি আগে নির্মিত হবে, যা বাস্তবায়ন করবে চট্টগ্রাম বন্দর। প্রতিটি টার্মিনালে চারটি করে জেটি হবে। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে টার্মিনালের জন্য ৬৮ একর জায়গা পায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরপর পর্যায়ক্রমে মিলছে বাকি ভূমি। এখন যে পর্যায়ে তাতে আর প্রকল্প বাস্তবায়নে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা নেই। আগামীর বন্দর বে-টার্মিনাল ॥ দেশের আমদানি রফতানির ৯২ ভাগ পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। বিদ্যমান সক্ষমতা দিয়ে ৩০ লাখ কন্টেনার হ্যান্ডলিং করছে চট্টগ্রাম বন্দর । কিন্তু ভবিষ্যতের যে চিত্র ভেসে উঠছে তাতে করে এ বন্দরের পক্ষে এককভাবে পুরোদেশকে সেবা দেয়া সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে উৎকন্ঠা বেশ ক’বছর ধরে। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে জোর দাবি ছিল বে-টার্মিনাল নির্মাণ কাজ আরও আগেই শেষ করার। অবশেষে সকল প্রতিকূলতা কাটিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ এ মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান ফ্যাসিলিটিতে একসঙ্গে ১৬টি জাহাজ ভিড়তে পারে। বে টার্মিনালে ভিড়তে পারবে প্রায় ৫০টি জাহাজ। সাগর থেকে প্রায় পনেরো কিলোমিটার ভেতরের বন্দর জেটিতে বড় জাহাজ ভিড়তে পারে না। কিন্তু বে-টার্মিনালে যে কোন আকারের জাহাজ ভিড়তে পারবে। এখন বন্দরে ভিড়তে পারে সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের (গভীরতা) জাহাজ। কিন্তু বে-টার্মিনালে ১২ মিটার ড্রাফট পাওয়া যাবে। ফলে বড় জাহাজ ভিড়তে কোন অসুবিধা হবে না। তাছাড়া বিদ্যমান বন্দরে যেখানে জাহাজ ভেড়াতে জোয়ার ভাটার দিকে খেয়াল রাখতে হয় সেখানে বে-টার্মিনালে জোয়ার-ভাটানির্ভর হবে না। কারণ, সাগর থেকে শূন্য কিলোমিটারের মধ্যেই হতে যাচ্ছে টার্মিনালের অবস্থান। বে-টার্মিনাল হলে শুধুমাত্র সেখানেই বর্তমান বন্দরের দ্বিগুণ পণ্য হ্যান্ডলিং করা যাবে। ব্যবসায়ীদের অন্যতম শীর্ষ সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, বে-টার্মিনাল বাংলাদেশের অর্থনীতির চাহিদা। কেননা, আমদানি-রফতানি যেভাবে বাড়ছে তাতে করে বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতেই হবে। তিনি বলেন, আমাদের দাবি ছিল ২০২১ সালের মধ্যে বে-টার্মিনাল নির্মাণ করার। এখন বন্দর কর্তৃপক্ষের টার্গেট ২০২৪ সালের মধ্যে। এটি যেন আবার ২০২৭ সাল পর্যন্ত না গড়ায়। বে-টার্মিনালের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করত গিয়ে চেম্বার সভাপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্য রফতানি আয় ৬০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা। যদি এ পরিমাণ রফতানি করতে হয় তাহলে বন্দর সম্প্রসারণের বিকল্প নেই। এখন আমরা চাই, নতুন করে যে টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে সে সময়ের মধ্যে হলেও অন্তত সেখানকার তিনটির মধ্যে একটির কাজ শেষ হোক। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) অর্জনের যে লক্ষ্য, তারজন্যও বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে ধীরগতির সুযোগ নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন।
×