ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. খুরশিদ আলম

উন্নয়ন বাজেট বনাম বাজেটের উন্নয়ন

প্রকাশিত: ২০:৫৭, ২৫ মে ২০২১

উন্নয়ন বাজেট বনাম বাজেটের উন্নয়ন

দীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মের সঙ্গে জড়িত থেকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে উন্নয়নকে বিভিন্নভাবে বোঝার চেষ্টা করেছি। কয়েকদিন আগে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য উন্নয়ন বাজেট তৈরি করা হয়েছে। যখন উন্নয়ন বাজেট তৈরি করা হয় তখন মনে নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে। যেমন, উন্নয়ন বাজেটে যে প্রকল্পগুলো ধরা হয়েছে সেগুলো দেশের সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে করা হয়েছে কিনা? এই উন্নয়ন বাজেটের মান আরও উন্নত করার সুযোগ আছে কিনা? উন্নয়ন বাজেটে কি কেবল আমলাদের মতামত প্রতিফলিত হয়েছে, নাকি রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় রয়েছে? উন্নয়ন বাজেট কেবল কোন অর্থনৈতিক দলিল নয়, বরং একটি রাজনৈতিক দলিল, যেখানে রাজনৈতিক নেতারা আগামী দিনে দেশটাকে কোথায় নিয়ে যেতে যান তার একটি চিত্র ফুটে ওঠে। সুতরাং দেশের উন্নয়ন বাজেট আর কোথায় উন্নত করার সুযোগ আছে এখানে তা নিয়ে আলোচনা করা হলো। আগামী অর্থবছরের জন্য মোট দুই লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট অনুমোদন দেয়া হয়েছে, যার আওতায় মোট ১ হাজার ৪২৬টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত; বিদ্যুত ও জ্বালানি খাত; গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধাবলী খাত; শিল্প খাত; স্বাস্থ্য খাত; স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাত; পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও পানি খাত; কৃষি খাত; শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাত এবং বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত উল্লেখযোগ্য। বলা হয়েছে যে, এডিপিতে দারিদ্র্য বিমোচন, প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ, কর্মসংস্থান সৃজন এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রভৃতিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রথম দেখা যাক দরিদ্র মানুষের জন্য কি উন্নয়ন পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে করোনার কারণে এ বছর আবার নতুন করে অনেক মানুষ বিপাকে পড়েছে। কারণ খাদ্য মজুদ থাকলেই তো হবে না, তার জন্য অবশ্যই তাদের ক্রয় ক্ষমতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, রেমিটেন্স, দেশজ উৎপাদন, সেবা খাত ইত্যাদির মাধ্যমে দরিদ্র মানুষগুলোর জন্য আয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। করোনার কারণে সেবাখাত দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে বিশাল জনগোষ্ঠীর আয় কমে গেছে (৭৪%) তার সমাধান করা সম্ভব হবে কিনা। তবে একটি ভাল উদ্যোগ হতে পারে যে, যারা যখনই কোন খাদ্য সঙ্কটে পড়বে তাদের তাৎক্ষণিকভাবে খাদ্য সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা রাখা। যার চেষ্টা কিছুটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তবে তার জন্য একটি চাহিদা এবং সরবরাহ পর্যালোচনা করা যেতে পারে। আর এর জন্য অগ্রিম প্রস্তুতি হিসেবে দেশের ফুড সিকিউরিটি ম্যাপ তৈরি করা দরকার এবং সেভাবে একটি প্রস্তুতি নেয়া দরকার। কর্মসংস্থান করার জন্য বিশেষ করে আমার উদ্ভাবিত আইজিএ ম্যাপ পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৫০ লাখ মানুষ বা ১১ লাখ পরিবার গৃহহীন। আর এ ধরনের গৃহহীনতা নদীভাঙ্গনসহ বিভিন্ন কারণে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সরকার বিষয়টিকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং তার সমাধানের বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বাসস্থানের ক্ষেত্রে সরকার ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন গৃহহীনদের আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। এ কর্মসূচীটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনেক কারণে। যেমন- এর ফলে এসব পরিবারের অনেকে শহরের বস্তি এলাকাতে ঠাঁই নিত। বস্তিতে থাকলে শহরের নাগরিক সুবিধার চাহিদার ওপর চাপ বাড়ত। বস্তিতে থেকে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হতো। শুধু তাই নয়, তাদের পরিবারের কোন কোন সদস্য বিভিন্ন সমাজবিরোধী চক্রের হাতে পড়ে অপরাধ জগতে পা বাড়াত। তবে সুবিধা একটা হতো, আর তা হচ্ছে শিল্প বা গৃহস্থালি কাজের জন্য সস্তা শ্রমের যোগান হতো। বর্তমান উন্নয়ন পরিকল্পনায় এটি চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে বলা যায়। শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ করে নিরক্ষতা দূরীকরণের ক্ষেত্রে কোন সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী আছে কিনা। এখনও আমরা (৭৫%), এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত শ্রীলঙ্কা (৯২%) এবং মালদ্বীপ (৯৮%) থেকে পিছিয়ে আছি। বাংলাদেশ কখনও শিক্ষার ক্ষেত্রে শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনের চেষ্টা করেনি। এক সময় ব্যাপকভাবে বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম চালু ছিল। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে যে, বয়স্ক শিক্ষা সরাসরি তাদের আয় বৃদ্ধিতে কোন কাজে আসে না। আবার দেখা যায় এটি যদি দীর্ঘদিন চর্চা করা না হয় তাহলে তার সাক্ষরতা জ্ঞান কমে আসে বা নিঃশেষ হয়ে যায়। তাই বর্তমানে বয়স্ক শিক্ষার চেয়ে ছোটদের শিক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, সাক্ষরতা স্বাস্থ্য খাতে বেশ কাজে লাগে। এটি সারাজীবন শিক্ষা ও দক্ষতা লাভের দ্বার উন্মুক্ত করে। নিরক্ষতার জন্য প্রতি বছর বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর দেড় লাখ কোটি ডলার ক্ষতি হয়, অর্থাৎ সাক্ষরতা পক্ষান্তরে দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর। এছাড়া প্রতি ১০% মেয়ের পড়াশোনা জিডিপিতে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটায়। সাক্ষরতা গণতন্ত্র এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায়ও ভূমিকা রাখে। এটি মানুষের মধ্যে আত্মমর্যাদা সৃষ্টি এবং জীবনমান উন্নত করে। তাহলে শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনে কালবিলম্ব না করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এখনও আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনায় তা স্থান পায়নি। চিকিৎসার ক্ষেত্রে বেহাল অবস্থা এখন প্রতিদিনকার খবর। করোনা এ বিষয়টিকে আরও প্রকট করে দিয়েছে। এজন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে ওঠা দরকার তা এখনও গড়ে ওঠেনি। সরকার এক সময় বিদ্যুত খাতে এ ধরনের বেহাল অবস্থা সামাল দিতে পেরেছে। বলা চলে এখন বিদ্যুত উৎপাদনের সক্ষমতা অনেকটা অব্যবহৃত রয়ে গেছে। এখন সারা দেশের মানুষের একটি বড় চাওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতের বেহাল অবস্থা থেকে উত্তরণ। একদিকে চিকিৎসকরা করোনা সামলাতে গিয়ে প্রায় ২০০ চিকিৎসক প্রাণ দিয়েছে, অনেক স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেছেন, অনেক পুলিশ সদস্য মারা গেছেন, অন্যদিকে এখাতটি নিয়ে মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে গেছে। বর্তমানে শুধু স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ এবং স্বাস্থ্যসেবকের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য দাবি উঠছে। দেশে প্রতি দশ হাজার লোকের জন্য ৫.২৬ জন ডাক্তার রয়েছেন, নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব আরও তীব্র। প্রতিটি হাসপাতালে আয়ার সংখ্যা অনেক কম। সুতরাং এ খাতে শুধু বরাদ্দ বাড়ালে সমস্যার সমাধান হবে তা নয়। বর্তমান উন্নয়ন বাজেটে এ খাতে মোট ১৭ হাজার, ৩০৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট উন্নয়ন বাজেটের ৭.৬৮%। বর্তমান যে উন্নয়ন বাজেট ব্যবস্থা আছে তা কিসের ভিত্তিতে করা হয়? এর কি কোন লক্ষ্য আছে? এক কথায় উন্নয়ন বাজেটটি হচ্ছে সম্পূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পভিত্তিক। এখানে দুটি নীতিমালার একটি মিশ্রিত রূপ আমরা দেখতে পাই। একটি হচ্ছে বেসিক নিড্স্ এপ্রোচ এবং অপরটি হচ্ছে ম্যাক্রো গ্রোথ এপ্রোচ। কিন্তু এ বাজেটে এর কি কোন ভারসাম্য রক্ষা করা হচ্ছে বলে মনে হয়? তেমন কোন ব্যাখ্যা কোথাও দেয়া হয় না। অর্থাৎ বাজেটের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, বিভিন্ন সেক্টরে যেমন সড়ক বিভাগে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে তা করা হচ্ছে। এতে সড়ক উন্নয়ন করে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করা হচ্ছে, যার দুটি প্রভাব থাকবে- একটি হচ্ছে গ্রোথ ইফেক্ট এবং অপরটি হচ্ছে ডিস্ট্রিবিউশন ইফেক্ট। এখন এ দুটির মধ্যে কোন্টা আমরা কতখানি অর্জন করতে চাই তার কোন হিসাব সেখানে বের করা হয় না। তাই দরকার এ দুটির মধ্যে সর্বোচ্চ একটি ভারসাম্য রক্ষা করে তা করা এবং জাতির সামনে তা তুলে ধরা। তাহলে সকলে বুঝতে পারবে যে, দেশ কোন্দিকে যাচ্ছে, গরিবের কি সুবিধা হচ্ছে আর ধনীদের কি সুবিধা হচ্ছে। তবে কোন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যখন যাচাই করা হয় তখন তার একটি গ্রোথ ইফেক্ট বের করা হয়। কিন্তু সব সময় ডিস্ট্রিবিউশন ইফেক্ট বের করা হয় না। যেমন, গ্রামে গ্রামে টিউবওয়েল দেয়ার যে প্রকল্প তা থেকে কেবল কত শতাংশ লোক সুপেয় পানি পাবে তা বের করা হয় এবং কত শতাংশ লোক পানি বাহিত রোগ থেকে নিস্তার পাবে তা নির্ণয় করা হয়। কিন্তু তার ডিস্ট্রিবিউশন ইফেক্ট বের করা হয় না। আমাদের দেশের জন্য যেটি বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে প্রতিটি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি চাহিদাভিত্তিক বাজেট (নিডস বেইসড বাজেট) তৈরি করা। আর এটি করলে বর্তমানে যে অপচয় হচ্ছে তা রোধ করা যেত। এতে দুর্নীতিও রোধ হতো। বাংলাদেশে আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডে ১৯৯৩-৯৪ সালে তা চালু করে দেখিয়েছিলাম। তা এখনও কিছুটা চালু আছে। এটি যদি প্রতিটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে চালু করা হয় তাহলে একদিকে যেমন অপচয় রোধ করা যাবে, অন্যদিকে প্রতিটি প্রকল্পের সুফল অন্তত আরও ১৫-২০% বেড়ে যাবে। সরকারের যত দ্রুত সম্ভব এটি বাস্তবায়ন করা দরকার। বিষয়টি বিগত অর্থমন্ত্রী মহোদয়কে বলেছিলাম। তাকে প্রস্তাবটি দেয়ার পর তিনি বিস্তারিত কিছু জানার আগ্রহ না দেখিয়ে কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বললেন যে, ‘এগুলো সব ভোগাস, আমি যা করি সেটি হচ্ছে শ্রেষ্ঠ বাজেট’। তিনি এটাও জানেন না যে, বাংলাদেশে তার অধীনে থাকা কোন প্রতিষ্ঠান তা প্রয়োগ করেছে কিনা এবং তার কোন সুফল জনগণ পেয়েছে কিনা। আমাদের মনে হয় বিদেশীরা এ কারণে অতি সহজে আমাদের দেশের সরকারের নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রে এতটা নাক গলাতে পারে। কারণ, আমরা নিজেরা কিন্তু নিজেদের বদলাতে চাই না। আগের তুলনায় আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনার দক্ষতা যে অনেক বাড়ানো দরকার সে বিষয়ে কারও সন্দেহ থাকা উচিত নয়। যাই হোক, আমাদের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরির কাজ অনেক ক্ষেত্রে যথেষ্ট দক্ষ ব্যক্তিদের হাতে পড়ে না। বিগত দুটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তথা ৭ম এবং ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা যথেষ্ট দক্ষ ব্যক্তিদের দ্বারা তৈরি হয়নি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষজ্ঞ প্যানেল দ্বারা তৈরি করা হলে আরও ভাল মানের হতো বলে ধারণা করা যায়। উন্নয়ন পরিকল্পনার মান উন্নয়নে অনেক গবেষণা হওয়া দরকার এবং সে আলোকে পুরো উন্নয়ন পরিকল্পনাকে ঢেলে সাজানো দরকার। লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষক [email protected]
×