ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একজন পুলিশের জালে ধরা

চ্যাটগ্রুপ তৈরি করে ফের জঙ্গী সংগ্রহ করা হচ্ছে

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ১৯ মে ২০২১

চ্যাটগ্রুপ তৈরি করে ফের জঙ্গী সংগ্রহ করা হচ্ছে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ দেশে জঙ্গী সংগঠনগুলো আবারও সংগঠিত হয়ে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে এমন গোপন খবরের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা শুরু করেছে পুলিশ। ‘সায়েন্স প্রোজেক্ট’ নামে চ্যাট গ্রুপ তৈরি করে জঙ্গী সংগ্রহ করা হচ্ছে। অভিযানে গত এক সপ্তাহে ছয় জঙ্গী গ্রেফতারের ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার পুলিশের জালে ধরা পড়েছে আরও একজন। রাজধানীর মহাখালীতে গ্রেফতার হওয়া তাজুল ইসলাম নামে আনসার আল ইসলামের সদস্য। আটকের পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। রাজধানীর মহাখালীতে জঙ্গী গ্রেফতারের আগের দিন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উত্তর পাশে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ সাইনবোর্ড এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে রিমোটচালিত একটি শক্তিশালী তাজা বোমা। পুলিশকে টার্গেট করে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে বোমা হামলা চালানোর ছক কষেছিল জঙ্গী গোষ্ঠী। সাম্প্রতিক জঙ্গী তৎপরতার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় নিষিদ্ধ আনসার আল ইসলাম। জঙ্গী সংগঠনের সদস্যদের অনেকেই এখন আবার আফগানমুখী। দুই জঙ্গী আফগানিস্তানে পৌঁছে সেখানে অবস্থান করার তথ্য পাওয়া গেছে। এরপর দেশে আবারও জঙ্গী বিরোধী অভিযান শুরু করা হয়েছে। গত এক সপ্তাহে আটক ছয় জঙ্গীকে জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গী সংগঠনগুলো সংগঠিত হওয়া ও নাশকতার ছক সম্পর্কে ধারণা পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিটিসি)। এই সংস্থার দাবি, আফগানিস্তানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল চার জঙ্গী। এর মধ্যে দুই জঙ্গী ধরা পড়ার পর জবানবন্দী দিয়েছে। তাদের দেয়া জবানবন্দী অনুযায়ী তাদের দুই সহযোগী জঙ্গী এখন আফগানিস্তানে পৌঁছে অবস্থান করছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ বলছে, নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলামের সন্দেহভাজন চার সদস্য আফগানিস্তানে যাওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছিল। গ্রেফতার চারজন হলেন- রাজধানীর অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র জসিমুল ইসলাম জ্যাক, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ থানার মারকাজুস সুন্নাহ আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক আব্দুল মুকিত, সিলেটের আল হিদায়া ইসলামিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র আমিনুল হক এবং সুনামগঞ্জ সরকারী কলেজের অনার্সের শিক্ষার্থী সজীব ইখতিয়ার। জানা গেছে, সিলেটে একটি মাদ্রাসার ছাত্র রাজ্জাক নিখোঁজ হলে তার সন্ধান চেয়ে ভাই সালমান খান ২৫ মার্চ সিলেটের কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন। সে পড়াশোনার পাশাপাশি গাড়ি চালাত। আর রবিউল নামে নোয়াখালীর এক তরুণও আফগানিস্তানে পাড়ি জমাতে বাড়ি ছেড়েছেন বলে জানালেও তার অবস্থান নিয়ে নিশ্চিত নয় পুলিশ। ওই দলের চারজনকে গত শনিবার গ্রেফতার করা হয়েছে, তারাও আফগানিস্তানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের ভাষ্য। চারজনের কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো যাচাই করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে এই তরুণরা বলেছেন, তাদের সহযোগীরা আফগানিস্তানে গেছেন চট্টগ্রাম হয়ে। আর সিলেট থেকে আব্দুল্লাহ নামের এক ব্যক্তি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সবার পাসপোর্ট প্রস্তুত করতে বলেছেন। গ্রেফতার সজীব ইখতিয়ারের বরাত দিয়ে তদন্তকারীরা বলছেন, তার বন্ধু রাজ্জাক ঈদের আগেই তাকে আফগানিস্তানে নেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করছিলেন। সিলেটের আব্দুল্লাহও তাকে চাপ দিচ্ছিলেন। তদন্তকারী সংস্থা সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলাম সংগঠিত হয়ে তৎপরতা চালানোর খবর পেয়ে অভিযান শুরু করা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর মহাখালী ডিওএইচএস এলাকা থেকে মোঃ তাজুল ইসলাম (৪৩) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের এ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। গ্রেফতার ব্যক্তি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সক্রিয় সদস্য বলে জানিয়েছে পুলিশ। গত ২৭ জানুয়ারি এন্টি টেররিজম ইউনিট অভিযান চালিয়ে চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলা থেকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের এক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সে সহযোগীদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয় পুলিশকে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে মহাখালী ডিওএইচএস এলাকা থেকে তাজুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয় বলে তদন্তকারী সংস্থার কর্মকর্তার দাবি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এর আগের দিন গত সোমবার নারায়ণগঞ্জে রিমোটচালিত একটি শক্তিশালী তাজা বোমা পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছে। সোমবার বিকেল চারটায় উদ্ধারের পর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বোমাটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিষ্ক্রিয় করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের বোমা বিশেষজ্ঞ দল। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উত্তর পাশে ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে বোমাটি উদ্ধার হয়। পুলিশ জানায়, বোমাটি সাদা রঙের একটি বাজারে ব্যাগের ভেতরে পলিথিন ও লাল স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় পড়ে ছিল। প্রায় আট ইঞ্চি দৈর্ঘ্যরে এই বোমাটি তৈরা করা হয়েছে লাইটারে গ্যাস রিফিল করার কাজে ব্যবহৃত ছোট আকারে স্প্রে সিলিন্ডার দিয়ে। সোমবার বিকেল চারটায় পুলিশ বক্সে ডিউটিরত জেলা ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট আসিফ হোসেন গেটের সামনে সাদা রঙের একটি বাজারের ব্যাগ পড়ে থাকতে দেখেন। যার ভেতরে বোমাসদৃশ্য বস্তু দেখে অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এসময় সার্জেন্ট আসিফ হোসেন তার সহকর্মী সাত আটজন পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে পুলিশ বক্স থেকে বাইরে বের হয়ে নিরাপদ স্থানে সরে যান। পরে তিনি বিষয়টি জেলা পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের জানালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। এ সময় জেলা পুলিশ ও র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা ঘটনাস্থল ঘিরে রাখেন। মহাসড়কের একপাশে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়ে আশপাশের লোকজনকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে দেয়া হয়। এরপর রোবটের মাধ্যমে নিখুঁতভাবে ব্যাগের ভেতর থেকে পলিথিনে মোড়ানো বস্তুটি বের করে আনা হলে বোমা বিশেষজ্ঞ দল বিভিন্ন ডিভাইস দিয়ে পরীক্ষা করে বোমা বলে নিশ্চিত হন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ঘটনাস্থলেই বিকট শব্দে বোমাটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিষ্ক্রিয় করা হয়। তদন্তকারী সংস্থা সিটিটিসির কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ‘সায়েন্স প্রোজেক্ট’ গ্রুপটি গত বছরের আগস্টে তৈরি করা হলেও গ্রেফতার চারজনের মধ্যে পরিচয় দুই বছরের বেশি সময় ধরে। গত দুই মাসের মধ্যে তাদের ‘আফগানযাত্রার প্রক্রিয়া’ শুরু হয়। আশির দশকে যেভাবে বাংলাদেশ থেকে কিছু লোক সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধের ‘মুজাহিদ হতে’ আফগানিস্তানে গিয়ে জঙ্গী হয়ে ফিরেছিল, চার দশক পর তেমনিভাবে আবার সেখানে যেতে তরুণদের ‘উসকানো’ হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের তিন তরুণ আফগানিস্তানে ‘হিজরত’ করতে বাড়ি ছেড়েছেন। তাদের মধ্যে দুজনের সেখানে পৌঁছানোর বিষয়েও তারা নিশ্চিত হয়েছেন। এদের মধ্যে কুমিল্লার তরুণ আব্দুর রাজ্জাক ও সিলেটের শিব্বির আহমেদ আফগানিস্তানে পৌঁছেছে বলে পুলিশের কাছে খবর রয়েছে। উগ্র মতবাদে উদ্বুদ্ধ তরুণদের নতুন করে আফগানমুখী হওয়ার পেছনে সে দেশ থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টির কোন যোগসূত্র থাকতে পারে বলে মনে করছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তদন্তকারী একজন কর্মকর্তা বলেন, আফগানিস্তান এখন একটি টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে সব বিদেশী সেনা প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থাও খুবই নাজুক। এমন পরিস্থিতি শুধু সে দেশের জন্য নয়, পুরো অঞ্চলের জন্যই অশনিসংকেত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ঘোষণা অনুযায়ী ১ মে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাদের সরিয়ে নেয়া শুরু হয়েছে। ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান ডিআইজি আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, সম্প্রতি তারা একটি ‘মেসেঞ্জার গ্রুপের’ সন্ধান পেয়েছেন, যেটা জঙ্গীবাদী মতাদর্শ প্রচার ও কর্মকা- পরিচালনার একটি নেটওয়ার্ক। সায়েন্স প্রোজেক্ট’ নামের ওই চ্যাট গ্রুপে ১০ তরুণ যুক্ত ছিলেন। এদের মধ্যে দুজন আফগানিস্তান গেছেন, আরেকজনের বিষয়টি নিশ্চিত নয়। ওই তরুণেরা পাসপোর্ট ব্যবহার করে দেশ ছেড়েছেন এমন কোন তথ্য তাদের কাছে নেই। গত শনিবার যে চার তরুণকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তারাও ‘সায়েন্স প্রোজেক্ট’ নামের ওই মেসেঞ্জার গ্রুপে যুক্ত ছিলেন বলে জানিয়েছিলেন তিনি। তারাও বাংলাদেশে ‘নাশকতা’ ঘটিয়ে আফগানিস্তানে ‘হিজরত’ করার পরিকল্পনায় ছিলেন জানিয়ে ডিআইজি আসাদুজ্জামান রবিবার বলেন, ‘আপনারা জানেন, আনসার আল ইসলাম উপমহাদেশের আল-কায়েদার শাখা বলে নিজেদের দাবি করে। সেই সূত্র ধরেই তারা হিজরত বা আফগানিস্তানে হিজরত করতে গিয়ে থাকতে পারে বলে তাদের ভাষ্য। তদন্তকারী সংস্থা সিটিটিসির কর্মকর্তা বলেন, আশির দশকে আফগানিস্তনে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিলেন বেশ কিছু তরুণ-যুবা, যাদের একটি বড় অংশ উগ্রপন্থী ধারার কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক। তাদের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও সেই আফগান ফেরত যোদ্ধাদের হাত ধরেই নব্বই দশকের শুরুতে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের গোড়াপত্তন হয়। পাকিস্তানী জঙ্গী সংগঠনের শাখা হিসেবে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পায় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী (হুজি)। তালেবান নেতা ওসামা বিন লাদেন এদেশে হুজি প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিলেন।
×