মোরসালিন মিজান ॥ মহাদুর্যোগে যখন পৃথিবী তখন বাঙালী অদ্ভুত এক খেল দেখাল বলতে হবে। করোনায় কত মানুষ যে মারা গেল! সামনের দিনগুলোতে শঙ্কা বাড়ছে বৈ কমছে না। বিশেষ করে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে উৎকণ্ঠা চরমে। সরকার তটস্থ। জনসাধারণকে বারবার সতর্ক করা হচ্ছে। এ অবস্থায়ও শঙ্কাকে, কী কা-, তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল একদল মানুষ। মহামারীকালে স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে ঈদ উদ্যাপন করল তারা! গত শুক্রবার ছিল পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। মূল উৎসব শেষ হলেও ঈদের রেশ রয়ে গেছে।
নতুন করে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকলে গত ৫ এপ্রিল থেকে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে সরকার। ১৪ এপ্রিল থেকে বিধি নিষেধ আরও কঠোর করা হয়। সংক্রমণ ঠেকাতে বন্ধ রাখা হয় দূরপাল্লার বাস ট্রেন লঞ্চসহ সব ধরনের যানবাহন। এ অবস্থার মধ্যেই শুরু হয়ে যায় ঈদে বাড়ি ফেরার তোড়জোড়। অসংখ্য মানুষ ঢাকা ছেড়ে যায়। শিমুলিয়া ঘাটের যে ছবি সামনে এসেছে তাতো এখন ইতিহাস। স্বাস্থ্যবিধি পদ্মায় জলে চুবিয়ে মেরে ফেরিতে উঠেছিল তারা। কেউ ট্রাকে পণ্য হয়েছেন। কেউ রোগী সেজে উঠেছেন এ্যাম্বুলেন্সে। বাইক চালিয়েছেন। পায়ে হেঁটেছেন। এভাবে ঠিকই পৌঁছেছেন গ্রামের বাড়ি। আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করেছেন। মোবাইল ফোনের সিমের হিসাব বলছে, গত ৪-১৩ মে পর্যন্ত ১২ দিনে ঢাকা ছাড়েন ১ কোটি ৬ লাখ ৪৫ হাজার ৬৯৭ মানুষ। এরই মাঝে শুরু হয়ে গেছে প্রত্যাবর্তন। ঈদের একদিন পর শনিবার ঢাকায় ফিরেছেন ৪ লাখ ১২ হাজার ৭৬৩ সিমের মালিক। করোনা ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে এই জনগোষ্ঠী কী ভূমিকা রাখল তা কয়েকদিনের মধ্যেই হয়তো জানা যাবে। তবে উৎসবপ্রেমীরা আপাতত ঈদের আনন্দকেই বড় করে দেখছেন।
কুষ্টিয়ায় ঈদ করে সোমবার ঢাকায় ফেরা শরিফুজ্জামান বলছিলেন, আমি ছোটখাটো একটা ব্যবসা করি। বাড়ি যাওয়ার তেমন সুযোগ হয় না। তবে প্রতি ঈদে গ্রামের বাড়ি যাই। শহরে তো তেমন ঘনিষ্ঠ কেউ নেই। গ্রামে অনেক আত্মীয়স্বজন। ঈদে বাড়ি গেলে সবার সঙ্গে দেখা হয়। গতবার করোনার কারণে যেতে পারিনি। করোনার ভয় দেখিয়েছে সবাই। এবার আল্লাহর ওপর ভরসা করে চলে গেলাম। ফিরেও এসেছি। ভ্রমণে অনেক কষ্ট হয়েছে। তবে আনন্দটাকেই বড় করে দেখতে চান বলে জানান তিনি।
বাড্ডার এক ফার্নিচার কারখানায় কাজ করেন আসাদুল। তার মা দুই ভাই ভাবী থাকেন ফরিদপুর। স্ত্রী এক সন্তানসহ সেখানেই ঈদ করতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু স্ত্রী সন্তানকে আর সঙ্গে আনেননি। কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাওয়ার সময় খুব কষ্ট হয়েছে। আমি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। যানবাহন পাওয়া যায় না। তাই ওদের এবার রেখে এসেছি গ্রামে। পরে বাস ছাড়লে নিয়ে আসব।
এদিকে মানুষজন ফিরতে শুরু করলেও ঢাকা এখনও মোটামুটি ফাঁকা। রাস্তায় সেই ভিড় নেই। অল্প সংখ্যক যানবাহন চলাচল করছে। কিছু দোকানপাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা। কিছু এখনও বন্ধ। সব মিলিয়ে একটা ঢিলেঢালা ভাব। ছুটির আমেজ। রাজধানীতে এবারও সব ধরনের বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। চিড়িয়াখানা জাদুঘর থেকে শুরু করে সিনেমা হল, সবই বন্ধ। তবে উদ্যান বা খোলা জায়গাগুলোতে বেড়াতে বাধা নেই। এ কারণে হাতিরঝিলে উৎসবপ্রেমীদের বড় সমাবেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ঈদের নতুন জামা গায়ে দিয়ে অনেকেই ঝিলের ধারে বেড়াতে আসছেন।
দুই শিশু সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে সোমবার এখানে বেড়াতে এসেছিলেন আমিনুল ও জোসনা দম্পতি। কথা প্রসঙ্গে জোসনা বলেন, ঈদের প্রথম দুই দিন বাসায় থাকতে হয়েছে। আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবদের দাওয়াত করেছিলাম। পরের দিন কিছুটা বিশ্রাম নিয়েছি। আজ ছেলে মেয়ে দুটোকে নিয়ে একটু খোলা জায়গায় বেড়াতে এলাম। উদ্যাপন তাহলে শেষ হচ্ছে কবে? এমন প্রশ্নে হেসে ফেলেন তিনি। বলেন, এখন সবই বন্ধ। কারও তাড়া নেই। তাই ঈদটা লম্বা হচ্ছে।
একইভাবে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের ও পেছনের অংশে অনেকে বেড়াতে আসছেন। মানিক মিয়া এভিনিউতে উৎসবের ছবিটা এখনও বেশ দৃশ্যমান। হকাররা ফুটপাথের ওপর খেলনা চটপটি আইসিক্রম ইত্যাদি নিয়ে বসে গেছেন। সড়কে চলছে ঘোড়ার গাড়িও। চালকদের একজন সুমন। কম বয়সী এই চালক জানায়, ঘোড়াগুলো মূলত পুরান ঢাকার। সেখানেই বেশি চলে। ঈদ উপলক্ষে এখন সংসদ ভবন এলাকায় বা শহীদ মিনার এলাকায় চালাচ্ছে তারা। ঈদের দিন ও ঈদের পর দিন ‘প্যাসেঞ্জারও’ ভাল পাওয়া গেছে। তবে ধীরে ধীরে প্যাসেঞ্জার কমছে বলে জানায় সে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: