ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মনিরুল ইসলাম রফিক

ঈদের আনন্দ ঈদের আহকাম

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ১২ মে ২০২১

ঈদের আনন্দ ঈদের আহকাম

তিরিশ রোজার সিয়াম শেষে/ এলো খুশির ঈদ, জাগলো আকাশ পাহাড় নদী/ ভেঙ্গে চাঁদের নিদ। -(কবি ফজলে খোদা) মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার ধারাবাহিকতায় বিদায় নিল রহমতের দশক, মাগফিরাতের মাঝের দশ দিন ও ইতিকাফের স্বর্গীয় আমেজ, শব-ই-কদর। এখন সামনে শুধু ঈদের ইবাদত, ঈদের আনন্দ। মুসলিম জিন্দেগীতে এ এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির দ্রুত পরিসমাপ্তি। মাহে রমজানের পর শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ উদয় হওয়ার পয়গাম মুসলিম সমাজে কী যে বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দ বন্যা নিয়ে আসে তা একমাত্র কোন জশস্বী কবির মুখেই শোভা পায়। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন- শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো/ কত বালু চরে কত আঁখিধারা ঝরায়ে গো/ বরষের পরে আসিলে ঈদ।’ আসলে এ ঈদ আনন্দের কোন তুলনা হয় না। আর আরবী ‘ঈদ’ শব্দের অর্থও খুশী, আনন্দ। আবার ঈদের আরেক অর্থ বার বার আসা। ফিতর মানে ভাঙ্গা। বছর ঘুরে সিয়ামের মাসের পর রোজা ভাঙ্গার এ উৎসব বার বার ফিরে আসে বলেই এই ঈদ, ঈদ-উল-ফিতর নামে পরিচিত। অর্থাৎ মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর ঈদ-উল-ফিতর হলো রোজা ভাঙ্গার উৎসব। তাহলে নামেই বুঝা যায়, এদিন কোন সচরাচর আনন্দোৎসবের দিবস নয়, এ হলো রোজাদারের সাধনার সুফলের বহির্প্রকাশ। খুশী ও ইবাদতের সমন্বিত এক নির্মল আনন্দধারা। মাহে রমযান মুসলমানদের দ্বারে দ্বারে নিয়ে এসেছিল খোদাভীতি, সংযম, সাম্য, মৈত্রী ও ভালবাসার সওগাত। মাসব্যাপী এসব সাধনা ও অনুশীলনে প্রতিটি মুসলমান কাক্সিক্ষত নৈতিক চরিত্রগুলো অর্জন করেছেন বৈ কি। আজ ঈদের আনন্দধারায় তা সমাজে প্রদর্শনের বাস্তব মহড়া শুরু হবে, যা গোটা বছরের জন্য উম্মাহর পাথেয় হয়ে থাকবে এ হলো ইসলামের দর্শন। তাই এই ঈদের আনন্দ নীতি- নৈতিকতা বিসর্জিত আনন্দ উৎসব কিংবা উৎসবের নামে হৈ-হুল্লোড় ও বাড়াবাড়িকে সর্মথন করে না। অথচ এক শ্রেণীর মানুষ ঈদকে ভোগের মহড়া, অপচয়, অপব্যয়ের প্রতীকে পরিণত করে তুলছে। বস্তুত আজকের এ ঈদ ত্যাগের, নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার আর উৎসর্গ করার, এ ঈদ ধনী-গরিব, শহুরে-গ্রামীণ সবার মাঝে সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন রচনার। আজকে ঈদের দিনেও ইসলাম তাই গরিবদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারটি প্রাধান্য দিয়েছে। হাদিস শরীফে ঈদের নামাজের আগেই গরিবদের হক মিটিয়ে দেয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে। যাতে তাদের হাত পাততে না হয়। পবিত্র ইসলামের এই নীতি কথাটি অতি সুন্দরভাবে ধারণ করেছেন কবি নজরুল তার কবিতায়- সিঁড়ি-ওয়ালাদের দুয়ারে এসেছে আজ/ চাষা মজুর ও বিড়িওয়ালা;/ মোদের হিস্সা আদায় করতে ঈদে/ দিলে হুকুম আল্লাহ তায়ালা। দ্বার খোলো সাততলা বাড়িওয়ালা, দেখ কারা দান চাহে মোদের প্রাপ্য নাহি দিলে যেতে নাহি দেব ঈদগাহে-। নজরুল অন্যত্র এদিন ধনীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন- ‘বুক খালি করে আপনারে আজ দাও জাকাত/ করোনা হিসাবী, আজি হিসাবের অংকপাত/ একদিন কর ভুল হিসাব...। একইভাবে সত্যিকারের ঈদের আনন্দ রোজাদারের আমল বৃদ্ধি করে, নাজাতের পথকে করে সুগম। ঈদের (পূর্ব) রাতকে ইসলাম ঘোষণা করেছে পুরস্কার বিতরণের রজনী হিসেবে। আমাদের নবীজী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেছেন- ‘কোন ব্যক্তি যদি আত্মসমালোচনার সঙ্গে দুই ঈদপূর্ব রাতে জেগে জেগে ইবাদত করে সে দিন তার অন্তর মরবে না যেদিন সকলের অন্তর মরে যাবে।’ আল্লাহর রাসূলের (সা.)-এ মূল্যবান হাদিসের ওপর আমাদের আমল করা উচিত। ঈদ-উল-ফিতর প্রসঙ্গে বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এক দীর্ঘ হাদিসে বর্ণনা করেন- যখন ঈদের সকাল হয় তখন মহান আল্লাহ প্রতিটি দেশে দেশে ফেরেস্তা প্রেরণ করেন। তারা অবতরণ করে পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকেন। তারা ডাকতে থাকেন। তাদের আহ্বান মানুষ ও জ্বিন ব্যতীত আল্লাহর সব মাখলুকই শুনতে পায়। তারা বলেন: ওহে উম্মতে মুহাম্মদী! বের হয়ে এসো অতি মর্যাদাবান প্রতিপালকের নিকট। তিনি অধিক পরিমাণে দান করে থাকেন। আর মারাত্মক অপরাধও ক্ষমা করেন। আজকের লাগামহীন ঈদের আনন্দে আমাদের অনেকে ঈদের উপরোক্ত ধর্মীয় গুরুত্ব ও মর্যাদার কথা বেমালুম ভুলে থাকি। যার কারণে আমরা লক্ষ্য করছি, মুসলমানদের ঈদ ক্রমশ হয়ে পড়েছে নিষ্প্রাণ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যহীন। বস্তুত রমজান যেমন সাধনার মাস। এতে সিয়াম, কিয়ামসহ কঠিন ইবাদতসমূহের মাঝামাঝি রয়েছে ইফতার সেহরির আনন্দদায়ক মুহূর্ত। তেমনি ঈদ আনন্দও কিছু বিধিনিষেধে পরিপূর্ণ যা অনিয়মতান্ত্রিকতাকে নিরুৎসাহিত করে এক সুশৃঙ্খল ও ধারাবাহিক দায়িত্ব কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেয়। যেমন- ঈদের নামাজের প্রাক্কালে কিছূ মুস্তাহাব কাজ করার বিধান রয়েছে। তন্মধ্যে- ১. ঈদগাহে গমনের পূর্বে ফজরের পর কোন মিষ্টি জাতীয় খাবার গ্রহণ ২. গোসল করা ৩. মিসওয়াক করা ৪. খুশবু ব্যবহার করা ৫. উত্তম কাপড় চোপড় পরিধান করা ৬. ঈদের নামাজে গমনের পূর্বে সাদকাতুল ফিতর আদায় করা ৭. প্রত্যুষে বিছানা ত্যাগ করা ৮. সকাল সকাল ঈদগাহে উপস্থিত হওয়া ৯. হেঁটে হেঁটে ঈদগাহ অভিমুখে গমন করা ১০. চলতি পথে নিচু কণ্ঠে তাকবীর বলে যাওয়া (তাকবীর ‘আলাহু আকবর, আলাহু আকবর, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আলাহু আকবর ওয়ালিল্লাহিল হামদ্)। ১১. এক পথে যাওয়া, ভিন্ন পথে আসা ১২. সাজগোজ করা ১৩. উন্মুক্ত আকাশের নিচে খোলা ময়দানে ঈদের নামাজ আদায় করা। আমরা যেন সিয়াম সাধনার শেষ পর্যায়ে ইহতিসাব বা আত্মসমালোচনার মনোভাবে সমৃদ্ধ হয়ে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরকে স্বাগত জানাই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই তাওফিক দান করুন, আমীন। লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব [email protected]
×