ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে’ অন্ধ হচ্ছেন কোভিড রোগীরা

প্রকাশিত: ২১:৩১, ১০ মে ২০২১

‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে’ অন্ধ হচ্ছেন কোভিড রোগীরা

অনলাইন ডেস্ক ॥ ভারতের মুম্বাইয়ে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. অক্ষয় নায়ের ২৫ বছর বয়সী এক নারীর চোখে অস্ত্রোপচারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ওই নারী তিন সপ্তাহ আগে কোভিড থেকে সেরে উঠেছেন। কিন্তু তার সমস্যাটি ভিন্ন। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই নারী মিউকোমাইকোসিস বা বিপজ্জনক ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত। আগ্রাসী এই ছত্রাক নাক, চোখ এবং কখনো কখনো মস্তিষ্কেও ছড়িয়ে পড়ে। গত শনিবার সকালে প্রথমে একজন নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ওই নারীর নাকে একটি টিউব ঢুকিয়ে মিউকরমাইকোসিস সংক্রমিত টিস্যুগুলো বের করে আনেন। এরপর ডা. নায়ের ওই নারীর চোখ তুলে ফেলতে তিন ঘণ্টার অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, জীবন বাঁচাতে ওই নারীর চোখ ফেলে দিতে হবে। এ ছাড়া এই পর্যায়ে এই রোগের আর কার্যকর চিকিৎসা নেই। ভারতে যখন কোভিড-১৯ সংক্রমণের ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউ কেড়ে নিচ্ছে বহু মানুষের জীবন, তছনছ করে দিচ্ছে জনজীবন, তখন ভারতের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন কোভিড থেকে সুস্থ হয়ে ওঠাদের শরীরে বিরল এক সংক্রমণ- যার নাম ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ বা বৈজ্ঞানিক নাম মিউকোরমাইকোসিস। মিউকোরমাইকোসিস কী? মিউকোরমাইকোসিস খুবই বিরল একটা সংক্রমণ। মিউকোর নামে একটি ছত্রাকের সংস্পর্শে এলে এই সংক্রমণ হয়। সাধারণত এই ছত্রাক পাওয়া যায় মাটি, গাছপালা, সার এবং পচন ধরা ফল ও শাকসবজিতে। ডা. নায়ের বলেন, এটা মাটি এবং বাতাসে এমনিতেই বিদ্যমান থাকে। এমনকি নাক ও সুস্থ মানুষের শ্লেষ্মার মধ্যেও এটা স্বাভাবিক সময়ে থাকতে পারে। এই ছত্রাক সাইনাস, মস্তিষ্ক এবং ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। ডায়াবেটিস, ক্যান্সার বা এইচআইভি/এইডস যাদের আছে, কিংবা কোনো রোগের কারণে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম এই মিউকোর থেকে তাদের সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্তদের মৃত্যুহার ৫০ শতাংশের মতো। চিকিৎসকদের ধারণা, করোনায় গুরুতর অসুস্থদের চিকিৎসায় যেসব স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর কারণে মিউকরমাইকোসিস সংক্রমণ ঘটতে পারে। কোভিড-১৯এ গুরুতরভাবে আক্রান্তদের চিকিৎসায় তাদের জীবন বাঁচাতে এখন স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসা করা হচ্ছে। স্টেরয়েড কোভিড-১৯ আক্রান্তদের ফুসফুসের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। করোনাভাইরাসের জীবাণুর সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যখন অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন এর ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে যেসব ক্ষতি হয় সেই ক্ষতি থামানোর জন্যও ডাক্তাররা কোভিডের চিকিৎসায় স্টেরয়েড ব্যবহার করেন। কিন্তু এই স্টেরয়েডের ব্যবহার স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি ডায়াবেটিস নেই এমন কোভিড আক্রান্তদের শরীরের রক্তে শর্করার (ব্লাড সুগার) মাত্রাও বাড়িয়ে দেয়। ধারণা করা হচ্ছে যে শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণেই মিউকোরমাইকোসিস সংক্রমণ ঘটছে। ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত শহরগুলোর অন্যতম মুম্বাইয়ের তিনটি হাসপাতালে কাজ করছেন ডা. নায়ের। তিনি জানান, গত এপ্রিলে এই ছত্রাকে সংক্রমিত প্রায় ৪০ জন রোগী পেয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ডায়াবেটিসের রোগী ছিলেন এবং ঘরে থেকেই চিকিৎসা নিয়ে কোভিড–১৯ থেকে সেরে উঠেছেন। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাদের ১১ জনের একটি চোখ ফেলে দিতে হয়েছে। এ ছাড়া গত বছরের ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভারতের পাঁচ শহর মুম্বাই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, দিল্লি ও পুনেতে ৫৮ জনের মিউকরমাইকোসিস সংক্রমণের কথা জানিয়েছেন নায়েরের ছয়জন সহকর্মী। এই রোগীদের অধিকাংশই কোভিড–১৯ থেকে সেরে ওঠার ১২ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে এতে সংক্রমিত হয়েছেন। মুম্বাইয়ের সিয়ন হাসপাতালে গত দুই মাসে এই ছত্রাকে সংক্রমিত ২৪ জন রোগী এসেছেন। হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগের প্রধান রেনুকা ব্র্যাদু জানান, আগে বছরে এ ধরনের রোগী আসত মাত্র ছয়জন। গত দুই মাসে যে ২৪ জন রোগী এসেছিলেন, তাদের মধ্যে ১১ জন একটি করে চোখ হারিয়েছেন আর মারা গেছেন ৬ জন। এই রোগীদের অধিকাংশই মধ্যবয়সী এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। কোভিড–১৯ থেকে সেরে ওঠার দুই সপ্তাহ পরে ছত্রাক সংক্রমণ ধরা পড়েছে তাঁদের। ডা. রেনুকা বলেন, এখন সপ্তাহে এ ধরনের দুই থেকে তিনজন রোগী পাচ্ছেন তাঁরা। মহামারির মধ্যে এটা আরেকটা ভয়ানক বিষয়। বেঙ্গালুরুর চক্ষুবিশেষজ্ঞ রঘুরাজ হেগড়েও একই ধরনের কথা বলেন। গত দুই সপ্তাহে মিউকরমাইকোসিসের ১৯টি ঘটনা পাওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি। এই রোগীদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। এই চিকিৎসক বলেন, তাদের অনেকে এত বেশি অসুস্থ ছিলেন যে অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হয়নি। চিকিৎসকরা বলছেন তারা করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে এই ছত্রাক সংক্রমণের ভয়াবহতা এবং এত দ্রুত তা ছড়ানোর ঘটনায় খুবই বিস্মিত। গত বছর কোভিডের প্রথম ঢেউয়ের সময় এই ছত্রাক সংক্রমণ ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। ডা. নায়ের বলছেন গত দুবছরে তিনি মুম্বাইতে ১০টির বেশি কেস পাননি। এবছর চিত্রটা খুবই আলাদা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডা. হেগড়ে বলছেন, ব্যাঙ্গালোরে তিনি তার দুই দশকের চিকিৎসা জীবনে বছরে কখনও একটা বা দুটোর বেশি কেস দেখেননি। মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্তদের যেসব উপসর্গ দেখা দেয়, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে নাক বন্ধ ও নাক দিয়ে রক্ত পড়া, চোখ ফোলা ও চোখে ব্যথা, চোখের পাতা বন্ধ করতে সমস্যা, ঝাপসা দেখা এবং দৃষ্টিশক্তি হারানো। নাকের চামড়া কালচেও হয়ে থাকে। চিকিৎসকেরা বলছেন, অধিকাংশ রোগীই তাদের কাছে দেরিতে আসছেন, যখন তাঁরা দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলছেন। সে কারণে ছত্রাকটি মস্তিষ্কে যাওয়া ঠেকাতে অস্ত্রোপচার করে চোখ ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকছে না। মুম্বাইয়ের ডায়াবেটিসের চিকিৎসক ডা. রাহুল বক্সি বলেছেন, এই ছত্রাক সংক্রমণ এড়ানো একমাত্র সম্ভব কোভিড-১৯এর রোগীর চিকিৎসার সময় এবং তার সুস্থ হয়ে ওঠার সময় যদি নিশ্চিত করা যায় তাকে সঠিক পরিমাণ স্টেরয়েড দেয়া হচ্ছে, সঠিক সময় ধরে।
×