ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

’৭১-এর শরণার্থী জীবনের ঈদ ও করোনাকালীন নিরানন্দ ঈদ

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ১১ মে ২০২১

’৭১-এর শরণার্থী জীবনের ঈদ ও করোনাকালীন নিরানন্দ ঈদ

সিয়াম সাধনার মাস রমজান শেষ হতে চলেছে। সামনে আসছে খুশির ঈদ। এক মাসের সংযম শেষে এটি মহান আল্লাহর দেয়া এক দান ও পুরস্কার, তাদের জন্য যারা মাসজুড়ে নিজেকে সমর্পণ করেছেন আল্লাহর সমীপে। যারা নিজেকে দূরে রেখেছেন সব ভ্রান্তি থেকে। মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঈদ-উল-ফিতর। ঈদ-উল-আজহাও মুসলমানদের আরেকটি উৎসবের দিন। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কারণে মুসলমানদের ঈদ, হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজা, সরস্বতী পূজা, খ্রীস্টানদের বড়দিন বা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ পূর্ণিমার দিনÑএগুলোর সবই বাংলাদেশের আপামর মানুষের জন্যই যেন সর্বজনীন উৎসব ও আনন্দের দিন। দিবসগুলোতে নির্ধারিত ধর্মীয় আনুষঙ্গিকতা ছাড়া সারা দিনের সব অনুষ্ঠানই হয়ে উঠে সর্বজনীন। সামগ্রিকভাবে আপামর বাঙালীর উৎসব হিসেবে এখন সবচেয়ে বড় উৎসব হলো পহেলা বৈশাখ। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উদযাপন করে থাকে বাংলাদেশসহ বিশে^র নানা প্রান্তের বাঙালী সমাজ। এ বছর এই সময়ে মনে পড়ছে গত বছর ঈদ কেমন ও কিভাবে কেটেছে। সেইসঙ্গে মনে পড়ছে ১৯৭১ এর ঈদের দিনের কথাও। করোনাজনিত প্রাদুর্ভাবের কারণে গত বছরের (২০২০) মতো এ বছরও বাঙালীর প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ বলতে গেলে তেমনভাবে পালিত হয়নি। এমন সাজ ও রংহীন নিথর পয়লা বৈশাখ কেউ কোন দিন কল্পনা করিনি। প্রতি বছর ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকত বৈশাখের শুরুর দিনটি। কিন্তু এবার ও গতবার এই দিনে নানা ফুলের চির হরষিত ফেরিওয়ালারাও যেন নীরবে কেঁদেছে। ফাঁকা পড়ে রয়েছে রমনার বটমূল। চারপাশ মেতে ওঠেনি ঢাক ঢোলের আওয়াজে। এবারের ঈদের দিনটিও বুঝি রইবে রংহীন সাজহীন। ২০২০ সালে এই করোনাকালীন অবস্থার মধ্যেই বাঙালী মুসলমানরা দুটি ঈদ উৎসব পালন করেছে নিরানন্দভাবে। নিজ নিজ ঘরে অবরুদ্ধ থেকে। পালিত হয়েছে বাঙালী হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান দুর্গাপূজা, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ পূর্ণিমা। ২৫ ডিসেম্বর বড় দিন উদ্যাপনের সময় বাংলাদেশে করোনার তেমন প্রভাব ছিল না। তবু উৎসব পালন করতে হয়েছে সীমিতভাবেই। এ বছর মার্চ থেকে আবার করোনার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার সারা দেশে চলাচলে কঠোর বিধিনিষেধ ঘোষণা করে। লোকমুখে এটি ‘লকডাউন’ নামে পরিচিতি পায়। এই বিধিনিষেধ এর কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও শ্রমিক শ্রেণী আর্থিকভাবে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। তবে এই ‘লকডাউন’-এর সুফল আমরা ইতোমধ্যেই পাচ্ছি। সম্ভবত এ কারণেই মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সংক্রমণের মাত্রা শতকরা দশ এর নিচে নেমে এসেছে। দোকানপাট খোলার অনুমতি দেয়ার পর পর ঈদের কেনাকাটা করার জন্য মানুষ দেখছি দোকানপাটে হুমরি খেয়ে পড়েছে। শপিং মলে, মার্কেটে গিয়ে নিজের ও স্বজনদের জন্য কেনাকাটা ঈদ উৎসবের একটি অনুষঙ্গ। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই অনেকটাই কম। অসচেতন মানুষ এটি চিন্তা করছেন না যে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে তাদের শৈথিল্য ও অসতর্কতার কারণে তাদের পরিবারের ঈদের আনন্দটুকু নিরানন্দে পরিণত হতে পারে। অদৃশ্য করোনার সঙ্গে সকলকে যুদ্ধ করতে হবে। এমন মনোভাবই মানুষকে সচেতন করবে। করোনা প্রতিরোধ এখন এক যুদ্ধ। করোনাকালে উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইয়োরি মুসেভেনির বক্তব্যটি খুবই সময় উপযোগী। তিনি বলেছেন, ‘আজকে যুদ্ধের মতো যদি অবস্থা বিরাজ করত তাহলে কি আমরা জীবিকার কথা চিন্তা করতাম, নাকি জীবনের কথা চিন্তা করতাম?’ জীবনের জন্য জীবিকার প্রয়োজন অনিবার্য। তবে শত হিসেবের পরেও জীবন বাঁচলে তবেই জীবিকার প্রশ্নটি আসে। জীবিকার সাময়িক স্থবিরতা কি কোভিড-১৯ এর প্রবল প্রতাপের চেয়ে বেশি প্রতিকূল? এটি সবাইকে ভাবতে হবে। সবার চেতনায় এটি আনতে হবে যে, আগে জীবন, তারপর জীবিকা। গেল বছর আমরা ঈদের নামাজ জামাতে বা মসজিদে পড়িনি। সন্তানদের নতুন কাপড় কিনে দিইনি। এ বছরও মাঠে গিয়ে ঈদের জামাত হয়ত পড়া হবে না। ঈদের সর্বজনীন আনন্দ থেকেও সবাই থাকব বঞ্চিত। মনে আছে, পঞ্চাশ বছর আগে আমরা আমাদের জীবনে একটি উৎসবহীন ঈদ পালন করেছিলাম ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়। আমরা যারা ভারতে আশ্রয় নিয়ে শরণার্থীর জীবনযাপন করছিলাম তাদের জীবনে ’৭১-এর ঈদ কেমন ছিল সেটি চিত্রায়িত হওয়া প্রয়োজন। ওই চিত্র আজকের করোনাকালীন অবস্থায় এই উৎসব উদযাপন কেমন হবে বা হতে পারে তা বলে দেবে কিছুটা হলেও। আমরা সপরিবারে শরণার্থী ছিলাম ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে। দিনটি ছিল ২০ নবেম্বর ১৯৭১, শনিবার। ঈদের দিন। শীতের সকাল। প্রাকৃতিক কারণে পঞ্চাশ বছর আগে পাহাড়ে নবেম্বর মাসে বেশ শীত অনুভূত হতো। বৈশি^ক উষ্ণতার কারণে এখন হয়ত পাহাড়েও শীতের প্রকোপ কমেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে মেঝ মামা ও আমরা দু’ভাই পাহাড়ী ঝর্ণা বেয়ে নেমে আসা বড় বড় পাথরের ফাঁকে জমে থাকা ঠা-া পানি দিয়ে গোসল করতে যাই। ঈদের দিন, তাই মুসলিম সম্প্রদায়ের গুটি কয়েক ছাড়া অত সকালে কেউই আসেনি গারো পাহাড়ের ঝর্ণা ধারার শীতল জলে ¯œাত হতে। শরণার্থীদের প্রায় শতকরা নব্বই জনই ছিল হিন্দু জনগোষ্ঠীর। ঝর্ণার ঠা-া পানিতে গোসল সেরে পুরনো প্যান্ট-শার্ট পরে আব্বার সঙ্গে পাহাড় ঘেরা একটি সমতল জায়গায় গেলাম ঈদের নামাজ পড়তে। চারদিকে সবুজে আচ্ছাদিত পাহাড় ঘেরা মনোরম পরিবেশ। তার পরও আমাদের কারও মুখে তেমন কোন আনন্দের ছটা নেই। মনে আছে, যারা নামাজ পড়তে এসেছিল তারা সবাই বাংলাদেশ ভূখ-ে তাদের প্রিয়জনদের পাক হানাদারদের বন্দুকের নলের মুখে রেখে এখানে তারা শরণার্থী। যা হোক, নামাজের জায়গাটিতে সব মিলিয়ে আমরা শ’দুয়েক লোক ছিলাম। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বেশ কয়েকজন। প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা মহেশখোলার এফএফ ক্যাম্পে (ঋৎববফড়স ঋরমযঃবৎং ঈধসঢ়) সাময়িকভাবে অবস্থান করছিলেন। একজন মৌলানা সাহেব ঈদের নামাজ পড়ালেন। তাঁকে সম্ভবত সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশের ভেতর থেকে খবর দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। মনে পড়ে নামাজ পড়ার সময় বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্রসহ নামাজের জামাতের চারদিকে পাহারায় রত ছিলেন। ওই জামাতে সম্ভবত চারজন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। নামাজের পর ঘরে ফিরে আসি। আমরা থাকতাম মাচার ওপরে ছন দিয়ে তৈরি এক কুঁড়েঘরে। ১৯৭১ এ আমি একজন কিশোর। সব কথা হয়ত সেভাবে স্মৃতিতে স্থায়ী হয়নি। ১৯৭১ এর শরণার্থী জীবনের অনেক কথা জানতে আমার আম¥ার ওপর অনেকটা ভরসা করতে হয়। মায়েরও বয়স এখন বিরাশি পেরিয়েছে। বাবা থাকলে হয়ত তাঁকেই জিজ্ঞেস করতাম। তিনি গত হয়েছেন আট বছরেরও অধিক। ১৯৭১ এর সেদিন ঈদের দিন দুপুরে মুরগির মাংস ও পোলাওয়ের ব্যবস্থা হয়েছিল বলে আম¥া বললেন। একটি বিশেষ কারণে এ রকম ভাল খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ২১ অক্টোবর ১৯৭১ ছিল পয়লা রমজান। সেদিন আমার চাচাত ভাই কামাল মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফেরার পথে জলপাইগুড়ির ফাঁঙ্গা/পাঙ্গা ক্যাম্পে মৃত্যুবরণ করেন। শহীদ কামালের পিতা মোহনগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোফাজ্জল হোসাইন খান চৌধুরীও সপরিবারে আমাদের সঙ্গে মেঘালয়ের মহেশখোলাতেই শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কামাল ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদটি এ হাত ও হাত হয়ে মহেশখোলায় পৌঁছাতে বেশ সময় লাগে। এ সংবাদে আমার চাচা, চাচির মানসিক ও শারীরিক অবস্থার দারুণ অবনতি হয়। আব্বা আম¥া প্রায় প্রতিদিনই চাচার বাসায় যেতেন সান্ত¡না দিতে। আব্বা ও আম¥া ওই ঈদের দিন মুরগির মাংস ও পোলাও রান্না করে নিয়ে যান শহীদ কামালের বাবা মা ও তার পরিবারের সদস্যদের জন্য। ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাঙালীদের উদ্দেশে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বক্তৃতা ও বিবৃতি দিয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে ‘জয়বাংলা’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। পাকিস্তানের কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকেও ১৯ নবেম্বর ১৯৭১ অর্থাৎ ঈদের আগের দিন ‘জয় বাংলা’ পত্রিকায় জাতির উদ্দেশ্যে ‘উৎসবের ঈদ নয়, ত্যাগের ঈদ’ শিরোনামে একটি বাণী ছাপানো হয়েছিল। এই বাণীতে উল্লেখ করা হয়েছিল- রমজানের পুণ্য কৃচ্ছ্র সাধনার মাস শেষ হলো। এই সংখ্যা ‘জয় বাংলা’ যখন পাঠকদের হাতে পৌঁছবে, তখন বাংলাদেশের মুসলমান ঈদ-উল-ফিতরের উৎসবের জন্য অপেক্ষমাণ। আকাশে শওয়ালের এক ফালি চাঁদও হয়ত উঠি উঠি করছে। শারদোৎসব বাঙালীর যেমন একটি সার্বজনীন উৎসব, তেমনি তাদের অপর একটি সার্বজনীন উৎসব রমজান শেষের ঈদ। এবার শারদোৎসবে বুড়িগঙ্গার পারে যেমন বাজনা বাজেনি, তেমনি এবার ঈদেও খুশির চাঁদ বাঙালীর আকাশে ওঠেনি। খুশি হওয়ার, উৎসব করার অবকাশ কই এখন বাঙালীর জীবনে? গোটা জাতি যখন তার অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে ব্যস্ত, নরপশু ইয়াহিয়ার দস্যুচক্রের বিরুদ্ধে বাঙালী জাতি যখন জীবন-মরণ সংগ্রামে লিপ্ত, তখন উৎসব করার, আনন্দ করার অবকাশ মানুষের জীবনে থাকতে পারে না। ১৯৭১ এ আমরা শরণার্থীরা ও বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায় সেই অর্থে রোজার ঈদের উৎসবের কোন চিরায়ত রূপ দেখিনি। রোজার ঈদ তো কেবল উৎসবের ঈদ নয়। এক মাসের ত্যাগ কৃচ্ছ্রতা ও সংযম সাধনা শেষে এই ঈদ যা এক অপার আনন্দ। কিন্তু সেদিন বাস্তুচ্যুত শরণার্থীরা এবং সারা বাংলার মানুষ দেশকে হানাদার দস্যুদের কবলমুক্ত করার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ ছিল। ঈদের আনন্দ উৎসব ছিল গৌণ। ঈদ আনন্দের কোন রেশ তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। সবাই অপেক্ষায় ছিল কবে সব আঁধার দূর করে দিনটি অশ্রুর কুয়াশামুক্ত করে আবার খুশির রোশনাই ছড়াবে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দেশের অভ্যন্তরেও ঈদ-উল-ফিতর মানুষের কাছে আনন্দের দিন হিসেবে আসেনি। প্রতিনিয়ত গুলির আওয়াজ আর স্বজনদের মৃত্যুর খবরে কার আনন্দ করার মানসিকতা থাকে? ঈদের আনন্দের কোন স্থান ছিল না তাদের হৃদয়ে। ১৯৭১ এ শহীদ জননী জাহানারা ইমাম হারিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় সন্তান বীর রুমিকে। শহীদ হন রুমী পাক সেনাদের হাতে। ’৭১-এর ঈদের দিনটি তাই শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কাছে কেমন ছিল তাঁরই এক লেখায় তা ফুটে উঠেছে- ‘আজ ঈদ। ঈদের কোন আয়োজন নেই আমাদের বাসায়। কারও জামা-কাপড় কেনা হয়নি। দরজা-জানালার পর্দা কাঁচা হয়নি, ঘরের ঝুল ঝাড়া হয়নি। বসার ঘরের টেবিলে রাখা হয়নি আতরদান। শরীফ, জামী ঈদের নামাজও পড়তে যায়নি। কিন্তু আমি ভোরে উঠে ঈদের সেমাই, জর্দা রেঁধেছি। যদি রুমীর সহযোদ্ধা কেউ আজ আসে এ বাড়িতে ? বাবা-মা-ভাই-বোন, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোন গেরিলা যদি রাতের অন্ধকারে আসে এ বাড়িতে? তাদের খাওয়ানোর জন্য আমি রেঁধেছি পোলাও, কোর্মা, কোপতা, কাবাব। তারা কেউ এলে আমি চুপি চুপি নিজের হাতে বেড়ে খাওয়াব। তাদের জামায় লাগিয়ে দেয়ার জন্য এক শিশি আতরও আমি কিনে লুকিয়ে রেখেছি।’ দেশের ভেতরে থেকে যে মা জানতেন না তার সন্তান বেঁচে আছে না শহীদ হয়েছে, যে বাবা প্রতিদিন মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে দু’হাত তুলে ছেলের মঙ্গল কামনায় অশ্র ঝরিয়েছিলেন, তাঁদের কাছে কি ঈদের কোন আনন্দ ছিল? ঠিক তেমনিভাবে ১৯৭১ এর ঈদের দিনটিতে যারা বাস্তুচ্যুত হয়ে ভারতে শরণার্থী শিবিরে ছিলেন, তাদের অব্যক্ত কষ্টের কথা কেই বা জানে? কষ্টের দিন, অপেক্ষার পালা শেষ হয় খুব তাড়াতাড়ি। একদিন আঁধার কেটে যায়। চারপাশ আলোয় হেসে ওঠে। চাচাত ভাই কামাল ভাইয়ের শাহাদত বরণের ২৬ দিনের মাথায়ই দেশ শত্রু মুক্ত হয়। বাঙালী পায় তার দীর্ঘদিনের আরাধ্য স্বাধীনতা। স্বাধীন প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। কোভিড-১৯ এর ভয়াল থাবাও এক সময় সঙ্কুুচিত হবেই। আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে সে পেরে উঠবে না। আমরা বিজয়ী হবই। যেমনটি হয়েছিলাম ১৯৭১-এ। করোনার ঝড় সাময়িকভাবে আমাদের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। নিভিয়ে দিয়েছে অনেক দেউটি। যারা চলে গেছেন তারা আর ফিরে আসবেন না। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। বেঁচে থাকলে জীবনে অনেক মহৎ কাজ করার সুযোগ পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে উৎসব আনন্দের মহা মুখরতা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঈদের দিন আমরা যেভাবে উৎসব ও আনন্দহীনতায় কাটিয়েছি, ঠিক তেমনিভাবেই হোক না আরও একটি অভিজ্ঞতা। এবারের নিরানন্দময় ঈদের অভিজ্ঞতা। এই করোনাকালে। নিশ্চয়ই আমরা আবারও ১৯৭১ এর মতো চলমান অতিমারী করোনা যুদ্ধেও জয়ী হবো। সেই সঙ্গে অতিমারী কালে এটি যেন বিস্মৃত না হই যে, বিত্ত ও বিত্তের লোভ কাউকে কিছুু দেবে না। বরং নিজের বিত্ত থাকলে দান করুন। সবাইকে দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতে হবে। বিশেষ করে এই সিয়াম সাধনার মাসেও যখন মানুষ করোনায় বিপর্যস্ত। এই ক্রান্তিকালে ইহজাগতিক কোন প্রাপ্তির প্রত্যাশা ত্যাগ করি। আসুন এই পবিত্র রমজান মাসে বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য দানের হাত প্রসারিত করি। মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে এরূপ নির্দেশই দিয়েছেন। আমরা ধনী-দরিদ্র সবাই অভিন্ন এক ভূ-খ- বাংলাদেশের নাগরিক। একই সংবিধান আমাদের সবার মৌলিক সুরক্ষা দেয়। একালের কোন প্রাপ্তির আশায় নয়, মানবিক হতেই আমরা সবাই এগিয়ে যাই দুর্ভাগা অসহায় দরিদ্র মানুষের পাশে। করোনা মহামারীর এই ক্রান্তিকালে। আর আসুন এভাবেই এর মাঝে আমরা যেন খুঁজে ফিরি এবারের ঈদ-উল-ফিতরের আনন্দ। প্রার্থনা করি করোনা থেকে মুক্তির। যেমনটি এবং যেভাবে ১৯৭১ সালে মুক্তি চেয়েছিলাম মাতৃভূমি বাংলাদেশের জন্য। লেখক : বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট আপীল বিভাগ
×