ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ আবুল হাসান

বিদ্যুত, উন্নয়ন, উন্নয়নশীল বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২১:০৩, ১০ মে ২০২১

বিদ্যুত, উন্নয়ন, উন্নয়নশীল বাংলাদেশ

আমরা যখন ছাত্র তখনকার সময় নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞান শাখায় পদার্থ বিজ্ঞানের একটা অধ্যায় ছিল- ‘কাজ, ক্ষমতা ও শক্তি।’ তখন এই অধ্যায় পড়ে এটুকু শিখেছিলাম যতই বল প্রয়োগ করি না কেন, বস্তুর একটু স্মরণ না ঘটলে কোন কাজ হয় না। আর ক্ষমতার বলে যতই কাজ করতে চাই না কেন তার জন্য একটা শক্তির প্রয়োজন। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের সাফল্যের গল্পের পেছনে যে শক্তি কাজ করছে তা হলো বিদ্যুত। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে যে কাজই করি না কেন তার মূল চালিকাশক্তি বিদ্যুত। বর্তমান সরকার পদার্থ বিজ্ঞানের সেই সূত্র ধরেই হোক আর যে কোন চিন্তার পথ ধরেই হোক, উন্নয়নের সহজ সমীকরণটি অতি সহজেই বুঝেছিলেন যে, বিদ্যুত খাতের সামষ্টিক উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। অবশ্য স্বপ্ন দ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু তারও আগে ১৯৭৫ সালে প্রকৌশলীদের এক সম্মেলনে গ্রামে গ্রামে বিদ্যুত সরবরাহের অভিপ্রায়ে বলেছিলেন, ‘বিদ্যুত ছাড়া কোন কাজ হয় না, কিন্ত দেশের জনসংখ্যার ১৫ ভাগ লোক যে শহরের অধিবাসী সেখানে বিদ্যুত সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলেও শতকরা ৮৫ জনের বাসস্থল গ্রামে বিদ্যুত নেই। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুত সরবরাহ করতে হবে। এর ফলে গ্রামবাংলার সর্বক্ষেত্রে উন্নতি হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও গ্রামে গ্রামে বিদ্যুত চালু করতে পারলে কয়েক বছরের মধ্যে আর বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হবে না।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ১০/০৭/১৯৭৫)। বর্তমান সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেই বিদ্যুত খাতে দ্রুত উন্নয়নের লক্ষ্যে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই বার্জ মাউন্টেন্ডের মাধ্যমে বিদ্যুত উৎপাদনের এক সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। তখন অবশ্য দেশের বিশেষজ্ঞ বোদ্ধা, সুধীজনরা দেশের অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা করেছিলেন। হিংসুক প্রতিবেশীর মতো অনেকেই দুর্নীতির গন্ধ শুঁকেছিলেন। অবশেষে এটিই সঠিক পদক্ষেপ ছিল বলে এখন প্রমাণিত। বর্তমান সরকারের পূর্বের মেয়াদে (১৯৯৬-২০০০) সাল পর্যন্ত সময়ে শেখ হাসিনার সরকার অনেক চেষ্টা-তদ্বির করে বিদ্যুত উৎপাদন ১ হাজার ৬০০ মে. ওয়াট থেকে ৪ হাজার ৩০০ মে. ওয়াটে উন্নীত করেছিল। পরবর্তী সরকারের মেয়াদে বিদ্যুত উৎপাদনে সেই ধারাবাহিকতা ছিল না। বরং বিদ্যুত উৎপাদন আরও কমে ৩ হাজার ২৬৮ মে. ওয়াটে দাঁড়িয়েছিল। এ সময় খাম্বা নিয়ে অনেক টানাটানি হলেও বিদ্যুত উৎপাদন ও বিতরণে তেমন কোন কার্যকরী পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর হয়নি। আমরা যারা বিদ্যুতকর্মী ছিলাম আমাদের সারাক্ষণ টেনশনে থাকতে হতো। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গড়ে হয়ত ৮-১০ ঘণ্টা বিদ্যুত সরবরাহ করা যেত। প্রায়শই বিদ্যুত অফিস ঘেরাও, বিদ্যুত কর্মীদের মারধর এমনকি বিদ্যুত অফিস ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি লেগেই থাকত। অনেক বিদ্যুতকর্মী পরিচয় গোপন করে বাসা ভাড়া নিতেন। কারণ, বাসা ভাংচুরের ভয়ে বাড়িওয়ালা বিদ্যুত অফিস কিংবা বাসা ভাড়া দিতে চাইতেন না। অনেকে বোরকার আদলে মাথা মন্ডল মুড়ি দিয়ে বাজার ঘাটে চলাফেরা করতেন। দ্বিতীয় মেয়াদে (২০০৯-২০১৩) ক্ষমতায় এসেই বর্তমান সরকার বিদ্যুত উৎপাদনে বিশেষ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে দ্রুত বিদ্যুত পাওয়ার প্লান্ট চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করে। পূর্বের ২৭ কেন্দ্র থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ছোট-বড় ১৪৪ বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র বর্তমান সরকারের আমলে চালু হয়েছে, যার উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ হাজার ৯৮২ মে. ওয়াট। এছাড়া আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৪০ হাজার মে. ওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মে. ওয়াট উৎপাদনের লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে রূপপুর পারমাণবিক পাওয়ার প্লান্ট, পায়রা তাপবিদ্যুত কেন্দ্র ও মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুত কেন্দ্রসহ আরও অনেক বড় স্কেলে বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ করছে। উল্লেখ্য বিদ্যুত উৎপাদন থেকে বিতরণ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই এর সকল কার্যক্রম একটি জটিল কারিগরি ব্যবস্থাপনা ও অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রতিটি বাজেটে বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দের সংস্থান করে আসছে। যার ফলে এ খাতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও বিদ্যুতের মোট চাহিদার ১০% নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্যে বেশকিছু সোলার প্লান্ট নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন। বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বিদ্যুত বিতরণ কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছাতে পূর্বের ৮ হাজার থেকে ১২ হাজার ৬৯২ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন এবং ১৯২ গ্রিড উপকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও গ্রিড ও সঞ্চালন লাইন নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন, যা পিজিসিবি গ্রিড কোম্পানি বাস্তবায়ন করছে। বর্তমান সরকার বিদ্যুত বিতরণে অর্থাৎ গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুত সংযোগ বৃদ্ধি, নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুত সরবরাহে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তন্মধ্যে ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ ঘরে ঘরে বিদ্যুত’ সিস্টেম আপগ্রেডেশন, প্রি-প্রেইড মিটারসহ স্মার্ট মিটার, স্মার্ট গ্রিড স্থাপন প্রভৃতি কর্মসূচী অন্যতম। এক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ে গ্রামের আনাচে-কানাচে, ছোট-বড়, নদী-খাল-বিল, মাঠ-ঘাট, গাছপালা, বন-বাদারের মধ্য দিয়ে লাইন নির্মাণ করে দ্রুত সংযোগ প্রদান অত্যন্ত দুরূহ এই কাজ করেছে বাংলাদেশের পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও তার ৮০ পল্লী বিদ্যুত সমিতি। বর্তমান সরকার ২০১৪ সালের শতভাগ বিদ্যুতায়ন কার্যক্রম গ্রহণ করলেও মূলত ২০১৫ সাল থেকে এ কার্যক্রম বিস্তৃতি লাভ করে। অর্থাৎ ২০১৫-২০২০-এর মধ্যে মাত্র ছয় বছরে ২ লাখ ১৮ হাজার কিলোমিটার লাইন থেকে ৫ লাখ ৩০ হাজার কিমি লাইন ও অতিরিক্ত ১ হাজার ৯২টি ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র নির্মাণ করে সর্বমোট ৩ কোটি ১১ লাখ গ্রাহক সংযোগ প্রদান করে। বর্তমানে ৯৯ শতাংশ মানুষের ঘরে বিদ্যুত পৌঁছেছে। অবশিষ্ট কিছু চর এলাকায় (অফগ্রিড) ৭ হাজার ৯৭১ কি.মি. লাইন নির্মাণ করে ২ লাখ ৫০ হাজার গ্রাহকের ঘরে বিদ্যুত সংযোগ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। চলমান মুজিববর্ষেই শতভাগ মানুষকে বিদ্যুত সুবিধার আওতায় আনার জন্য পল্লী বিদ্যুতের কর্মীরা নিরলস পরিশ্রম করছে। এ সময় পল্লী বিদ্যুত সমিতিসমূহ তাদের কর্মীদের ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ সেজে একেবারে অতি সাধারণ ভূমিহীন ও প্রান্তিক গ্রাহকদের বাড়িতে বাড়িতে মাত্র ৪৫০ টাকা জামানত নিয়ে এক রকম বিনা মূল্যে ক্ষেত্র বিশেষে ৫ মিনিটেই বিদ্যুত সংযোগ দিয়েছে। কৃষকের ঘরে বসেই উঠান বৈঠক করেছে। আবার ‘দুর্যোগে আলোর গেরিলা’ সেজে করোনাকালে এবং ঘূর্ণিঝড় আমফানেও নিরবচ্ছিন্ন ও নিরাপদ বিদ্যুত সেবা দিয়েছে। এ সমস্ত উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবনী কার্যক্রম খুবই প্রশংসনীয়। এ সবই হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুত উপদেষ্টা, বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে সচিবসহ সকলের চৌকস দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বিত প্রয়োগে। এ সময় পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের আওতায় বর্তমান চেয়্যারম্যানের নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের মেয়াদে ২ কোটি ৩৬ লাখ গ্রাহক সংযোগের পাশাপাশি ৩ লাখ ৫৪ হাজার সেচ, ২ লাখ ছয় হাজার ৫৮২ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, ১৪৭৮২ বৃহৎ শিল্প, ৩ হাজার ৮৫০ পাওয়ার লুম, ১০ হাজার ৩৯৫ হাস মুরগির খামার, ৫ হাজার ৫৬৬ মৎস্য খামার, ১ হাজার ২১৮ দুগ্ধ খামার, ১৯ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪২ বাণিজ্যিক সংযোগ প্রদান করা হয়েছে। এর ফলে মাথা পিছু বিদ্যুত ব্যবহার ২২০ থেকে ৫১২ কি.ও. ঘণ্টায় উন্নীত হয়েছে। কৃষি ও শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে ঘরে ঘরে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামে গ্রামে ডিজিটাল কার্যক্রমের বিপ্লব শুরু হয়েছে। দেশে বিদেশে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে লাখ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দেশের সকল মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের মহাসড়কে যুক্ত হয়েছে। আজ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত হওয়ার অন্যতম তিনটি শর্ত যথাক্রমে মাথাপিছু আয়, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা ও মানব সম্পদের উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রেই শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করছে বিদ্যুত। ২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুত উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ খাতে সমন্বিত উন্নয়নের ফলে এ সময় মাথাপিছু বিদ্যুত উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় ডিজিপিতে তার ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ফলে ক্রমাগতভাবে মাথাপিছু আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। আর মাথাপিছু আয় ধরে রাখতে হলে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত হওয়ার দ্বিতীয় শর্ত অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা ঠেকানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত ‘ঘরে ঘরে বিদ্যুত’ একটি অত্যন্ত কার্যকরী পদক্ষেপ। প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুত শক্তি প্রতিটি মানুষের জন্য নবপ্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করছে। তাদের প্রাত্যহিক কাজকর্মে নতুন তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগ সৃষ্টি করছে। এ লক্ষ্যে সরকার বিশেষ করে পল্লী বিদ্যুতের আওতায় ৪০% লাইফ লাইন গ্রাহককে ভর্তুকি দিয়ে মাত্র ৩.৭৫ পয়সা রেটে (যদিও উৎপাদন খরচ প্রতি ইউনিট ৬.০০ টাকার ওপরে) এবং মিনিমাম বিদ্যুত বিলের পরিবর্তে প্রকৃত ব্যবহার অনুযায়ী বিদ্যুত সুবিধা দিচ্ছে যাতে করে সকল শ্রেণীর গ্রাহকই বিদ্যুত শক্তিকে কাজে লাগাতে প্রয়োজনীয় সক্ষমতা অর্জন করে এবং জিডিপিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে দীর্ঘ মেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। মাথাপিছু বিদ্যুত ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কি সম্পর্ক এবং তার সঙ্গে উন্নয়নের কি সম্পর্ক তা লেখচিত্রে দেখানো হয়েছে। কিভাবে বিদ্যুত দেশের উন্নয়নের শক্তি হিসেবে কাজ করছে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে বিদ্যুত শক্তির কতটা প্রয়োজন সেই সমীকরণটি বর্তমান সরকার বুঝতে পেরেই বিদ্যুত খাতে যে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে তা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে কষ্ট করে কাউকে বুঝাতে হয় নাই। যার সফল প্রাপ্তি উন্নয়নশীল বাংলাদেশ। (তথ্য সূত্র : গওঝ প্রতিবেদন ইজঊই, ইঊজঈ ও বিদ্যুৎ বিভাগ) লেখক : মহাব্যবস্থাপক, ফরিদপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি
×