ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জয়াবিক্রমার ইতিহাস

প্রকাশিত: ২৩:৪৭, ৫ মে ২০২১

জয়াবিক্রমার ইতিহাস

ক্যান্ডিতে রান বন্যার প্রথম টেস্ট ড্র করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিল বাংলাদেশ। স্বপ্ন দেখছিল দ্বিতীয় ম্যাচ জিতে সিরিজ জয়ের। কিন্তু পরিকল্পনা ছিল না। অন্তত শ্রীলঙ্কার অভিষিক্ত তরুণ স্পিনার একাই মুমিনুল হকদের চোখের জলে নাকের জলে একাকার করে তুলবেন, এমনটা হয়ত প্ল্যান এ, বি, বা সিÑএর মধ্যেও ছিল না! প্রাভিন জয়াবিক্রমা টেস্ট ইতিহাসে বিরল ৮০০ উইকেটের রেকর্ডধারী মুত্তিয়া মুরালিধরনের দেশের সন্তান, তাই বলে মুরালি তো নন। কিন্তু নির্লজ্জ ব্যাটিং ব্যর্থতায় ২২ বছর বয়সী তরুণ বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনারকে নায়কের আসনে বসিয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ, লিটন দাসরা! অথচ মুরালি, রঙ্গনা হেরাথের অবসরের পর সাদা পোশাকে স্থিত কোন স্পিনারই পায়নি লঙ্কানরা। সেখানে পুঁচকে জয়াবিক্রমা একাই বাংলাদেশকে লজ্জায় ডুবিয়েছেন। ফয়সালার দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে তার বোলিং ফিগার ৩২-৭-৯২-৬, দ্বিতীয় ইনিংসে ৩২-১০-৮৬-৫। প্রথম শ্রীলঙ্কান হিসেবে অভিষেকে ম্যাচে ১০ বা ততোধিক উইকেট। ১১/১৭৮Ñ বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটের ১৪৪ বছরের ইতিহাসে গড়েছেন সেরা বোলিংয়ের নতুন রেকর্ড। প্রথম টেস্টের স্কোয়াডে ছিলেন, তবে মাঠে নামা হয়নি। দলেই ছিলেন চতুর্থ পছন্দের স্পিনার হিসেবে। যার মানে দাঁড়ায়, প্রথম টেস্ট থেকে ওয়ানিন্দু হাসরাঙ্গা চোট না পেলে, কিংবা স্পিননির্ভর উইকেটে বাড়তি স্পিনারের প্রয়োজন না পড়লে হয়তো দ্বিতীয় টেস্টে খেলাই হতো না জয়াবিক্রমার। তবে শেষমেশ দ্বিতীয় টেস্টে তিনি খেললেন, আর তাতেই করলেন বাজিমাত। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে অভিষেকে তার চেয়ে বেশি উইকেট আছে কেবল চার জনের। তার মধ্যে বাঁহাতি স্পিনার নেই একজনও। অভিষেকে বাঁহাতি স্পিনে এতদিন সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড ছিল এ্যালফ ভ্যালেন্টাইনের। ১৯৫০ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ম্যানচেস্টারে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১১ উইকেট নিয়েছিলেন ২০৪ রানের বিনিময়ে। ৭১ বছর ধরে অক্ষত থাকা সেই রেকর্ড ভেঙে দিলেন জয়াবিক্রমা। পাল্লেকেলেতে ২২ বছর বয়সী এই স্পিনার প্রথম ইনিংসে ৯২ রানে নেন ৬ উইকেট। গড়েন অভিষেকে শ্রীলঙ্কার হয়ে ইনিংসে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড। আগের সেরা ছিল ১৯৯৯ সালে ঢাকায় পাকিস্তানের বিপক্ষে উপুল চন্দনার ১৭৯ রানে ৬ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৬ রানে জয়াবিক্রমা নেন ৫ উইকেট। চতুর্থ দিন নিয়েছিলেন দুটি। পঞ্চম দিনের শুরুতেও আঘাত হানেন তিনি। এলবিডব্লিউ করে বিদায় করেন লিটন দাসকে, নেন ম্যাচে নিজের নবম উইকেট। আর তখনই টেস্টে শ্রীলঙ্কার হয়ে অভিষেকে সেরা বোলিংয়ে রেকর্ডটা নিজের করে নেন জয়াবিক্রমা। আগের রেকর্ড ছিল বাংলাদেশের বিপক্ষেই, ২০১৮ সালে ঢাকা টেস্টে আকিলা দনাঞ্জয়ার ৪৪ রানে ৮ উইকেট। ২২ বছর ২১১ দিন বয়সে ১০ বা তার বেশি উইকেটের স্বাদ পেলেন জয়াবিক্রমা। শ্রীলঙ্কার হয়ে কেবল চামিন্দা ভাসই তার চেয়ে কম বয়সে পেয়েছেন ১০ উইকেট। ১৯৯৫ সালে নেপিয়ারে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৯০ রানে ১০ উইকেট নেওয়ার সময় বাঁহাতি এই পেসারের বয়স ছিল ২১ বছর ৪৩ দিন। যেন এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। ইতিহাসের প্রথম বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে অভিষেকেই দশ উইকেট নিয়ে, বাংলাদেশকে নাচিয়ে ম্যাচসেরার পুরস্কারটাও বগলদাবা করা জয়াবিক্রমা তো তেমন বলতেই পারেন। তার অজস্র রেকর্ডগড়া ১১ উইকেটে ভর করেই যে দল পেয়েছে ২০৯ রানের দারুণ এক জয়! প্রথম ইনিংসে সাইফ হাসানকে ফিরিয়ে শুরু। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, লিটন দাসের উইকেট গেছে তার ঝুলিতে। তাসকিন আহমেদ ও মেহেদি হাসান মিরাজের উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের লেজটা মুড়ে দেয়ার কাজও করেছিলেন তৃতীয় দিনে। টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ইনিংসে পাঁচ উইকেটের কীর্তি জয়াবিক্রমার আগে আরও ১৫৮ জনের আছে। এ তালিকায় ১৫৯তম সংযোজন হলেন তরুণ লঙ্কান স্পিনার। দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হতেই আবারও তার আঘাত। দারুণ সব ফ্লাইট, লুপের ব্যবহারে সাইফ, নাজমুল হাসান শান্ত, মিরাজ, লিটন ও আবু জায়েদকে ফেরালেন। তাতে দুই ইনিংসে পাঁচ উইকেটের দেখাও পেয়ে গেলেন। স্বভাবতই ম্যাচসেরার পুরস্কার পাওয়া এ স্পিনার বলেন, ‘অভিষেক ম্যাচ কিছুটা হলেও চাপ ছিল আমার ওপর। কিন্তু অধিনায়ক ও সিনিয়র খেলোয়াড়রা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। নিজের পরিকল্পনামতো বোলিংয়ে সাফল্য পেয়েছি।’ তরুণ স্পিনারের বোলিং কিংবদন্তি রঙ্গনা হেরাথের সঙ্গে তালুনা করে শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক দিমুথ করুনারতেœ বলেন, ‘সে তার কাজ শতভাগ করেছে। খুব সহজেই সাফল্য পেয়েছে। সে সঠিক জায়গায় বল পিচ করাতে পারছে। আমরা এই কাজটা করতে দেখেছি রঙ্গনা হেরা থেকে। তিনি ব্যাটসম্যানদের খেলার সুযোগ করে দিত এবং তাতে উইকেটের সুযোগ তৈরি হতো। আপনি যখন এ পর্যায়ের ক্রিকেট খেলবেন তখন আপনাকে লাইন ও লেংথ ধরে রাখতে হবে। এটাই তার সাফল্যের মূল রহস্য।’ ব্যাট হাতে দিমুথ করুনারতেœর কথাও আলাদা করে না বললেই নয়। পাল্লেকেলেতে চলতি সিরিজে তিন ইনিংস খেলে লঙ্কান অধিনায়ক করুনারতেœর রান ৪২৮। বাংলাদেশের বিপক্ষে ‘অধিনায়ক’ হিসেবে এক সিরিজে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড এটিই। প্রথম টেস্টে একমাত্র ইনিংসে করুনারতেœ রান ছিল ২৪৪। বাংলাদেশের বিপক্ষে অধিনায়ক হিসেবে যা সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ড। এরপর দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১১৮ রানের ইনিংসের পথেই সিরিজের রেকর্ডও নিজের করে নেন তিনি। দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে সেই রেকর্ড সমৃদ্ধ করেন আরও। চতুর্থ দিন সকালে আউট হন ৬৬ রানে। সব মিলিয়ে তিন ইনিংসে ১৪২.৬৬ গড়ে ৪২৮ রান। ‘অধিনায়ক’ হিসেবে বাংলাদেশের বিপক্ষে এক সিরিজের সর্বোচ্চ রানের আগের রেকর্ড ছিল এ্যালিস্টার কুকের। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সফরে নিয়মিত অধিনায়ক এ্যান্ড্রু স্ট্রসের বিশ্রামে নেতৃত্ব দেন কুক। চার ইনিংসে সেবার কুকের রান ছিল ৩৪২, গড় ১১৪। কুক ছাড়িয়েছিলেন মাহেলা জয়াবর্ধনেকে। ২০০৭ সালে শ্রীলঙ্কায় ৩ ইনিংসে জয়াবর্ধনের রান ছিল ৩৪১, গড় ১১৩.৬৬।
×