ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অর্ধশত ব্যবসায়ী ও ক্রেতাকে জরিমানা

স্বাস্থ্যবিধি না মানায় চায়না টাউন মার্কেট বন্ধ, পরে খুলে দেয়া হয়

প্রকাশিত: ২৩:২১, ৫ মে ২০২১

স্বাস্থ্যবিধি না মানায় চায়না টাউন মার্কেট বন্ধ, পরে খুলে দেয়া হয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঈদ সামনে রেখে মার্কেট ও দোকানপাটে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলা হলেও অনেকেই তা মানছেন না। এজন্য স্বাস্থ্যবিধি মানাতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ভ্রাম্যমাণ আদালত কয়েকটি মার্কেটে অভিযান চালিয়েছে। এ সময় স্বাস্থ্যবিধি না মানার অভিযোগে রাজধানীর পল্টনে চায়না টাউন মার্কেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পরে কয়েক ঘণ্টা পর মার্কেটটি খুলে দেয়া হয়েছে। এদিকে নিউমার্কেট ও বসুন্ধরা মার্কেটে স্বাস্থ্যবিধি না মানায় অর্ধ শতাধিক ব্যবসায়ী ও ক্রেতাকে জরিমানা করেছে ডিএমপির ভ্রাম্যমাণ আদালত। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, মঙ্গলবার সকাল থেকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট সমন্বয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিভিন্ন মার্কেটে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে অভিযান নামে। সকালে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি রাজধানীর পল্টনে চায়না টাউন মার্কেটে অভিযান চালায়। এ সময় ওই মার্কেটে ক্রেতা ও বিক্রেতার স্বাস্থ্যবিধি না মার্কেটটি বন্ধ করে দেয়া হয়। দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন জানান, মাস্ক নিশ্চিত না করলে মার্কেট বন্ধ করে দেয়া হবে বলে আগেই সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল। তিনি জানান, অন্য কোন মার্কেটও যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানে, সেগুলোও বন্ধ করে দেয়া হবে। চায়না টাউন মার্কেট বন্ধ করে দেয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, মার্কেটে আসা অধিকাংশ মানুষের মুখে মাস্ক ছিল না। এমনকি দোকানদারদের মুখেও মাস্ক ছিল না। মার্কেটের প্রবেশদ্বারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ছিল না। ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ লেখা ব্যানার ছিল না। এর আগে নানাভাবে গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চায়না টাউন মার্কেট যে স্বাস্থ্যবিধি মানছে না তার তুলে ধরা হয়। পরে মঙ্গলবার সকালে ডিএমপি ভ্রাম্যমাণ আদালতে ওই মার্কেটে গিয়ে স্বাস্থ্যবিধি না মানার সত্যতা মেলে। দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন জানান, আমরা সবসময় চেয়েছি মার্কেট খুলে দিতে। তবে মার্কেট খোলার আগে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার শর্ত দেয়া ছিল। যদি সেটা করতে পারে, তাহলে আজকেই মার্কেট খুলে দেয়া হবে। আমরা একে একে অন্য মার্কেটেও যাব। চায়না টাউন মার্কেট বন্ধ করে সব মার্কেটকে কঠোর বার্তা দেয়া হলো। আমরা যা বলেছি তা করব। এদিকে দুপুরে দিকে চায়না গার্ডেন মার্কেটটি মুখে দেয়া হয়। এ সময় বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন জানান, মার্কেট কমিটির পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মানার মুচলেকা নিয়ে মার্কেট খুলে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে চাই। বন্ধ করে দেয়ার পর মার্কেটের পক্ষ থেকে সবধরনের সরঞ্জামাদি কিনে আমাদের মুচলেকা দেয়ার পরে মার্কেট খোলার অনুমতি দেয়া হয়েছে। হেলাল উদ্দিন জানান, আমরা কঠোর হয়েছি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও কঠোর হতে বলেছি। যেখানে স্বাস্থ্যবিধি মানা হবে না, সেখানেই জরিমানার বিধান থাকবে। মার্কেট বন্ধ হবে। বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে ॥ এদিকে এদিন দুপুরে এক যোগে ডিএমপির দু’জন ম্যাজিস্ট্রেট রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে ও নিউমার্কেট এলাকায় একযোগে অভিযান শুরু করেন। অভিযানে স্বাস্থ্যবিধি না মানায় রাজধানীর পান্থপথে বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে অভিযান চালিয়ে ১৭ জনকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ডিএমপির ভ্রাম্যমাণ আদালত। ওই শপিং কমপ্লেক্সে অভিযানে কারও নাকের নিচে, কারও হাতে, কারও থুতনিতে মাস্ক থাকায় এই জরিমানা করেন ডিএমপির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শেখ রফিকুল ইসলামের ভ্রাম্যমাণ আদালত। বসুন্ধরার নিচ তলায় পূর্ব পাশ থেকে অভিযান শুরু করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শেখ রফিকুল ইসলাম। বসুন্ধরা শপিংমলের পূর্ব পাশে অভিযান শুরুর পরই নাকের নিচে মাস্ক পরে ঘোরাফেরার সময় নিশাদ নামে এক দোকান কর্মচারীকে ২০০ টাকা জরিমানা করা হয়। এরপরই নিচ তলার ওই অংশে বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যদিও তখন শপিংমলের অন্যান্য ফ্লোরে বিদ্যুত সংযোগ ছিল। অভিযান চলাকালে দেখা যায়, দোকানের সামনে যাওয়া মাত্রই বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছিল। এক রকম অন্ধকারের মধ্যেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করেন ম্যাজিস্ট্রেট শেখ রফিকুল ইসলাম। অভিযানে এক পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট শেখ রফিকুল ইসলামের নজর আসে শাওমির মোবাইল শো রুমে মাস্ক না পরেই কাস্টমারের সঙ্গে কথা বলছিলেন কর্মচারী আহসান। পরে তাকে ৫০০ টাকা জরিমানার আদেশ দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় ইমরান ফ্যাশনসের কর্মচারী মাস্ক না পরে কোরান শরীফ পড়ছিলেন। এ সময় দোকানে কোন কর্মচারী ছিলেন না। অনেক অনুনয়-বিনয় করেও জরিমানা থেকে বাঁচতে পারেননি তিনি। তাকে ১০০০ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। বসুন্ধরা শপিং সিটি শপিং কমপ্লেক্সে কেনাকাটা করতে আসা সাতজন ক্রেতার হাতে ও থুতনিতে মাস্ক নিয়ে ঘোরাফেরা করায় তাদের জরিমানা করা হয়। মোঃ ওয়ারেশ তার স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে কেনাকাটা করতে আসেন। এ সময় তার স্ত্রীর মুখে মাস্ক না থাকায় ২০০ টাকা জরিমানা করে ডিএমপির ভ্রাম্যমাণ আদালত। জরিমানা মুখে পড়ে ওয়ারেশের স্ত্রী রোখসানা জানান, পুরো মার্কেটে বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন। ভ্যাপসা গরম। মুখে মাস্ক রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। যখনই মাস্ক খুলে হাতে নিয়েছি তখনই ম্যাজিস্ট্রেট জরিমানা করেছে। দ্বিতীয় তলার হোলসেল মার্কেটে মুখে মাস্ক না পরা ক্রেতাদের ঢুকতে দেয়ার অপরাধে কর্মচারী সাদিক ও একই অপরাধে সোগোর মালিক সাইফুল ইসলামকে ১০০০ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। মার্কেটে বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ায় তিন তলার ওপরে যেতে পারেননি ডিএমপির ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় মার্কেটের সব লিফট ও এসকেলেটর বন্ধ থাকে। তাই মোবাইল কোর্টের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ দলটি তিন তলার ওপরে যেতে পারেননি। তবে কয়েক জনকে মাস্ক না পরার জন্য জরিমানা করেছেন মোবাইল কোর্ট। নিউমার্কেটে স্বাস্থ্যবিধি সচেতনতায় অভিযান ॥ মঙ্গলবার দুপুর ১২টা থেকে ডিএমপির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সঞ্জিব দাসের নেতৃত্বে নিউমার্কেটের ১ নম্বর গেটে প্রবেশপথ থেকেই অভিযান শুরুর সময় দু’জনকে ১০০ ও ২০০ টাকা জরিমানা করা হয়। দুজনেই মার্কেটের দোকান কর্মচারী। তারা মাস্ক ছাড়াই মার্কেটে প্রবেশ করছিলেন। তবে তাদের দাবি মাস্ক পরেই তারা এসেছিলেন। মাস্ক গরমে ভিজে যাওয়ায় মার্কেটের সামনে রিক্সা থেকে নেমে নতুন মাস্ক কিনতে লোক খুঁজছিলেন। না পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করেই ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে পড়ে যান। তাদের জরিমানা আদায়ের পরই একজন মাস্ক থুতনির নিচে নামিয়ে ঘোরাফেরা করছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট দেখে তাড়াহুড়া করে মুখে মাক্স পরতে গিয়ে ধরা পড়েন তিনি। এ সময় তিনি ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, বিশ্বাস করেন স্যার, এইমাত্র থুথু ফেলতে মাস্কটা একটু খুলেছিলাম। আর আপনি আইয়া পড়ছেন। আপনারে দেইখ্যা তাড়াহুড়া করে মাস্ক পরছি। এই বারের মতো মাফ কইরা দ্যান, জরিমানা কইরেন না। এ সময় ডিএমপি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ডাঃ সঞ্জিব দাস তাকে বলেন, করোনার সংক্রমণরোধে মাস্কই এখন সবচেয়ে বড় টিকা। আপনি যেহেতু ভুল স্বীকার করেছেন, তাই ১০০ টাকা জরিমানা করা হলো। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে থাকা সহকারী নাম-ঠিকানা লিখে ১০০ টাকার স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে জরিমানা আদায় করেন। ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখে মার্কেটের নিরাপত্তারক্ষীরাও হ্যান্ড মাইকযোগে মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বারবার ঘোষণা দিচ্ছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেটের অভিযানের খবর ছড়িয়ে পড়লে ফুটপাথ ও দোকানের অধিকাংশ বিক্রেতা মুখে মাস্ক পরেন। ম্যাজিস্ট্রেট চলার পথে প্রতিটি দোকানে নজরদারি করতে থাকেন। এ সময় এশিয়ান জুয়েলার্স নামে একটি দোকানে তার নজর পড়ে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত সুসজ্জিত জুয়েলারির এ দোকানে ভেতরে কাউন্টারে একজন মাস্ক নিচে নামিয়ে রেখে বসেছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট দেখে তিনি মাস্ক পরেন। এ সময় ম্যাজিস্ট্রেট ভেতরে প্রবেশ করে বলেন, মাস্ক থেকেও না পরে থাকা আর মাস্ক না থাকা একই কথা। মাস্ক পরিধান করে থাকলে নিজেই করোনার সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাবেন, অন্যরাও রক্ষা পাবেন। পরে মাস্ক না পরার অপরাধে তাকে ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়। একইভাবে জুতার দোকানের এক কর্মচারী ম্যাজিস্ট্রেট দেখে মাস্ক পরায় তাকে প্রথমে ৩০০ টাকা জরিমানা করা হয়। দোকান কর্মচালী অনুরোধ করলে তা কমিয়ে ২০০ টাকা করা হয়। এদিকে নিউমার্কেটের ৪ নম্বর গেট সংলগ্ন অমিত এ্যান্ড ব্রাদার্স নামে একটি কাপড়ের দোকানে চলছে ঈদের কেনাকাটা। কিন্তু ভেতরে থাকা এক ক্রেতা ও একজন সেলসম্যান মুখে পরেননি মাস্ক। দূর থেকে ম্যাজিস্ট্রেট এই দৃশ্য দেখে ওই দোকানে প্রবেশ করেন। পরে ক্রেতা ও কর্মচারীর মুখে মাস্ক না থাকায় দোকানিকে ১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া ম্যাজিস্ট্রেট ডাঃ সঞ্জিব দাস জানান, সরকার যেদিন থেকে বিধিনিষেধ ঘোষণা করেছে সেদিন থেকেই আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমরা চাচ্ছি জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য উৎসাহিত করতে। আমরা বলতে চাই, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই চলবে তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে। এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণ অভিযান পরিচালনা করব। জনগণ যদি সচেতন না হয় তাহলে অভিযানের সুফল মিলবে না। এর আগে সোমবার জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, মঙ্গলবার থেকে নো মাস্ক নো সার্ভিস। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। গত ২৪ এপ্রিল থেকে করোনার সংক্রমণ রোধে চলমান বিধিনিষেধের মধ্যেই মার্কেট ও দোকানপাট খোলা রাখার অনুমতি দিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্ত দেয়া হলেও অনেকের মাঝেই এ ব্যাপারে অনীহা দেখে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনের বিষয়ে সোমবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, রবিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটা মিটিং হয়েছে। সেখানে সুপারিশ করা হয়, আজ সেই বিষয়ে ক্যাবিনেট সিদ্ধান্ত দিয়েছে- আজ থেকে পুলিশ, সিটি কর্পোরেশন, ম্যাজিস্ট্রেট ও এ্যাডমিনিস্ট্রেশন দেশের প্রত্যেকটি মার্কেট সুপারভাইজ করবে। মার্কেটে এত লোক হয়তো কন্ট্রোল করা যাবে না। কিন্তু মাস্ক ছাড়া যদি বেশি লোকজন ঘোরাফেরা করে প্রয়োজনে আমরা সেসব মার্কেট বন্ধ করে দেব। ক্লিয়ারলি এটা বলে দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, দোকান-মালিক সমিতির সভাপতিরা আমাদের সহযোগিতা করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। তারা নিজেরাও এটা সুপারভাইজ করবেন।
×