ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মালিক ও চালকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ৫ মে ২০২১

মালিক ও চালকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা

সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর ॥ শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ির বাংলাবাজার পুরনো ঘাটে বালুবোঝাই একটি বাল্কহেডের সঙ্গে ধাক্কা লেগে স্পিডবোট দুর্ঘটনায় তিন শিশুসহ ২৬ জনের মৃত্যুর ঘটনায় স্পিডবোটের ২ মালিক, চালক ইজারাদারসহ ৪জনের বিরুদ্ধে শিবচর থানায় মামলা দায়ের করেছে নৌপুলিশ। সোমবার রাতে চরজানাজত নৌফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই লোকমান হোসেন বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলার বিবাদীরা হলেন শিমুলিয়া ঘাটের ইজারাদার শাহ আলম খান, স্পিডবোটের মালিক কান্দু মোল্লা ও রেজাউল হক এবং চালক শাহ আলম। এ ছাড়া অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। দুর্ঘটনায় জীবিত উদ্ধার আহত চালক শাহ আলম বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শিবচর উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া থেকে সোমবার সকালে ৩১ যাত্রী নিয়ে বড় আকারের একটি স্পিডবোট শিবচরের বাংলাবাজার ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে আসে। সকাল প্রায় ৭টার দিকে কাঁঠালবাড়ি বাংলাবাজার পুরনো ঘাটের অদূরে পদ্মা নদীতে নোঙ্গর করা বালুবোঝাই একটি বাল্কহেডের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা লেগে স্পিডবোটটি দুমড়ে মুড়চে পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যায়। এ সময় সব যাত্রীরা বাল্কহেডের গায়ে ছিটকে পড়ে মাথা ফেটে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে মারাত্মক জখম হয় এবং জ্ঞান হারিয়ে পানিতে ডুবে যায়। পরে নদী থেকে একে একে ২৫ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করে শিবচর উপজেলা হাসপাতালে ও পাচ্চর রয়েল হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন মারা যান। সোমবার বিকেল পর্যন্ত ২৬ জনের মরদেহ তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর এবং সরকারী ব্যবস্থাপনায় এ্যাম্বুলেন্সে করে প্রেরণ করা হয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য খুলনার তেরোখাদার মীমের পরিবারের ৪ জন। এদিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রত্যেককে ২০ হাজার করে টাকা দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন। নিহত তাহের মীরের বাড়িতে মাতম ॥ স্পিডবোট সংঘর্ষে নিহত ২৬ জনের মধ্যে একজন মাদারীপুর জেলার রাজৈরে তাহের মীরের বাড়িতে চলছে মাতম। মঙ্গলবার সকালে নিহতের বাড়ি গিয়ে জানা গেছে, নিহত তাহের মীর (৩৫) রাজৈর উপজেলার বদরপাশা ইউনিয়নের শংকরদী গ্রামের তারা মিয়ার ছেলে। মা, স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তার সংসার। তাহের ঢাকার উত্তরায় একটি দোকানে ফার্নিচারের কাজ করত। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল তাহের। তাকে হারিয়ে নির্বাক হয়ে পড়েছেন সংসারের সকল সদস্য। রবিবার রাতে সেহরি খাওয়ার সময় তাহের তার স্ত্রীকে মোবাইলে ফোন করে বলেছিলেন, ‘আমি বাড়িতে এসে ঈদের মার্কেট করে দিব। এখন আমাদের মার্কেট কে করে দিবে।’ বার-বার মূর্ছা গিয়ে এমন কথা বলছিলেন নিহত তাহের মীরের স্ত্রী সুফিয়া বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার শাশুড়ি হাসিনা বেগম (৬৫) ছেলে সাব্বির মীর (১৮), বড় মেয়ে তানহা আক্তার (১৪) ও ছোট মেয়ে রাদিয়া আক্তার (৭)। আমার ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া করে। এখন কিভাবে এদের ভরণপোষণ ও লেখাপড়ার খরচ চালাব আপনারাই বলেন।’ মীমের সামনে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যত ॥ দাদির মৃত্যুর খবর পেয়ে গ্রামের বাড়ি খুলনার তেরোখাদার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল ছোট্ট মীম ও তার পরিবার। ঢাকার মিরপুরের ভাড়া বাসা থেকে মা, বাবা আর ছোট দুই বোনের সঙ্গে মীম সোমবার সকাল ৬টার দিকে শিমুলিয়া ঘাট থেকে স্পিডবোটে ওঠে। কিছুক্ষণের মধ্যে কানায় কানায় যাত্রী বোঝাই করে স্পিডবোট ছেড়ে দেয় বাংলাবাজারের উদ্দেশে। স্পিডবোট চলাকালে ঘুমিয়ে ছিল মীম। কোলের ওপর ছিল কাপড় ভরা ব্যাগ। দুর্ঘটনার পর পানিতে ব্যাগ বুকে চেপে ভাসমান অবস্থায় পদ্মা নদীতে নিজেকে আবিষ্কার করে মীম। এ সময় কেউ একজন এসে তাকে পানি থেকে উদ্ধার করে। হাত ও চোখের কাছে সামান্য আঘাত থাকায় দ্রুত পাঁচ্চর রয়েল হাসপাতালে নেয়া হয় মীমকে। দুপুরে সেখানে কথা হয় মীমের সঙ্গে। তার অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কাঁঠালবাড়ির দোতারা স্কুল প্রাঙ্গণে। সেখানেই মীম তার মা-বাবা ও দুই বোনের লাশ শনাক্ত করে। তাদের মরদেহ দেখে চিৎকার দিয়ে ভেঙ্গে পড়ে মীম। শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসের কর্মচারী জাকির হোসেন ও বাংলাবাজার স্পিডবোট ঘাটের নৈশপ্রহরী দেলোয়ার ফকিরের তত্ত্বাবধানে তখন শিশুটি হাসপাতালের একটি কক্ষে দুপুরের খাবার খাচ্ছিল। কাঁদতে কাঁদতে মীম বলছিল, তার সঙ্গে মা, বাবা ও ছোট দুই বোন ছিল। দুর্ঘটনার পর কাউকে দেখতে পায়নি সে। তার কোন স্বজনও আসেনি। তার বাবা-মা ও বোনেরা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে জানা নেই তার। তবে মা যে মরে গেছে শিশুমনে তা জানান দিয়েছে আগেভাগেই। সরকারী চাকরি করা হলো না শাহাদাতের ॥ পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ শাহাদাত হোসেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবে মাস্টার্স শেষ করে সরকারী চাকরির জন্যে বিভিন্ন দফতরে আবেদন করেছে। ঈদে বাড়ি ফেরার পথে সোমবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে পদ্মার বুকে বাল্কহেডের সঙ্গে স্পিডবোটের সংঘর্ষে প্রাণ হারায় সে। শাহাদাত হোসেন মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার দ্বিতীয়াখ- ইউনিয়নের নেয়ামতকান্দি গ্রামের বাসিন্দা। পরিবারের লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, শিবচর উপজেলার দ্বিতীয়াখ- ইউনিয়নের আদম আলী মোল্লার ৬ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ শাহাদাত হোসেন। সবার ছোট হওয়ায় তার পড়াশোনার দিকে পরিবারের সকলের নজর ছিল বেশি। শাহাদাতও মেধার স্বাক্ষর রেখেছে প্রতি ক্লাসে। শাহাদাতের বড়ভাই সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সব আশা-ভরসা শেষ হইয়া গেলো। আমরা অন্য ভাই-বোন বেশি পড়াশোনা করতে পারি নাই। আমাদের ছোট ভাই, কলিজার টুকরাকে পড়াশোনা করাইছি। সে বড় চাকরি করে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। সেটা আর হলো না। এখন আমরা কি নিয়া বাঁচুম।’ বরিশালের নিহতদের দাফন ॥ স্টাফ রিপোর্টার বরিশাল থেকে জানান, মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ি ঘাটসংলগ্ন এলাকায় স্পিডবোট দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে চারজনের বাড়ি বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায়। এরমধ্যে তিনজনের বাড়ি একই গ্রামে। নিহতদের মরদেহ মঙ্গলবার সকালে নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছলে স্বজনদের আহাজারিতে পুরো এলাকার আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। মেহেন্দিগঞ্জ সদর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মনির হোসেন জানান, মঙ্গলবার সকালে নিহতদের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছার পর জানাজা শেষে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।
×