ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ৫ মে ২০২১

বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

কেউ কেউ বলে থাকেন আন্তর্জাতিক স¦ীকৃতি ছাড়া কি করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ হয়? কি করে ১০ এপ্রিল ১৯৭১-এর মুজিবনগর সরকার ও তার শপথ গ্রহণ ১৭ এপ্রিল বৈধ হয় ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে এসব প্রশ্নকর্তাদের মাথায় এখনও বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করার মানসিকতাই ঘুরপাক খাচ্ছে যেন। এ প্রসঙ্গে আলোচনার স্বার্থে তিনটি বিষয় ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। যথা- ১) রাষ্ট্র (রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব) ২) সার্বভৌমত্ব ও ৩) স্বীকৃতি। এ বিষয়গুলো পরিষ্কার জানা থাকলে উপরোক্ত অবান্তর প্রশ্ন নিয়ে তারা ঘুম হারাম করবেন না। রাষ্ট্র হলো নির্দিষ্ট ভূখ-, নির্দিষ্ট জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট সরকার ও সার্বভৌমত্বের কম্বিনেশনের এক অবয়ব। প্রধানত এ ৪টি মৌল উপাদানের অস্তিত্বশীলতাই হলো রাষ্ট্র। ১৯৩৩ সালের মন্টিভিডিও কনভেনশনের ধারা ১ অনুযায়ী একটি রাষ্ট্রের নি¤েœাক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো অপরিহার্য- * রাষ্ট্রের একটি যুক্তিসঙ্গত জনসমষ্টি বিদ্যমান থাকতে হবে * এর একটি সুনির্দিষ্ট ভূখ-ের অস্তিত্ব থাকতে হবে * এর জনসমষ্টিকে পরিচালনার জন্য একটি সরকারের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকতে হবে * বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের যোগ্যতা এবং ক্ষমতা থাকতে হবে। এবার রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কি তা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। অন্য রাষ্ট্রের কিংবা তার সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে রাষ্ট্রের সরকারের নিজস্ব ক্ষমতা অনুযায়ী নিজ রাষ্ট্রের জনগণ, সব ধরনের প্রতিষ্ঠান, সংঘ ও রাষ্ট্রীয় সীমানার অভ্যন্তরীণ যাবতীয় বিষয়ের ওপর চরম ক্ষমতা প্রয়োগ করতে সক্ষম হওয়া এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে নিজ রাষ্ট্রকে রক্ষা করার ক্ষমতাই রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব। আর যখন রাষ্ট্রের এ সাবভৌমত্ব রয়েছে বলে তার জনগণ প্রকৃতপক্ষেই ধারণা পোষণ করে, তখন জনগণ রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ঘোষণা করতে সক্ষম হয়। বস্তুত রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব হলো সরকারের চরম ক্ষমতা, যা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এবার স্বীকৃতি বিষয়ে আলোকপাত করা যাক। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি (Recognition) বা সরকারের স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক আইনের বিষয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়ও বটে। কোন সদ্য স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রকে কিংবা রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে পুরনো স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র কর্তৃক মেনে নেয়া অথবা স্বীকার করে নেয়াই আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃতি। অর্থাৎ রাষ্ট্রের অস্তিত্বের গুণাবলী (Qualities of statehood) বা রাষ্ট্রীয় উপদানকে মেনে নেয়াই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। আর তার সরকারের স্বীকৃতি হলো সরকার (Govt.) ক্ষমতাসীন এবং কার্যকর রয়েছে বলে মেনে নেয়া বা স্বীকার করে (acknowledgement) নেয়া। একটি নবগঠিত রাষ্ট্রকে কোন পুরনো বা অন্য স্বাধীন রাষ্ট্র তখনই স্বীকৃতি দেয় যখন বাস্তবসম্মত ধারণা পোষণ করে যে, রাষ্ট্রটির নির্দিষ্ট ভূখ-, জনসমষ্টি, সরকার ও সার্বভৌমত্ব রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক দায়-দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রটির সরকার সক্ষম। আর এটিই স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিধান। যখন ভুটান ও ভারত ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় তার আগেই বাংলাদেশ রাষ্ট্ররূপে অস্তিতশীল হতে কিংবা বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের গুণাবলী অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি ৫৫ হাজার ৫ শত ৯৮ বর্গমাইলের নির্দিষ্ট ভূখ-ের অধিকারী ছিল, সাড়ে সাত কোটি জনসমষ্টি ছিল তার, মুজিবনগর সরকার (১০ এপ্রিল ১৯৭১ এবং শপথ গ্রহণ করে সরকার ১৭ এপ্রিল ১৯৭১) ছিল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা/সার্বভৌমত্ব ছিল, যা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত হয়েছিল এবং অনুমোদিতও হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে। উল্লেখ্য, ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ তথা বাঙালী জাতির জীবনে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এদিন ’৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গণপরিষদ (মোট সদস্য সংখ্যা ৪৬৯ জন) মূলত যা পার্লামেন্ট (তৎকালীন বাংলাদেশের আইনসভা) গঠিত হয়, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদিত হয়, গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ঘোষিত হয়, মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় (যে সরকারে বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ) এবং ১০ এপ্রিলে গঠিত ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ শপথ গ্রহণ করে বলে ১৭ এপ্রিলও আমাদের জাতীয় জীবনে এত হৃদয়স্পর্শী ও গুরুত্বপূর্ণ। আর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশের মুজিবনগর সরকার দেশের আইন, শাসন ও বিচার বিভাগে ক্ষমতাসীন এবং কার্যকর ছিল বলে আইনসম্মতভাবেই বলা যায়। সরকারের অধীনেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ আমরা বাংলাদেশের জনগণ ভারতীয় সৈন্যদের সহযোগিতায় শত্রুমুক্ত হলে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন তাও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলে দেয়া হয়। উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১০ এপ্রিল ১৯৭১-এ Laws Continuance Enforcement order জারি করে বলেন যে, বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে যত ঈরারষ এবং ঔঁফরপরধষ ড়ভভরপবৎ রয়েছে তারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলে যার যার অফিস চালিয়ে যেতে পারবে। অর্থাৎ ১০ এপ্রিলে বাংলাদেশে বিচার বিভাগও অস্তিত্বশীল হয়, যা ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হয় বলেও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রকাশিত হয়। প্রসঙ্গত, মুজিবনগর সরকার রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ছিল। আটলান্টিক চার্টারে রুজভেল্ট ও চার্চিলের বক্তব্য উল্লেখ করা যায় যে, জনগণ যদি চায় এবং তার প্রেক্ষিতে যদি কোন রাষ্ট্রীয় ভূখ-ের পরিবর্তন ঘটে তাহলে এতে কোন অসুবিধার কারণ হতে পারে না। সরকার পদ্ধতি কি হবে তা তারা নিজেরাই নির্ধারণ করবে এবং তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার থাকবে। ভুটান, ভারত, নেপাল, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, বার্মা (মিয়ানমার), সোভিয়েত ইউনিয়নসহ ‘ডধৎংধি ঢ়ধপঃ’ দেশগুলো আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ এবং তৎকালীন মুজিবনগর সরকারকেও স্বীকৃতি দেয়। ভুটান, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭১-এর ৬ ডিসেম্বর (ভারত ৬ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় এবং ভুটান ভারতের আগে স্বীকৃতি দেয় (গণমাধ্যমে প্রকাশিত)। এখানেই আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক আলোচ্য বিষয়টি হলো ‘স্বীকৃতির অতীত কার্যকারিতা’ (Retrospective Effect of Recognition)। স্বীকৃতির অতীত কার্যকারিতা হলো- একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রকে অন্য কোন স্বাধীন রাষ্ট্র যেদিনই স্বীকৃতি দেয় না কেন আন্তর্জাতিক আইন ধরে নেয় যেদিন থেকে রাষ্ট্রটির (স্বীকৃতিপ্রাপ্ত) রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেদিন থেকেই স্বীকৃতি কার্যকর হয়। ২৬ মার্চে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার সময় থেকে অর্থাৎ ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশ যেহেতু সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বশীলতা অর্জন করেছিল, সেদিন থেকেই ভুটান ও ভারতের দেয়া স্বীকৃতি কার্যকর হয় স্বীকৃতির অতীত কার্যকারিতা বা Retrospective effect-এর কারণেই। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ অর্জন করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে Collective Recognition অর্জন করার অধিকারী। যা হোক, যে রাষ্ট্র যত বছর পর Recognition দিয়ে থাকুক না কেন তাতে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, এমনকি রাষ্ট্র গঠনে বা রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বশীলতা বাধাগ্রস্ত হয় না। কারণ স্বীকৃতির অতীত কার্যকারিতার বৈশিষ্ট্যের ফলে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত রাষ্ট্র স্বীকৃতিদানকারী রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়েছে সেদিনই বা সে তারিখে যেদিন বা যে তারিখে রাষ্ট্রটি রাষ্ট্রীয় উপাদান সমন্বিত হয়েছে। এসব বিচারে বাংলাদেশ ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার কারণে ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনের অপঃ ড়ভ state Doctrine-এর অধীনে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার অধিকারী হয়। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও স্বীকৃতির অতীত কার্যকারিতার (Retrospective effect) অধীনে বাংলাদেশ ২৬ মার্চ ১৯৭১ সাল থেকেই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে তার অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতি অর্জন করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
×