ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিরঞ্জন রায়

ডিজিটাল বাংলাদেশে ব্যাংক বন্ধের প্রয়োজন নেই

প্রকাশিত: ২০:৩৮, ৫ মে ২০২১

ডিজিটাল বাংলাদেশে ব্যাংক বন্ধের প্রয়োজন নেই

গত বছর মার্চ মাস থেকে করোনার প্রকোপে বাসা থেকে কাজ শুরু করার মাস ছয়েক পর আমার এক উর্ধতন সহকর্মী ফোন করে দীর্ঘ সময় বাসা থেকে কাজ করার ক্ষেত্রে আমার অনুভূতির কথা জানতে চেয়েছিলেন। তার প্রশ্নের উত্তরে ছোটবেলায় শেখা একটি বিখ্যাত উক্তি ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, আর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’ উদ্ধৃত করে বলেছিলাম যে, কাজ করতে হলে কর্মস্থলেই যেতে হবে। আমার কথার সঙ্গে একমত পোষণ করে তিনি করোনা পরবর্তী অফিসের ধরন সম্পর্কে ধারণা দিয়ে জানালেন যে, করোনা-উত্তর বিশ্বে যখন স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে তখন অফিসে গিয়েই সকলকে কাজ করতে হবে। তবে শতভাগ অফিসে বসে কাজের সুযোগও যেমন হবে না, তেমনি শতভাগ বাসায় থেকেও কাজের সুযোগ থাকবে না। এই দুইয়ের মাঝামাঝি একটি অবস্থা দাঁড়াবে নতুন স্বাভাবিকতা বা নিউ নরমাল, যেখানে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী সব সময় পর্যায়ক্রমে বাসা থেকে কাজ করবেন, আর অবশিষ্টরা অফিসে গিয়েই দায়িত্ব পালন করবেন। অফিস এবং বাসায় পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালনের অনুপাতটি হতে পারে ত্রিশ থেকে চল্লিশ শতাংশের মতো যা নির্ধারিত হবে সেই প্রতিষ্ঠানের অবয়বের ওপর। এই যে নিউ নরমাল নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে সেটিকে মাথায় রেখেই বাংলাদেশের ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে তৈরি হতে হবে। কিছুদিন আগে করোনা নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ হিসেবে কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় প্রথমে ব্যাংক বন্ধ করে, পরবর্তীতে খুলে দেয়া হয়। বর্তমান অর্থ ব্যবস্থা এবং জীবনযাত্রার ধরন এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, তাতে একদিন কেন, এক মুহূর্তের জন্যও ব্যাংক বন্ধ রাখা সম্ভব নয় এবং এর প্রয়োজনও পড়ে না। আবার তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ব্যাংকিং সেবা প্রদানের জন্য সশরীরে উপস্থিত হয়ে ব্যাংক খোলা রাখারও প্রয়োজন হয় না। অনলাইন ব্যাংকিং এখন খুবই জনপ্রিয় এবং প্রকৃত অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রচলনের মাধ্যমে শারীরিক উপস্থিতি ছাড়াই সকল প্রকার ব্যাংকিং সেবা প্রদান করা সম্ভব। এই অনলাইন ব্যাংকিংয়ের বদৌলতেই উন্নত বিশ্ব তো বটেই, অনেক উন্নয়নশীল বিশ্বের ব্যাংকিং খাতও নিরবচ্ছিন্ন ব্যাংকিং সেবা দিয়ে আসছে করোনা মহামারী সংক্রমণের শুরু থেকেই। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতেরও সেটি না পারার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো সেভাবে তৈরি হতে পারেনি। ফলে তাদের সশরীরে উপস্থিত থেকে ব্যাংক খোলা রাখতে হচ্ছে এবং সঙ্কটকালে সরকারকে ব্যাংক খোলা না বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হয়। তবে এখন সময় এসেছে দেশের ব্যাংকিং খাতকে দ্রুত প্রকৃত অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থায় রূপান্তরের। আমাদের দেশে প্রযুক্তিভিত্তিক যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু আছে তাকে পরিপূর্ণ বা প্রকৃত অনলাইন ব্যাংকিং বলা যায় না। একটি সাধারণ ব্যাংকিং ব্যবস্থাই কিছু প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা হয়েছে মাত্র। একটি অনলাইন ব্যাংকং-এর প্রকৃত সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়ত বেশ কঠিন কাজ। এমনকি কোন্ কোন্ শর্ত পূরণ করলে একটি ব্যাংককে অনলাইন ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃত দেয়া যাবে সেটিও নিশ্চিত করে বলা প্রায় অসম্ভব। তবে কোন ব্যাংক যখন তার সকল কার্য সম্পাদনের মাধ্যম হিসেবে বেশ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন করে তখন সেই ব্যাংককে সম্পূর্ণ অনলাইন ব্যাংকিং বলা হয়ে থাকে। এখন পর্যন্ত গৃহীত সেই পদক্ষেপগুলো হচ্ছে (১) অফিস, (২) ডফিস, (৩) হফিস এবং (৪) কাগজবিহীন ব্যাংকিং। কোন ব্যাংক যখন সকল প্রকার কাজকর্ম এই চারটি পদ্ধতির মাধ্যমে সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে এবং এসব কাজের জন্য একজনের সঙ্গে আরেকজনের কোন প্রকার সাক্ষাতের প্রয়োজন হবে না, কিন্তু কাজকর্ম যথারীতি চলতে থাকবে, তখনই সেই ব্যাংক সম্পূর্ণ অনলাইন ব্যাংকিং হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে। অফিস (ঙভভরপব র.ব. ডড়ৎশ ভৎড়স ডড়ৎশঢ়ষধপব)- অফিস আমাদের সকলেরই খুব পরিচিত শব্দ। আমরা অফিস বলতে আমাদের কর্মস্থলকেই বুঝে থাকি। কোন প্রতিষ্ঠান যে নির্দিষ্ট স্থানে তার রিসোর্সগুলো সন্নিবেশিত করে দ্রব্য বা সেবার যোগান, বিতরণ, রেভিনিউ সংগ্রহ, ব্যয় নির্বাহসহ সকল কাজ সম্পন্ন করে সেটিই মূলত অফিস। মোটকথা, কোন প্রতিষ্ঠান তার সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যে নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হয়ে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা করে দেয় সেটিই অফিস। কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে দায়িত্ব পালন করতে হলে তাকে সেই অফিসে যেতে হবে। অফিসে উপস্থিত না হয়ে দায়িত্ব পালনের কোন সুযোগ নেই। তবে এই অফিস (ঙভভরপব) যে নিজস্ব প্রাঙ্গণে হতে হবে তেমন কোন কথা নেই। কোন ভাড়া করা বা বিশেষ ব্যবস্থায় পাওয়া স্থানেও অফিস হতে পারে। ব্যাংকের অধিকাংশ অফিস বিশেষ করে শাখাগুলো ভাড়া করা স্থানেই স্থাপন করা হয়ে থাকে। মূলত কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থাকেই অফিস বলা হয়ে থাকে। এই অফিস সংস্কৃতির সঙ্গে আমরা খুবই সুপরিচিত। ডফিস (উড়ভভরপব র.ব. ডড়ৎশ ভড়ৎস উরংঃধহপব)- এর অর্থ মূলত কর্মক্ষেত্র ব্যতিরেকে যে কোন দূরবর্তী স্থানে বসেই অর্পিত দায়িত্ব পালন করার সুব্যবস্থা। এমন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা যেখানে দায়িত্ব পালনের জন্য সুনির্দিষ্ট স্থান বা অফিসে হাজির হওয়ার প্রয়োজন নেই। কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী যখন যেখানে থাকবেন সেখান থেকেই অনায়াসে এবং নির্বিঘেœ তার দৈনন্দিন দাফতরিক কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন। ধরা যাক একজন কর্মকর্তা বিশেষ কাজে রংপুর গেছেন এবং কোন অনিবার্য কারণে নির্ধারিত দিনে তো ফিরতে পারছেনই না, বরং আরও কয়েকদিন থাকতে হবে। এহেন পরিস্থিতিতে তার দৈনন্দিন কাজের কোনই ব্যাঘাত ঘটবে না যদি সেই প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের ডফিস থাকে। সেই ব্যক্তি রংপুরে থেকে তার ল্যাপটপের মাধ্যমে ব্যাংকের অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করে সমুদয় কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন। কোনরকম সমস্যা হবে না। মূলত কম্পিউটার প্রযুক্তির কারণে মানুষ যেভাবে অফিসে গিয়ে কাজ করে সেখানেও কম্পিউটার চালু করে ব্যাংকের সার্ভারে বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে সেভাবেই কাজ সম্পন্ন করতে পারবে। বিশেষ প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে ব্যাংকের দায়িত্ব পালনের সুযোগকেই ডফিস বলা হয়ে থাকে। হফিস (ঐড়ভভরপব র.ব. ডড়ৎশ ভৎড়স ঐড়সব)- এই ব্যবস্থাও মোটামুটি ডফিসের মতোই। মানুষ যখন কর্মস্থলে না গিয়ে নিজের বাসায় থেকেই তার দৈনন্দিন দাফতরিক কাজকর্ম সম্পাদন করতে পারে তখন তাকে হফিস বলা হয়ে থাকে। কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী অফিসে না গিয়ে তার বাসায় বসে কম্পিউটারের মাধ্যমে ব্যাংকের সার্ভারে বা অনলাইন পোর্টালে সংযুক্ত হয়ে যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন। এজন্য যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়ে থাকে তা ডফিসের মতো অত উন্নতমানের না হলেও চলে। ডফিসের মতো হফিসও আমাদের কাছে এখন খুব পরিচিত এক কর্ম সংস্কৃতি। বিশেষ করে করোনা মহামারী এই হফিস সংস্কৃতিকে খুব বেশি করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদী মহামারীর সময়েও যে বিশ্ব অর্থনীতি মহামন্দার কবলে পড়েনি তার মূল কারণ এই হফিস। এই হফিসের কার্যকারিতা এবার খুব ভালভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে উন্নত বিশ্ব তো বটেই, এমনকি অনেক উন্নয়নশীল দেশও। কাগজবিহীন দফতর (চধঢ়বৎষবংং ঙভভরপব)- অনলাইন ব্যাংকিংয়ের বড় বৈশিষ্ট্য হলো যে, কোনরকম কাগজের ব্যবহার প্রয়োজন হবে না। যে কোন ধরনের দলিল, ডকুমেন্ট বা স্বাক্ষরযুক্ত কাগজপত্রও ব্যাংকের সার্ভারে সংরক্ষণ করে রাখা যাবে। কম্পিউটার প্রযুক্তি আনা হয়েছিল এই স্লোগান দিয়ে যে, কাগজের ব্যবহার বহুলাংশে কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছিল তার উল্টো। কেননা মানুষ কারণে-অকারণে এবং প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে যে কোন কিছু নির্বিচারে প্রিন্ট করে। ফলে প্রতিটা অফিস-আদালতে কাগজের ব্যবহার কমার পরিবর্তে আরও বেড়ে গিয়েছিল উল্লেখযোগ্য হারে। অনলাইন ব্যাংকিংয়ের ফলে এখন সেই অবস্থার যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে এবং আগের মতবাদই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। অনলাইন ব্যাংকিং প্রবর্তনের ফলে এখন আর কাগজের ব্যবহার নেই বললেই চলে। সবকিছু বাংকের সার্ভারে অনলাইনের মাধ্যমে সংগৃহীত করে রাখা যায়। কোন ব্যাংক যদি পুরোপুরি অনলাইন ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে চায় তাহলে তাদের সম্পূর্ণ কার্যাবলীকে এমন প্রযুক্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে এবং কাজের ধরন এমনভাবে সুবিন্যস্ত করতে হবে যেখানে অফিস, ডফিস এবং হফিসের সুযোগ থাকবে সমান্তরালভাবে। সেইসঙ্গে দফতর হবে কাগজবিহীন অর্থাৎ পেপারলেস। আগামীতে বিশ্ব যেভাবে নতুন বাস্তবতার সম্মুখীন হতে চলেছে তাতে এরকম প্রকৃত এবং পুরোপুরি অনলাইন ব্যাংকিং এক অনিবার্য বাস্তবতা। তাই এই নতুন বাস্তবতার জন্য আমাদের ব্যাংকিং খাতকে খুব ভালভাবে প্রস্তুত করে তোলার এখনই উপযুক্ত সময়। আর এই কাজটি বিচ্ছিন্নভাবে একেকটি ব্যাংকের পক্ষে করা সম্ভব নয় এবং করলেও কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাবে না। প্রয়োজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বে সমগ্র ব্যাংকিং এবং নন-ব্যাংকিং খাতের জন্য এক সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা। আর এ সংক্রান্ত প্রযুক্তিও এখন যথেষ্ট সুলভ এবং সহজলভ্য। তাছাড়া আগামীতে ব্যাংকিং মানেই প্রযুক্তির ব্যাংকিং। তাই এই খাতে যথাযথ বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই। সরকার যদি ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে পারে তাহলে মুনাফার উদ্দেশ্যে পরিচালিত ব্যাংকিং খাত কেন পারবে না? তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে সব ব্যাংককে বাধ্য করতে হবে প্রকৃত এবং সম্পূর্ণ অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে। ফলে ডিজিটাল বাংলাদেশে আর ব্যাংক বন্ধ রাখার প্রয়োজন হবে না আগামীতে। লেখক : ব্যাংকার, টরনটো, কানাডা [email protected]
×