ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মীমের সামনে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যত

প্রকাশিত: ১৫:৫০, ৪ মে ২০২১

মীমের সামনে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যত

নিজস্ব সংবাদদাতা, মাদারীপুর ॥ দাদীর মৃত্যুর খবর পেয়ে গ্রামের বাড়ি খুলনার তেরোখাদার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল ছোট্ট মীম ও তার পরিবার। ঢাকার মিরপুরের ভাড়া বাসা থেকে মা, বাবা আর ছোট দুই বোনের সঙ্গে মীম সোমবার সকাল ৬টার দিকে শিমুলিয়া ঘাট থেকে স্পিডবোটে ওঠে। কিছুক্ষণের মধ্যে কানায় কানায় যাত্রী বোঝাই করে স্পিডবোট ছেড়ে দেয় বাংলাবাজারের উদ্দেশ্যে। স্পিডবোট চলাকালে ঘুমিয়ে ছিল মীম। কোলের ওপর ছিল কাপড় ভরা ব্যাগ। দুর্ঘটনার পর পানিতে ব্যাগ বুকে চেপে ভাসমান অবস্থায় পদ্মা নদীতে নিজেকে আবিষ্কার করে মীম। এ সময় কেউ একজন এসে তাকে পানি থেকে উদ্ধার করে। হাত ও চোখের কাছে সামান্য আঘাত থাকায় দ্রুত পাঁচ্চর রয়েল হাসপাতালে নেওয়া হয় মীমকে। দুপুরে সেখানে কথা হয় মীমের সঙ্গে। তার অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কাঁঠালবাড়ির দোতারা স্কুল প্রাঙ্গনে। সেখানেই মীম তার মা-বাবা ও দুই বোনের লাশ শনাক্ত করে। তাদের মরদেহ দেখে চিৎকার দিয়ে ভেঙ্গে পড়ে মীম। শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসের কর্মচারী জাকির হোসেন ও বাংলাবাজার স্পিডবোট ঘাটের নৈশ প্রহরী দেলোয়ার ফকিরের তত্বাবধানে তখন শিশুটি হাসপাতালের একটি কক্ষে দুপুরের খাবার খাচ্ছিল। কাঁদতে কাঁদতে মীম বলছিল, তার সঙ্গে মা, বাবা ও ছোট দুই বোন ছিল। দুর্ঘটনার পর কাউকে দেখতে পায়নি সে। তার কোনো স্বজনও আসেনি। তার বাবা-মা ও বোনেরা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে জানা নেই তার। তবে মা যে মরে গেছে শিশুমনে তা জানান দিয়েছে আগেভাগেই। বার বার 'মায় মইরা গেছে বলে ডুকড়ে কাঁদছিল সে। ভাত খেতে খেতে শিশু মীম বলছিল, গ্রামের বাড়ি খুলনার তেরখাদা গ্রামে। গত পাঁচ মাস আগে তাদের পরিবার মিরপুরে বাসা ভাড়া করে বসবাস করছিলো। রবিবার সন্ধায় দাদীর মৃত্যুর খবর শুনে সোমবার তারা গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিল। শিশু মীমের বাবা মনির হোসেন, মা হেনা বেগম, ছোট দুই বোন সুমি (৫) ও রুমি (৩) স্পিডবোট দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। মীমকে উদ্ধারকারী নৌ পুলিশের কনস্টেবল মেহেদী বলেন, ‘শিশুটিকে নদীতে ব্যাগ ধরে ভাসতে দেখি। হাত ও চোখের কাছে সামান্য আঘাতের চিহ্ন ছিল। দ্রুত তাকে পাঁচ্চর রয়েল হাসপাতালে পাঠানো হয়। শিশুটির পরিবারের সব সদস্যই মারা গেছেন।’ মা-বাবা আর বোনদের মৃত্যুর খবর শুনেছে মীম। এতোবড় দুর্ঘটনায় বেঁচে গেলেও মৃত্যুভয়, সেই সঙ্গে আগামী দিনের অজানা শঙ্কা আর সব হারানোর ব্যথায় কাঁদছে আট বছরের মেয়ে ছোট্ট মীম। কান্নারত অবস্থায় মীম বলে, ‘আমরা দাদু বাড়ি যাচ্ছিলাম। রবিবার সন্ধায় দাদী মারা গেছে, তাকে দেখতে। আমার আর কেউ নাই।’সোমবার বিকেলে প্রশাসনের ব্যবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সে বাবা, মা ও দুই বোনের মরদেহসহ মীমকে গ্রামের বাড়ি খুলনার তেরোখাদার পাঠিয়ে দেয়া হয়। মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে খুলনার তেরোখাদা গ্রামে নিহত ৪জনের জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, ‘স্পিডবোট দুর্ঘটনায় শিশু মীমের বাবা, মা ও দুই বোনের মৃত্যু হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সে করে শিশুটিকে এবং নিহত চারজনের মরদেহ তাদের গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়েছে।’ মাদারীপুর স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক এবং জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান মো: আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা গতকালই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। আগামীকাল (৫মে) আমরা আবার পরিদর্শনে যাবো। প্রত্যক্ষদর্শীদের স্বাক্ষাৎকার নিয়ে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে। দুর্ঘটনা কেন ও কি কারণে ঘটেছে তাও খতিয়ে দেখা হবে। সবকিছু বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে যাতে এ ধরণের দুর্ঘটনা না ঘটে; তার একটি সুপারিশমালাসহ সরকারের কাছে উপস্থাপন করবো।’
×