ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ

রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

প্রকাশিত: ২৩:২৪, ৪ মে ২০২১

রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফের রেকর্ড ভেঙ্গে ৪৫ বিলিয়ন ডলার মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। দেশের ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ রিজার্ভ। প্রতি মাসে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে এগারো মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশী মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান রিজার্ভ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। রিজার্ভের দিক দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। যা পাকিস্তানের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। এদিকে মহামারীর মধ্যেও চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) রেমিটেন্স ২ হাজার ৬৭ কোটি ২০ লাখ (২০.৬৭ বিলিয়ন) ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। এক অর্থবছরে মাত্র দশ মাসে এত পরিমাণ রেমিটেন্স এর আগে কখনও দেখেনি বাংলাদেশ। অর্থবছর শেষে রেমিটেন্স ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। জানা গেছে, দেশের জিডিপিতে এই রেমিটেন্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো। বর্তমানে ১৭৪টি দেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখের বেশি বাংলাদেশী শ্রমিক কাজ করছেন। যাদের তিন-চতুর্থাংশ কর্মরত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। করোনা মহামারী শুরুর পরপরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের কর্মীদের দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তবে করোনাভাইরাসের প্রকোপ কিছুটা কমে এলে গতবছরের শেষদিকে অনেক কর্মী আবার বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। ফলে রেমিটেন্স প্রবাহে তেমন একটা প্রভাব পড়েনি। রেমিটেন্সের গতি ধরে রাখতে গত অর্থবছরে দুই শতাংশ হারে প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল সরকার। ব্যাংকাররা বলছেন, ঈদকে কেন্দ্র করে এখন অনেক ব্যাংক রেমিটেন্সে সরকারের ২ শতাংশ প্রণোদনার সঙ্গে বাড়তি ১ শতাংশ প্রণোদনা যোগ করে মোট ৩ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। এছাড়া ঈদের আগে সাধারণত প্রবাসীরা বেশি করে রেমিটেন্স দেশে পাঠান। তবে সারাবছরই করোনার মধ্যে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়াতে সাহায্য করেছে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কেবল দুবাই ও ইতালি থেকে রেমিটেন্স আসা কমেছে। এছাড়া অন্যান্য দেশগুলো থেকে রেমিটেন্স আসা বেড়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স বেড়েছে মালয়েশিয়া ও সৌদি আরব থেকে। তাছাড়া দেশে রেমিটেন্স আহরণে ব্যাংকগুলোর মধ্যেও প্রতিযোগিতা বেড়েছে। এক সময় রেমিটেন্স আহরণে পিছিয়ে থাকা রূপালী ব্যাংক এখন রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধিতে এক নম্বরে আছে। এই ব্যাংকটির রেমিটেন্স আহরণ বেড়েছে ১২৯ শতাংশ। রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধিতে দ্বিতীয় ইসলামী ব্যাংক, ১০২ শতাংশ এবং তৃতীয় অবস্থানে থাকা অগ্রণী ব্যাংকের রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি ৬১ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, প্রবাসী আয় পাঠানোর নিয়াম-কানুন সহজ করা, নগদ প্রণোদনাসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্কারমুখী পদক্ষেপ রেমিটেন্স বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এ অর্জন দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমাদের প্রত্যাশা এটি আরও বাড়বে। এ বিষয়ে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে। কাউকে হয়রানি হতে হয় না, রেমিটেন্স সময়মতো উপকারভোগীর হাতে পৌঁছে যায়। যে কারণে এটি দিন দিন বেড়েই চলেছে এবং বাড়তেই থাকবে।’ রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শামস-উল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কিছুটা খরচ বাড়লেও আমরা ঈদকে কেন্দ্র করে রেমিটেন্সে ২ শতাংশের সঙ্গে বাড়তি আরও ১ শতাংশ প্রণোদনা দিতে চেষ্টা করছি। এটা আমাদের প্রবাসী ভাই- বোনদের কষ্টার্জিত অর্থ বৈধপথে দেশে আনতে উৎসাহ জোগাবে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ২ হাজার ৬৭ কোটি ২০ লাখ (২০.৬৭ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স দেশে এসেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি। এক অর্থবছরের মাত্র দশমাসে এত পরিমাণ রেমিটেন্সের আগে কখনও দেখেনি বাংলাদেশ। এর আগে সর্বোচ্চ রেমিটেন্সের রেকর্ড ছিল ২০১৯-২০ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরে ১ হাজার ৮২০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। এদিকে রেমিটেন্স বাড়লেও আমদানি দায় পরিশোধের তেমন চাপ নেই। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংককে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রচুর ডলার কিনতে হচ্ছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার কেনার পরিমাণ দাঁড়াল ৫৮৮ কোটি ডলার। এছাড়া বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি থেকে প্রচুর ঋণ আসছে। যে কারণে রিজার্ভে একের পর এক রেকর্ড হচ্ছে। রবিবার দিনশেষে রিজার্ভের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ বিলিয়ন ডলার বা চার হাজার ৫০০ কোটি ডলার। প্রতিমাসে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে এগারো মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। এর আগে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রিজার্ভ বেড়ে ৪৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) নবেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশী মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ-এই নয়টি দেশ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পর পর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। রেমিটেন্স বাড়ার কারণে রিজার্ভ বেড়েছে ঠিক। কিন্তু আমদানি ব্যয় কমার ফলে রিজার্ভ বাড়ার একটি কারণ। এছাড়া গত তিন-চার মাসে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের মতো যে বিদেশী ঋণ-সহায়তা এসেছে সেটাও রিজার্ভ বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। সে পরিস্থিতিতে যদি রেমিটেন্স, রফতানি আয়, বিদেশী ঋণ এখনকার মতো না আসে তখন কিন্তু রিজার্ভে চাপ পড়বে।’ এদিকে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিছু বিদেশী ঋণ ও দান অনুদানও। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোঃ সিরাজুল ইসলাম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পাশাপাশি রফতানি আয় বাড়ায় রিজার্ভ নতুন মাইলফলক অতিক্রম করতে চলেছে। করোনাভাইরাস মহামারীতে রেমিটেন্সের গতিতে ছেদ তো পড়েইনি, বরং তা আরও বেড়েছে। রেমিটেন্স ও রফতানি আয়ের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি ও এআইআইবির ঋণ সহায়তাও রিজার্ভ বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শেষদিকে বাংলাদেশের বিদেশী মুদ্রার সঞ্চয়ন এক বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে আসে। এরপর বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন রিজার্ভে ছিল ১ বিলিয়ন ডলারের সামান্য বেশি। সে সময় আকুর বিল বাবদ ২০ কোটি ডলার পরিশোধের কথা ছিল। কিন্তু তাতে রিজার্ভ ১ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসত। রিজার্ভ থেকে ঋণ চায় বেসরকারী খাত ॥ সরকার ইতোমধ্যে রিজার্ভ থেকে ঋণ দিতে বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (বিআইডিএফ) গঠন করেছে। এ তহবিল থেকে ইতোমধ্যে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ার বিষয়ে একটি চুক্তি হয়েছে। এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংক এখন কাজ করছে। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘রিজার্ভ থেকে ঋণ দিলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকির আশঙ্কা আছে। সে বিষয়টি এখনও ভেবে দেখা দরকার। চলমান প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে যেভাবে ঋণ দেয় সে প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই দেয়া উচিত।’
×