ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণ

মোদি ম্যাজিকে তীব্র ঝাঁকুনি

প্রকাশিত: ২০:৪০, ৪ মে ২০২১

মোদি ম্যাজিকে তীব্র ঝাঁকুনি

ভারতের কোভিড-১৯ টাস্কফোর্স কয়েক মাস ধরে কোন বৈঠক করেনি। কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জনগণকে মার্চে আশ্বস্ত করেছিলেন, ভারত মহামারীর বিরুদ্ধে ‘লড়াইয়ের সমাপ্তির’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এর কয়েক সপ্তাহ আগে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেও বিশ্ব নেতাদের সামনে দাবি করেছিলেন, তার দেশ করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ী হয়েছে। খবর নিউইয়র্ক টাইমসের। গত জানুয়ারিতে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ভার্চুয়াল সভায় প্রধানমন্ত্রী মোদি যখন বক্তৃতা করছিলেন, ভিডিওতে তার পেছনে উড়ছিল ভারতের পতাকা। তিনি বলছিলেন, ভারত কার্যকরভাবে করোনাকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মানবজাতিকে একটি বড় বিপর্যয়ের কবল থেকে রক্ষা করেছে। এখন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ভারতকে এই মহামারীতে বিশ্বের সবচেয়ে বিপর্যস্ত দেশে পরিণত করেছে। একদিনে চার লাখ রোগী শনাক্তের নতুন বিশ্বরেকর্ড ভারতকে দেখতে হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় টিকা উৎপাদনকারী দেশ হয়েও টিকার ঘাটতি দেখা দিয়েছে বিভিন্ন রাজ্যে। হাসপাতালে জায়গা নেই, জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেনের মজুদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। বড় বড় শহরে প্রতিদিন শ্মশানগুলোতে হাজারো মানুষের দাহ হচ্ছে, লাশ পোড়া গন্ধ আর ভষ্মে ভারি হয়ে উঠছে বাতাস, আকাশ হয়ে উঠেছে ধূসর, এ যেন অনন্ত মৃত্যুর মিছিল। ভারতের এই উল্টো যাত্রা নতুন এক জাতীয় আলোচনার সূচনা করেছে, যার কেন্দ্রে রয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিশেষজ্ঞরা একটা সময় কিছুটা আশ্চর্য হয়েই ভাবছিলেন কিভাবে জনবহুল দেশটি মহামারীর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে পারল। এখন তারা সেখানকার তুলনামূলক তরুণ জনগোষ্ঠী ও স্বাস্থ্যের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেছেন। এমনকি মোদির সমর্থকরাও এখন বলছেন যে, ভারত একটি বৈশ্বিক পরিস্থিতির শিকার এবং দ্বিতীয় ঢেউ এভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণ বের করতে আরও সময় দরকার। তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মোদির ‘অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস’ এবং তার ‘কর্তৃত্বপরায়ণ নেতৃত্বের’ ধরনের একটি বড় দায় রয়েছে এমন পরিস্থিতির জন্য। সমালোচকরা বলছেন, ঝুঁকি না কাটলেও মোদির প্রশাসন ভারতের এমন একটি ছবি প্রচার করতে চাইছিল, যাতে মনে হয়, দেশ আগের পর্যায়ে ফিরে এসেছে, ব্যবসা-বাণিজ্য আবার চালু হয়েছে। এক পর্যায়ে, প্রশাসনের কর্তারা বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তাও পুরোপুরি উপেক্ষা করেছেন, যেখানে বলা হয়েছিল ভারতের জনগোষ্ঠী এখনও ঝুঁকিতে আছে, এবং ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জিত হয়নি। এসব সতর্কবার্তা নিয়ে আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন এমন কিছু কর্মকর্তাই এখন বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আনছেন। নিজের ব্যক্তিগত ক্যারিশমা এবং বিরোধীদের ‘প্রবলভাবে দমন’ করার মাধ্যমে গত কয়েক দশকের মধ্যে ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজনৈতিক ব্যক্তিতে পরিণত হওয়া মোদির দৃঢ় রাজনৈতিক ভাবমূর্তি এই মহামারীর বিপর্যয়ে অনেকটাই ঔজ্বল্য হারিয়েছে। বিরোধী নেতারা এখন আক্রমণ শানাচ্ছেন এবং তার কর্তৃত্ব তাকে অনলাইনে সমালোচনার লক্ষ্যে পরিণত করেছে। পার্লামেন্ট নির্বাচনের এখনও তিন বছর বাকি, সরকার ভেঙ্গে যাওয়ার মতো কোন পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি। তাই বলা যায়, ক্ষমতা সম্ভবত নিরাপদ। সরকার সঙ্কটাপন্ন রোগীদের জন্য চিকিৎসা সরঞ্জাম নিশ্চিত করার উদ্যোগ জোরদার করেছে এবং টিকাদান কার্যক্রমের পরিধি বিস্তৃত করেছে যেখানে ১৮ বছরের বেশি সবাইকে টিকা দেয়া হবে। তারপরও রোগের বিস্তার ও মৃত্যুর মিছিলের জন্য বহু মানুষ ব্যক্তিগতভাবে তাকেই দায়ী করবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। নয়াদিল্লীর সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের গবেষক আসিম আলি বলেন, মোদির শাসন পদ্ধতিই এই দোষারোপের পেছনে একটি বড় ভূমিকা রাখছে, যেখানে শীর্ষ মন্ত্রীদের বেছে নেয়া হয়েছে তাদের দক্ষতা নয় বরং আনুগত্যের বিবেচনায়, সেখানে স্বচ্ছতার চেয়ে গোপনীয়তা ও ভাবমূর্তি টিকিয়ে রাখার গুরুত্ব বেশি। এ ধরনের শাসন কাঠামোয়, যখন মোদির হাত থেকে বল পড়ে যায়, যেমনটি হয়েছে কোভিড মোকাবেলার ক্ষেত্রে, তখন বিপর্যয়ের পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে।
×