ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ দিবসহীন দেশ ও স্বদেশের শ্রম দিবস

প্রকাশিত: ২০:৩৮, ৪ মে ২০২১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ দিবসহীন দেশ ও স্বদেশের শ্রম দিবস

মে দিবসে মানে ১ মে কাজে যেতে হবে গোড়ায় এটা আমার বিশ্বাসেই ছিল না। পঁচিশ বছর আগের এক মে দিবসে অলসতায় ভর করে শুয়ে আছি আর ওদিকে অফিস আমাকে খুঁজে হন্য। এতো আর আমাদের দেশ না যে, না বলে-কয়ে গায়েব থাকা যাবে বা গায়েব হয়ে গেল কেউ জানবে না অজয়-আলী কোথায়? তখন মোবাইলের চল হয়নি এমন। সিডনিতে মোবাইল পাওয়া যেত, তবে তার দাম ছিল আকাশছোঁয়া। আমার ছিল না বলে বাসার ফোনে খুঁজে হন্যে অফিসের লোকেরা। যত না আমাকে দরকার তার চেয়ে বেশি দায়িত্ববোধে। কোন কর্মচারী বা কর্মকর্তা খবর ছাড়া গায়েব হলে চাকরিদাতাদের খবর আছে। একদিকে জবাবদিহি, আরেকদিকে অর্থদ-। অর্থদ- এই কারণে যে, এদেশে আপনি বাড়ি থেকে বেরুলেই অফিস শুরু। রাস্তায় গায়েব হলেও অফিসের দায় আছে। যাক সে কথা। আমি তো হতভম্বপ্রায়। যে দেশে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য এতটা উদ্বিগ্নতা বা দায়বোধ সে দেশে মে দিবসের দিন অফিসে যাওয়া! পরে জানলাম মে দিবস বলে কিছু নেই। আছে শ্রম দিবস। তাও তার বন্ধ রাজ্যভেদে আলাদা বা পৃথক পৃথক দিনে। আমাদের সিডনিতে অক্টোবর মাসে। এতে এখন আর অবাক বা বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণটা ধরে ফেলেছি। সেটা বলার আগে আমাদের চোখ-কান খুলে সাদা দুনিয়ার হালচাল দেখতে অনুরোধ করি। নিজেদের জন্য এবং যারা এসব দেশের স্থায়ী অভিবাসী বা নাগরিক তাদের বেলায় সবকিছু সহজ আর ঝটপট হলেও বাকিদের জন্য বিষয়টি অত সোজাসাপটা নয়। এই যে মে দিবসের মারপ্যাঁচ এর মূল কারণটা রাজনৈতিক। যেভাবেই হোক এই দিবসের পেছনে যে ঘটনা তার জন্য দায়ী আর তার জন্য সংগ্রাম করে বিজয় ছিনিয়ে আনার দল বা শক্তি এক নয়। এই দিবসের পেছনে যত ধরনের ঔজ্জ্বল্য সব গেছে বা আজও জমা হয় সমাজতান্ত্রিক নামে পরিচিত সাম্যবাদী শিবিরের খাতায়। গণতন্ত্রের ধারক নামে পরিচিত আমেরিকা ও তার মিত্ররা এর ফল মেনে নিলেও এই দিনটির ভেতর যে তেজ ও মেহনতি মানুষের জয়যাত্রা তাকে এরা মানতে নারাজ। ফলে আইএলও বা আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের আওতায় শ্রমিকের জন্য ছুটিটা দিতে হবে বলে এমন এক দিনে বা সময়ে যখন মে দিবসের কোন প্রভাব বা আলো থাকে না। ফলে চতুর ধনবাদ ছুটি মানে, কিন্তু দিবস মানে না। সারা দুনিয়ার যেসব এলাকায় বা দেশে দেশে এ নিয়ে গর্ব আর অহঙ্কার বা উজ্জ্বলতা তা থেকে সযতেœ নিজেদের সরিয়ে রাখে এরা। আমাদের মতো বিরোধিতার নামে হৈচৈ না করেও কৌশলে ঠিক নিজেদের এজেন্ডা হাসিল করে নেয়। মে দিবসের চেতনা সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পরম সম্পদ বলে এরা হয়ত দিনটি এড়িয়ে যায়। কিন্তু এখানে শ্রমের যে আনন্দ আর উদ্ভাস সেটা কি প্রথাগত দিবস পালনের দেশে আদৌ আছে? আমাদের কথাই ধরুন। সকাল বেলায় মিডিয়াজুড়ে ছবি আর কাহিনীতে মে দিবসের উজ্জ্বলতা জানিয়ে যে কর্মচারীটি বাড়ি ফিরে গেল তার হয়ত সে মাসের বেতন জোটেনি ঠিকমতো। যে হকার দোরগোড়ায় কাগজ রেখে গেল সকাল বেলার টিফিনের টাকাই নেই হয়ত তার। চ্যানেলে চ্যানেলে গানে গানে মে দিবসে শ্রমিক আর শ্রমের কথা বলা মানুষটি হয়ত আসার আগেই জুতা পরিষ্কার করিয়ে এসেছে বারো-তেরো বছরের বালিকাকে দিয়ে। আমাদের সমাজের ছবিটাই তো এমন। মে দিবসে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই কর্তার হাঁক চা চাই। গিন্নির ব্যস্ততা আজ ছুটির দিন সকালে চাই ভাল বেলা রুটি, সঠিক তরকারি বা গোশতের পদ। এসব কি আর কেউ নিজে বানায়? এজন্য আছে কাজের বুয়া-আবদুলরা। অথচ এদের জন্যই এ দিবস। এবার এদিককার কথা ভাবুন। যে দেশে মে দিবসের কোন সরকারী ছুটি নেই, যে সমাজে মে দিবসে সবকিছু খোলা, সেখানে কেউ কাউকে অর্ডার করে না। আদেশের কোন বালাই নেই। কে কাকে আদেশ করবে এখানে? সবাই রাজা সবার রাজত্বের দেশে। এক গ্লাস পানি, এক কাপ কফি বা এক মগ চা নিজেকেই বানিয়ে নিতে হয়। কত বড় বড় রেস্তরাঁ, কত নামী-দামী হোটেল। আমাদের পরিচিত এক ইতালিয়ান রেস্তরাঁ ক্যাসেল মোলা। যার অর্থ খাবার দুর্গ। যতবার সেখানে গিয়েছি ততবারই মালিক এসে আমাদের আপ্যায়ন করেছেন। যে যায় তাকেই সমাদর করেন। শুধু সেটা হলেও কথা ছিল। একটি না একটি পদ তিনি নিজ হাতে নিয়ে আসেন। ওয়েট্রেসের দায়িত্বও পালন করেন মালিকরা। করতে হয়। একটা পুরনো গল্পের কথা মনে পড়ছে। আমাদের দেশের এক বড় কর্মকর্তা বদলি হয়ে গিয়েছিলেন বিলেতে। যাওয়ার পরপরই হাঁকডাক। দু-একবার আদেশ দিয়ে চা-কফিও মিলে গিয়েছিল তার। গোল বাধল পরে। একদিন অর্ডার দেয়ার পরও কফি আসেনি। খবর নিতে গিয়ে জানলেন কফি বানানো হয়নি। চোখ কপালে ওঠার জোগাড় তার। কারণ জানতে গিয়ে শুনলেন যাকে কফি বানাতে বলা হয়েছিল তিনি বেঁকে বসেছেন। কেন? তার বক্তব্য সোজাসাপটা, আমি দু-তিনবার বানিয়ে দেয়ার পরও আমার জন্য যিনি কখনও এক কাপ কফি বানাননি তার জন্য আর বানানো অনুচিত। শ্রমের মর্যাদার দেশে এটাই নিয়ম। মিটিং শুরু হবার আগে যিনি চেয়ারপার্সন তিনিই ঠিক করে দেন কে কোন্্ কফি আর চা খাবে। পারলে বানিয়ে দিতেও এক পা এগিয়ে থাকেন এরা। শ্রমের এই মূল্যায়ন আমাদের দেশে নেই। আছে শুধু বড় বড় কথা আর ঘটা করে দিবস পালন। মাঝে মাঝে এগুলো নিছক সৌজন্য আর প্রথা ছাড়া কিছু মনে হয় না। এত রাজনীতিনির্ভর আর কলহপ্রবণ সমাজে কোন দিবসই আসলে ঠিকমতো ঝলসে উঠতে পারে না। মে দিবসটিকে বামরা নিজেদের মতো হাইজ্যাক করার কাজটি করতেও পিছপা হননি। যেন এ তাদের কোন ফসল বা অর্জন। আমরা একবারও ভেবে দেখি না বাম নামে পরিচিতদের বাইরেও এক বিশাল শ্রমজগত আছে। সে শ্রমজগতের সঙ্গে জড়িত মানুষরা সবাই বাম দল করেন না। বাম চিন্তা-চেতনার মানুষও নন তারা। তাদের কথা ভাবার প্রয়োজন উড়িয়ে দেয়া যায়? ডান বাম মধ্য এসব ভাবনার অবসান না হলে কোন দিবস কোন ঘটনাই জাতীয় চরিত্র লাভ করতে পারে না। আমাদের সমস্যা আরও গভীরে। এক শ্রেণীর মানুষ মালিক আর এক শ্রেণী শ্রমিক- এ দুই ভাগে বিভক্ত সমাজে কি আসলে সাম্য বা সমতা সম্ভব? বলছি না একদিনে বা হঠাৎ এর সমাধান মিলবে। তবে ধারাবাহিক উত্তরণের বিকল্প নেই। যে কোন মহতী বা শ্রম দিবসের আরেক দুশমন মৌলবাদ। এদের কথাবার্তা শুনলেই বোঝা যায় এরা কত নির্মম। নারী-পুরুষ, বড়-ছোট কত ভেদে ভাগ করেন এরা। কত ধরনের ফতোয়া আর বিধিনিষেধ। কাজের চেয়ে লিঙ্গভেদ আর পার্থক্য নির্ণয়েই সময় পার করেন এরা। ধর্ম এদেশে চিরকাল তার আসন বজায় রেখে চলেছে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু হঠাৎ করে এর একটা উগ্র দিক বেরিয়ে এসেছে দেশে। সেটা আর যাই হোক শ্রমজীবী নারীদের জন্য সুসংবাদ কিছু নয়। এ জায়গাটা দেখে রাখতে না পারলে আগামীতে দিবস তো দূরের কথা, মানুষ শ্রমও দিতে পারবে না। লিখছি শ্রম দিবসহীন দেশ থেকে মে দিবসের লেখা। যেখানে শ্রম তার আপন মহিমায় মানুষকে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে দেয়া হয়, ভেদাভেদ করে না, সেখানে কি আসলেই কোন আলাদা দিনের প্রয়োজন আছে? আর যেসব দেশ কথানির্ভর বাকসর্বস্ব সেখানে হয়ত এখনও দিবসের প্রয়োজন আছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত বাস্তবতায় আছি আমরা। মুক্তির পথ একটাই। মানুষকে তার মর্যাদা আর ভালবাসার জায়গাটা ফিরিয়ে দিতে হবে। গুম, খুন, হত্যা সন্ত্রাসমুক্ত রাখা না হলে কি আসলেই কোন মূল্য বহন করে? [email protected]
×