ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

এবারও নিরানন্দ ঈদ উৎসব

প্রকাশিত: ২০:৩৭, ৪ মে ২০২১

এবারও নিরানন্দ ঈদ উৎসব

২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে করোনা সংক্রমণ বাংলাদেশে প্রথম তার অবস্থান জানান দেয়। চীনের উহান প্রদেশের উবেই শহরে নতুন এই ভাইরাসটির সক্রিয় উপস্থিতি এক বিস্ময়কর চমকও বটে। কারণ শনাক্ত এবং মৃত্যুর উর্ধহার বৃহত্তর এশিয়ার এই সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রটিকে সঙ্কটাপন্ন করে দিতে বেশি সময় নেয়নি। শুধু তাই নয়, সারা পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করল এই অতিমারীর ভয়ঙ্কর দাপট। সংক্রমিত এলাকা উবেই শহরকে চীনের অন্যান্য স্থান থেকে নিরাপদ দূরত্বে একবারে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হলো। চীন সরকারের বিচক্ষণতায় এই মাত্রাতিরিক্ত সংক্রামক ব্যাধিটি দেশের অন্যান্য জায়গায় ছড়াতে পারেনি। এই করোনা মহামারী মানুষের সঙ্গে মানুষের সহজ মিলনের পথকেও অবরুদ্ধতার কঠিন জালে আটকে দেয়। মহামারী আধুনিক বিশ্বে নতুন নয়। পৃথিবীতে যুগে যুগে সময়ের ব্যবধানে এমন মহামারীর আক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার দুর্ঘটনা মানুষ বহুবার দেখেছে। সে মাত্রায় অসুস্থ ব্যক্তিকে আলাদাভাবে বিচ্ছিন্ন রেখে সুস্থ মানুষের ভিন্ন কোন নিরাপত্তার বলয় তৈরি করতে হয়নি। কিন্তু করোনা সুস্থ-অসুস্থ সব মানুষের মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব তৈরি করে সহজ মিলনের পথে এক প্রাচীরসম বিঘœ তৈরি করেছে, যা তাবত বিশ্ব এই প্রথমবার উপলব্ধি করতে পারল। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হচ্ছে সবাইকে। যারা আক্রান্ত তারা তো বটেই, বাকিরাও নিরাপদ দূরত্বে সুস্থ হয়েও আলাদা হওয়ার নতুন স্বাস্থ্যবিধি সবাইকে হতবাক করে দেয়। শুধু তাই নয়, নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে তার দামও চুকাতে হয়েছে অনেককে। ফলে করোনার মহাদুর্বিপাক জনজীবনে যে মারাত্মক ক্রান্তিকালের অবতারণা করে সেটা জাতীয় পর্যায়ের হরেক রকম আনন্দ উৎসব থেকে ধর্মীয় বিধি পালনেও বাধা সৃষ্টি করে। মানুষের মিলনযজ্ঞে ব্যবচ্ছেদ তৈরি করতে গিয়ে কোন অনুষ্ঠানমালাকে উদযাপনের সুযোগ কমে আসছে। ফলে গত বছরের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কাল উৎসব-আনন্দের পরিবর্তে ঘরে বসেই এমন সব অবিস্মরণীয় দিন টিভিতে, ভার্চুয়াল জগতে উপভোগ করতে হয়েছে। পরবর্তীতে পহেলা বৈশাখেও বাঙালীকে আবহমানকালের সমৃদ্ধ চেতনা ও সাংস্কৃতিক বোধকে পালন করতে হয় গৃহবন্দী অবস্থায়। পর্যায়ক্রমিকভাবে আসে পবিত্র রমজান মাস। ২০২০ সালে রমজান মাস আমাদের জন্য এক আলাদা মাত্রার বার্তা নিয়ে হাজির হয়। কারণ জামাতে তারাবির নামাজ পড়ার ক্ষেত্রেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হয় । ফলে বেশিরভাগ মুসল্লিকে ঘরে বসেই সেই নামাজ আদায় করতে হয়। ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত পুরো দুই মাস অবরুদ্ধ দেশের অর্থনীতির চাকা থেকে শুরু করে সামাজিক বলয়ও এক অনাবশ্যক অচলায়তনের বেড়াজালে আটকে যায়। রমজানের মধ্যে ঈদের কেনাকাটায় পড়ে এক অপ্রত্যাশিত বিঘœতা। অনলাইন বাজারে আমরা এখনও তেমন অভ্যস্ত নই। তাই গত বছর এই প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসায়েও সংশ্লিষ্টরা সেভাবে সংযুক্ত হতে পারেনি। তা এবারের ঈদ-উল-ফিতরের নামাজ হবে মসজিদে। সারি সারি মুসলমান পরম করুণাময়ের দরবারে দুই হাত তুলে মোনাজাত করবে যাপিত জীবনের প্রশান্তি আর সমস্ত দুর্বিপাক থেকে রক্ষা পাবার প্রত্যাশায়। গত বছর তাও কোনভাবেই উদযাপন করা সম্ভব হয়নি। মুসলমানদের এই পবিত্র ঈদে মানুষের কোলাকুলির যে রেওয়াজ সেখানেও আসে এক ভয়ানক সামাজিক দূরত্ব। এখন করোনা নিরাময়ের ওষুধই শুধু নয়, প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারও চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের এক অভানীয় সফলতা। আমাদের বাংলাদেশে করোনার উর্ধগতি গত বছর জুন-জুলাই, আগস্ট পর্যন্ত দৃশ্যমান হলেও ক্রমে তা অনেকটা সহনীয় অবস্থায় চলে আসে। ২০২১ সালে জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমরা অনেকটাই নিরাপদ ছিলাম করোনার কবল থেকে। যখন বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রাবল্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো নাজেহাল, সে সময়ই বলা হয় আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান প্রাকৃতিক পরিবেশে যে মাত্রায় সাধারণ মানুষকে লড়াই করে টিকে থাকতে হয় সেখানে প্রতিরোধ শক্তি তৈরি হওয়া সেও প্রকৃতির অবারিত দান। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে খেটে খাওয়া মানুষের উদয়স্ত পরিশ্রমই তাদের ভেতরে এক সুরক্ষিত দুর্গ তৈরি করে দেয় যা তারা নিজেরাও জানতে পারে না। ফলে দৈনিক খেটে খাওয়া দিনমজুর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জে কৃষক শ্রমিকরাও কেমন যেন এই কালব্যাধি থেকে নিরাপদ দূরত্বেই ছিল। তারা যেমন করোনার ভয়াবহতার তোয়াক্কাও করেনি তেমনি লড়াকু করোনা প্রতিরোধে মনোভাবও বিন্দুমাত্র ক্ষুণœ হয়নি। তবে শহরে-বন্দরে অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ আয় কমে যাওয়া থেকে শুরু করে চাকরি হারানোর মতো দুরবস্থায়ও পড়ে যায়। আর যারা ক্ষুদে ব্যবসায়ী, ফুটপাথে নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীর পসরা সাজিয়ে বসে তাদের রুজি-রোজগারেও আসে এক অশনি সঙ্কেত। সেসব নিম্ন আয়ের খুদে ব্যবসায়ী আজও তাদের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেনি। আবারও একুশ সালের মার্চের মাঝামাঝিাতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দেশকে আতঙ্কে অস্থির করে তুললে পুনরায় লকডাউনের মতো করুণ পরিস্থিতি নিয়ে আসতে হয়। তবে গতবারের স্থবিরতা চোখে পড়ার মতোই ছিল। এবারের অবরুদ্ধ জীবন ও জীবিকা সেভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না। এবারের লকডাউন নামে মাত্র। রাস্তায় বের হলে গণপরিবহন ছাড়া আর সব যানই বহাল তবিয়তে চলছে। অল্প-স্বল্প যানজট বিরক্তিরও উদ্রেক করছে। লকডাউনের মধ্যেই শপিং মলগুলো খুলে দেয়া হলেও বাজার সেভাবে এখনও জমে ওঠেনি। অত্যধিক তাপপ্রবাাহ, চলাফেরার ছাড়পত্র, করোনা মারাত্মক দ্বিতীয় ঢেউ ছাড়াও গণপরিবহনের অভাবেই ক্রেতাদের ভিড় এখনও সেভাবে দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠেনি। ফলে যারা সারা বছরের আশা -আকাক্সক্ষায় ঈদ সামগ্রীর পসরা সাজিয়ে ক্রেতাদের জন্য অপেক্ষমাণ তাদের দুরবস্থার কথা ভাবাই যায় না। গত বছরও ঈদের বাজারে বড়, মাঝারি আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের লোকসান গুনতে হয়েছে। এবারও তারা মহাবিপাকে। সবকিছুর মধ্যে যা দৃষ্টিকটু তা হলো মানুষের এখনও বোধোদয় হলো না নিজের সুরক্ষাকে নিশ্চিত করতে। বাইরের খোলা বাজারে অনেকের মুখে মাক্স পর্যন্ত নেই, সামাজিক দূরত্বকেও কেউ তোয়াক্কা করছে না। মানুষ যদি নিজের ভাল-মন্দ বুঝতে ব্যর্থ হয় তাহলে তার নিরাপত্তা শুধু সরকারের পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। জনগণ গত বছর থেকে করোনা মোকাবেলা করে কেমন যেন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। শুধু তাই নয় দুঃসাহসী এবং বেপরোয়া হওয়ার চিত্র গতবারও দেখা গেছে এবারও তার কোন ব্যতিক্রম হচ্ছে না। গত বছর ১৭ মার্চ যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হলো নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করতে তখন অনেক অভিভাবক সন্তানদের নিয়ে সমুদ্র সৈকতে আনন্দ উপভোগ করতে ব্যস্ত ছিলেন। এবারও টিকাদান কর্মসূচী শুরু হওয়ার পর থেকে আবারও সেই একই সমুদ্র বিহারের উন্মাদনা প্রত্যক্ষ করা গেছে। শুধু তাই নয়, সাড়ম্বরে, উৎসব আয়োজনে অনেক বিবাহ অনুষ্ঠানে যে মাত্রায় মানুষের ঢল নামে তাতে আগেই বিশেষজ্ঞরা দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করছিলেন। ইতোমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার এক ভিন্ন মাত্রার বৈশিষ্ট্য রূপান্তরের ভাইরাস নাকি বাংলাদেশকে আক্রান্ত করেছে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে তা উঠেও আসে। এবারের ভাইরাস যেমন ছোঁয়াছে একইভাবে প্রাণঘাতীও। ফলে গত বছরের তুলনায় শনাক্তের হার বাড়াবাড়ি হলেও মৃত্যুর হার সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। সিংহভাগ মানুষ যদি স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়মবিধিকে অবহেলা আর উপেক্ষায় দূরে সরিয়ে রাখে তা হলে আইন, সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র তাকে বাঁচাতে ব্যর্থ হবে। প্রত্যেক মানুষ যদি আমরা সচেতন দায়বদ্ধতায় করোনা সংক্রামণকে দূরে সরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে নিয়ম-শৃঙ্খলার অধীন হই তাহলে এই কালব্যাধিটি অবশ্যই পরাভূত হবে। জয়ী আমাদের হতেই হবে। তা না হলে শুধু ঈদ নয়, আরও অনেক কিছু তছনছ হতে সময় নেবে না। লেখক : সাংবাদিক
×