ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আসিফ মুনীর তন্ময়

স্মরণে জাহানারা ইমাম

প্রকাশিত: ২০:২১, ৩ মে ২০২১

স্মরণে জাহানারা ইমাম

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধারে ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি বেগবান করতে জাহানারা ইমামের ও তাঁর উত্তরসূরি আন্দোলনকারীদের ভূমিকা অপরিসীম। একটি জাতীয় আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, বিপুল আলোচিত এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি অসম্মানকারী একটি গোষ্ঠীর কাছে সমালোচিত জাহানারা ইমামের নাম দেশে ও প্রবাসে সকল বাংলাদেশীর কাছেই সুপরিচিত। মাত্র দুটি বছর, ১৯৯২ থেকে ১৯৯৪ এ তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রথম গণজাগরণের সময়ে বহুল আলোচিত নাম হয়ে গিয়েছিলেন জাহানারা ইমাম। এখনও আছেন। তবে ব্যক্তিত্ব জাহানারা ইমাম যতটা পরিচিত, ব্যক্তি জাহানারা ইমামের ব্যক্তিত্ব হয়ত ততটা নয়। পারিবারিকভাবে এবং নব্বই দশকের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনের শরিক হিসেবে ব্যক্তি-ব্যক্তিত্ব জাহানারা ইমামকে কিছুটা কাছে থেকে দেখার বা তাঁর সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছিল। জাহানারা ইমাম ১৯৪৫-৪৭ কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজে স্নাতক পড়েছেন এবং ডিগ্রী নিয়েছেন। সে সময় আমার মা লিলি চৌধুরীও (তখন লিলি মীর্জা) একই কলেজে একাদশ শ্রেণীতে পড়েছেন। সে সময়, অর্থাৎ ভারত উপমহাদেশ ভাগের আগে কলকাতার কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাঙালী মুসলমান ছাত্রী সংখ্যায় খুবই নগণ্য ছিল। তবে মা’র কাছে শুনেছি, মুসলিম ছাত্রীর সংখ্যা কম হলেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কোন কমতি ছিল না সেখানে তখন। সেই লেডি ব্রেবোর্ণের ছাত্রীদের মধ্যে বিভিন্ন কার্যক্রমে জাহানারা ইমাম সক্রিয় থাকতেন বলে মাসহ অনেকেই তাঁকে চিনতেন। আবার ষাটের দশকে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় স্নাতকোত্তর ও শিক্ষায় স্নাতক ডিগ্রী নিয়েছেন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে কর্মরত ছিলেন, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমার বাবা মুনীর চৌধুরীর সঙ্গেও তাঁর নিয়মিত সাক্ষাত, আলাপচারিতা ও মতবিনিময় হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে কিছু ছবি দেখেছি বাড়িতে। অনুমান করতে পারি শিক্ষিকা, লেখিকা এবং আন্দোলননেত্রী জাহানারা ইমাম, মুনীর চৌধুরীর মতো মানুষের কাছে এসে অনুপ্রাণিত হতেন। অনেক পরে আমি নিজেই কাছে থেকে তার নিষ্ঠা, দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্ব দেখে শ্রদ্ধাবনত হয়েছি, আর আপ্লুত হয়েছি যে, বাবা মুনীর চৌধুরীর জীবনের শেষ দশকের একটা বড় সময় জাহানারা ইমামের মতো মানুষ পাশে ছিলেন। অনেক পরে যখন তাঁর বিখ্যাত ডাইরিগ্রন্থ একাত্তরের দিনগুলি পড়ি, সেখানে ১৬ ডিসেম্বরের ডাইরির পাতায় পাই যে, তিনি উল্লেখ করেছেন মুনীর চৌধুরীসহ তার অন্যান্য স্যারদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, পরে রায়েরবাজার বধ্যভূমির সন্ধান পাবার কথা বলেছেন। নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, ‘লাগাতার কারফিউয়ের মাঝে জীপ আর মাইক্রোবাসেই হয়তো বাছাই করে বুদ্ধিজীবীদের তুলে নেওয়া হয়েছে।’ তরুণ বয়সে প্রথম পড়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল তাঁর এই লাইনগুলোসহ পুরো বইটি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী নতুন প্রজন্মের বাঙালীর জন্য একজন মধ্যবিত্ত বাঙালী স্ত্রী-মা-এর চোখে মুক্তিযুদ্ধের প্রাণবন্ত ও প্রত্যক্ষ বর্ণনায় লেখা গ্রন্থ আর নেই। সকল বাংলাদেশীর এই বইটি পড়া উচিত, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের অবস্থান নিয়ে যাদের মনে সংশয় আছে, তা কিছুটা কমতো। এই একাত্তরের দিনগুলি বইটি কখনও পাঠ্যবই হিসেবে বিবেচনা করা গেলে আরও ভাল হতো। পাশাপাশি তাঁর অন্যান্য প্রবন্ধ, উপন্যাস স্বল্প পরিচিত হলেও আমাদের ইতিহাস ও সাহিত্য সংরক্ষণের অপরিহার্য অংশ। মুক্তিযুদ্ধের পর নিয়মিত না হলেও মাঝে মাঝেই পারিবারিকভাবে তাঁর সঙ্গে দেখা হতো। তাঁর মা যখন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন, তখন আমার মা অনেকের মতই গিয়েছিলেন জাহানারা ইমামের সঙ্গে দেখা করতে। আমাদের বাড়িতেও তাঁকে মাঝে মাঝে আসতে দেখেছি মার সঙ্গে কথা বলতে। দেখতাম কি রকম স্মার্ট, আত্মবিশ্বাসী এক ভদ্রমহিলা। শুনেছি একসময় নাকি তাঁকে বলা হতো পূর্ব বাংলা/বাংলাদেশের সুচিত্রা সেন। তবে এর থেকে আরেকটু কাছে থেকে দেখেছি তাঁর পরিণত বয়সে, আমাদের তারুণ্যে, ক্ষণকালের জন্য। নব্বই-এর গণঅভ্যুত্থান ও সামরিক-রাজনীতিবিদ এরশাদ সরকার পতনের পর অনেক আশা নিয়ে গণতন্ত্রের নবযাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশে। কিন্তু আশাহত হতে হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকৃতি-বিস্মৃতি, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের অপমান আর যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনের আগের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকতে দেখে। এই রকম একটা সময় সাংবাদিক-লেখক-শহীদ ভ্রাতা শাহরিয়ার কবিরের উদ্যোগে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ ও পরে ৭২টি সংগঠন নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন’ ও ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়। ডানপন্থী ও চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ছাড়া সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন জাতীয় সমন্বয় কমিটির অন্তর্ভুক্ত ছিল। এদিকে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সন্তানদের সংগঠন ‘প্রজন্ম ’৭১ নামে আমরা আত্মপ্রকাশ করি ১৯৯১ সালে। ‘প্রজন্ম ’৭১ গঠনে শহীদ জায়া পান্না কায়সার এবং শাহরিয়ার কবিরের অনুপ্রেরণা ছিল, আবার ১৯৯২ সালে প্রজন্ম ’৭১-এর প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিশেষ অতিথি ছিলেন জাহানারা ইমাম। আমাদের এই ‘প্রজন্ম ’৭১’ কেও জাতীয় সমন্বয় কমিটির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই জাতীয় সমন্বয় কমিটির পুরোধা সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচন করা হয়েছিল জাহানারা ইমামকে। যারা তাঁর নাম প্রস্তাব করেছিলেন, তাঁরা সত্যিই বিচক্ষণতা আর দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্তদের সংগঠন হিসেবে প্রজন্ম ’৭১ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবির এই আন্দোলনে ক্যাটালিস্টের ভূমিকা রাখবে বলে জাহানারা ইমামসহ অন্য নেতৃবৃন্দ আমাদের জাতীয় সমন্বয় কমিটির মাঝে একটা বিশেষ অবস্থানে রেখেছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির রাজপথের আন্দোলনে তিনি এবং আমরা সবসময় পাশাপাশি ছিলাম। শহীদ পরিবারের কোন কোন সদস্য ছিলেন গণআদালতের সাক্ষী। এই প্রথম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে এতবড় একটা প্ল্যাটফর্ম, স্বল্পসময়ে সকলের মাঝে সমন্বয়সাধন কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ভেতরে নানান মত, বাইরে সরকারী ও গোয়েন্দা বিভাগের সতর্ক নজরদারি কিভাবে শ্রদ্ধেয় জাহানারা ইমাম সেই ১৯৯২ থেকে ১৯৯৪-এ তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর ধৈর্য, অবিচলতা, দৃঢ়তা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দিয়ে সকল সঙ্কট মোকাবেলা করে গেছেন আর আন্দোলনকে দিকনির্দেশনা দিতে সাহায্য করেছেন, তা আমরা তাঁর ক্ষুদ্র সহকর্মীরা নিয়মিতই দেখেছি। আমাকে তিনি তো আগেই চিনতেন, আমাদের ‘প্রজন্ম ’৭১-এর একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নিশান ও তাঁর মা ছিলেন তাঁর ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের বাসার অনেকদিনের প্রতিবেশী। আর অনেককেই তিনি ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, তাই প্রজন্ম ’৭১-এর অনেকেই তাঁর সন্তানতুল্য ছিলাম। আমাদের প্রতিবেশী ভাইটি নিশান উনাকে ডাকত দাদি, সেইসূত্রে আমাদের শহীদ সন্তানদের অনেকেই তাঁকে দাদি ডাকত। আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন আমরা মাঝে মাঝেই তাঁর বাসায় গেছি হয় বৈঠক করতে, নয় কোন কাজে সাহায্য করতে। দেখেছি কিভাবে এককালের শিক্ষিকা, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের একসময়ের প্রধান শিক্ষিকা কি সুশৃঙ্খলভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিশাল এক আন্দোলনের। জাতীয় সমন্বয় কমিটির কার্যালয়ের বাইরে তাঁর বাড়িতেই তাঁর নিজস্ব কার্যালয় ছোটখাটো ‘কন্ট্রোল রুম’। সেখানে বিভিন্ন শিফট করে ‘প্রজন্ম ’৭১সহ আরও কর্মীবাহিনী নিয়মিত কাজ করত। সহযোগীরা মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধী বিচারের আন্দোলন সংক্রান্ত সকল সংবাদপত্র কাটিং নিয়মিত ফাইল করত, প্রয়োজনমতো বিশেষ কোন সংবাদ আলাদা করে শহীদ জননীর কাছে দিত তাঁরই শেখানো নিয়মে। তখনকার কোন কোন তরুণ সাংবাদিকও এই কাজে সহায়তা করতেন। তাঁর এই বাড়িতে তখন নিয়মিত প্রচুর মানুষ দেখা করতে আসতেন, এই তরুণ স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীকে জাহানারা ইমাম শিখিয়ে দিয়েছিলেন কিভাবে বাড়িটিকে কার্যালয় থেকে শুরু করে আন্দোলনের মিলনকেন্দ্র হিসেবে পরিচালনায় সহায়তা করবে। তখন কে বলবে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তাঁর দৃঢ়তা কমেছে এমনকি তিনিসহ অন্য নেত্রীবৃন্দের ওপর যখন রাষ্ট্রদ্রোহের প্রহসনমূলক মামলা করা হলো, তখনও তিনি বিচলিত হননি, আন্দোলন থেকে পিছপা হননি। এমনকি প্রবাসে হাসপাতালের মৃত্যুশয্যাতেও তিনি লিখিতভাবে আন্দোলনের শেষ নির্দেশ দিয়ে গেছেন আন্দোলন চালিয়ে যাবার। একজন মহামানবসম মানুষের ব্যক্তিত্বের এ এক বিরল দৃষ্টান্ত। তাঁর মৃত্যুর পর জাতীয় সমন্বয় কমিটির হাল ধরার ভার পড়েছিল শ্রদ্ধেয় অভিনয়শিল্পী হাসান ইমামের ওপর। সৎ, অমায়িক হাসান ইমাম যথেষ্ট প্রজ্ঞার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন, তবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলব, শহীদজননী জাহানারা ইমামের মতো মানুষের বিশাল ভূমিকা আর ব্যক্তিত্বের শূন্যস্থান পূরণ করা যে কারও জন্যই দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছিল। সেই জাতীয় সমন্বয় কমিটির মাঝে পরে কিছু টানাপড়েন এসেছিল। যেটুকু বুঝি আর জানি, কমিটির শরিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্যান্য শরিকের কিছু দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীতে নতুন করে গোছানো ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিই এই আন্দোলনের দায়িত্ব বহন করে চলেছে, এর সঙ্গে এক সময় কিছুটা জাহানারা ইমামের অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত তরুণ প্রজন্মের হাতে গড়া গণজাগরণ মঞ্চ। জাহানারা ইমাম আশির দশকে একাত্তরের দিনগুলি ডাইরিগ্রন্থ প্রকাশ করে আর নব্বই দশকে মাত্র দু’বছরে যে আন্দোলনের সূচনা করে গেছেন, তার প্রভাবের চাকা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠা করার ধারাবাহিকতায় আজও সচল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বা রায় কার্যকর প্রক্রিয়া যদি তিনি দেখে যেতে পারতেন, যদি আজও নেতৃত্ব দিতে পারতেন, তাহলে আমরা এখনকার চেয়ে আরও বেশি ভরসা পেতাম ভবিষ্যতের জন্য। লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পাদক, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পুত্র
×