ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবু তাহের

সঙ্কটের মেঘ অচিরেই কেটে যাবে

প্রকাশিত: ২০:১৮, ৩ মে ২০২১

সঙ্কটের মেঘ অচিরেই কেটে যাবে

করোনাভাইরাসের অদৃশ্য জীবাণু বিশ্ববাসীকে এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে। ইতোমধ্যে বিশ্বের ১৪ কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত এবং ৩০ লাখের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে সকলের আত্নার মাগফিরাত কামনা করছি। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর মিছিলও ক্রমশ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি এখন মহাবিপদে। বিপর্যস্ত প্রায় সব দেশের অর্থনীতি। আমাদের মতো শ্রমনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলো আরও বেশি বিপদে। কর্মবাজারের অধোগতি ইতোমধ্যে দৃশ্যমান। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সরকার সঠিক ডাটাবেজ তৈরিপূর্বক একটি সমন্বিত কৌশলগত পরিকল্পনা ও স্বনির্ভর কর্মসংস্থানমুখী কর্মসূচী নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে, যেখানে দল-মত-নির্বিশেষে সকলের আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। উপরন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সহায়তার জন্য একটি ‘সামাজিক সংহতি তহবিল’ গঠন করা যায় যেখানে করপোরেট প্রতিষ্ঠন, এনজিও, সামাজিক সংগঠন রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন ক্লাব ও যে কোন ব্যক্তির অংশগ্রহণের সুযোগ অবধারিত থাকবে। এ তহবিলে কে কত টাকা দিচ্ছে এবং কোথায় তা ব্যবহার/খরচ হচ্ছে তা মুহূর্তেই হাল নাগাদের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। এ সমস্ত কর্মকান্ড দায়িত্ব ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে করোনাকালীন সুরক্ষা দেয়ার পাশাপাশি আগামীতে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখাবে। গত বছর করোনা মহামারী মোকাবেলার জন্য একটানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি বলবত ছিল। বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-যা এখনও বলবত আছে। যদিও অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম চলমান রয়েছে। কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণ থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে সরকার পুনরায় লকডাউন আরোপ করেছে। করোনায় অর্থনীতি ও মানুষের জীবিকা যাতে সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে না পড়ে, সে জন্য সরকার ইতোমধ্যে নিম্নবিত্ত ও গরিব মানুষের জন্য পল্লী অঞ্চলে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে ৮০৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা এবং পবিত্র রমজান ও আসন্ন ঈদ-উল ফিত্র উপলক্ষে ৬৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। ফলে দেশের ১ কোটি ২৪ লাখ ৪২ হাজার গরিব ও নিম্নবিত্ত পরিবার উপকৃত হবে। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩৬ লাখ দরিদ্র পরিবারকে নগদ আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। উপরন্তু ভিজিএফ ও টেস্ট রিলিফসহ বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ইতোপূর্বে সরকার ঘোষিত ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকার কার্যক্রমও চলমান রয়েছে। করোনার কারণে আয়-সম্পদ-স্বাস্থ্য-শিক্ষায় বৈষম্য বাড়ছে, যা প্রকারান্তরে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার শ্রেণী-কাঠামোতে অনেকটা পরিবর্তন এনেছে। দেশে দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে; বর্তমানে যার পরিমাণ প্রায় ৪১ শতাংশ। করোনা থেকে জীবন বাঁচানোর চেয়ে ক্ষুধা থেকে জীবন বাঁচানো তাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছে। তাই জীবন-জীবিকার সমন্বয় ও বৈষম্য হ্রাসের যত পথ-পদ্ধতি আছে তা দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োগ করতে হবে। আর এক্ষেত্রে ‘বৈষম্য হ্রাসকারী উন্নয়ন দর্শনের’ আলোকে যে সব খাত-উপখাত রয়েছে আগামী বাজেটে সে সব খাতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে অনানুষ্ঠানিক সেক্টরের কর্মকা-কে যেখানে দেশের ৮৬ শতাংশ (অঙ্কের হিসাবে যাদের সংখ্যা ৬ কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার) শ্রমজীবী মানুষ নিয়োজিত আছে। সর্বোপরি ‘যারা দিনে আনে দিনে খায়’ তাদের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নসহ আয়-সম্পদের বৈষম্যের লাগাম টেনে ধরতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় দেশের সম্পদ পাকিস্তান আমলের ন্যায় একটি গোষ্ঠীর হাতে পুঞ্জীভূত হয়ে পড়বে, যা মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনার পরিপন্থী ও বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনের সঙ্গে অসামঞ্জ্যপূর্ণ। সরকারকে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তিনটি পর্যায়ে কাজ করতে হচ্ছে- (১) সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ; (২) সংক্রমিত ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা; (৩) জনসচেতনতা কার্যক্রমের মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি ও গুজব প্রতিরোধ। এ তিনটি পর্যায়ে যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণের জন্য তিনজন সুদক্ষ, সাহসী ও বিচক্ষণ ব্যক্তির ওপর দায়িত্বভার ন্যস্ত করা প্রয়োজন। এ সমস্ত ব্যক্তি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, জাতীয় পর্যায়ে গঠিত টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অধিদফতর, বিভাগ ও সংস্থার মধ্যকার সমন্বয় সাধন করে ত্বরিত গতিতে করোনা যুদ্ধের কৌশল প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে তৎপর থাকবে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এহেন দুরবস্থা, সক্ষমতার ঘাটতি, দুর্বল তথ্য ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা দেখতে হবে, তা ভাবিনি। জীবনের এ পর্যায়ে এসে কখনও কখনও বিফল মনোরথ হয়ে যাই। তবে নতুন প্রজন্মের দিকে তাকালে মনের মধ্যে আবার আশার সঞ্চার ঘটে। আমরা যা পারিনি নতুন প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দেশপ্রেম, কর্তব্যনিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও মানবপ্রেমে অভিষিক্ত হয়ে তার বাস্তবায়ন নিশ্চয়ই করবে। সে আশায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকেই উদ্ধৃত করে নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে বলতে চাই- ‘আমার নাইবা হলো পারে যাওয়া,/ সে হাওয়াতে চলত তরী অঙ্গেতে সেই লাগাই হাওয়া/ নেই যদিবা জমল পাড়ি, ঘাট আছে-তব সতে পারি।/ আমার আসার তরী ডুবল, যদি দেখব তোদের তরী বাওয়া।’ ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, পৃথিবীতে যুগে যুগে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাসের (যেমন-কলেরা, ম্যালেরিয়া, গুটিবসন্ত, মাস, সার্স, বার্ডফ্লু, স্প্যানিশফ্লু, এইচওয়ান এন ওয়ান ইত্যাদি) প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। এসেছে ঝড়ঝঞ্ঝা, দুর্যোগ-দুর্বিপাক। এসব মোকাবেলা করেই মানবজাতিকে টিকে থাকতে হয়েছে। জীবনের চলার পথ কখনও মসৃণ নয়। তবে পথ যত কঠিনই হোক আমাদের তা জয় করে এগিয়ে যেতে হবে। বর্তমানে করোনার প্রকোপ কিংবা সংক্রমণ কমাতে বেশি প্রয়োজন সংক্রমিত রোগীদের চিকিৎসা সুনিশ্চিত করা; হোম কোয়ারেন্টাইন-আইসোলেশন-সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা; বাইরে থেকে ঘরে এসে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে গরম পানির ভাপ নেয়া; জনসমাগম এড়িয়ে চলা, করোনা টেস্টিং ও টিকাদান কার্যক্রম জোরদারকরণ; ঘরের বাইরে মাস্কের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে জনগণকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করা। জীবনে চলার পথে মাঝে মাঝেই এ ধরনের সঙ্কট আসবে, তবে তার অবসান অনেক বেশি সত্য। তাই কবিগুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণ্ঠের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে চাই- ‘কালো মেঘ আকাশের তারাগুলো ঢেকে ভেবে জিৎ হলো তার/ মেঘ কোথা ভেসে যায় চিহ্ন নাহি রেখে তারাগুলো রহে নির্বিকার।’ বাঙালী বীরের জাতি। অতীতে যে কোন দুর্যোগ-বিপর্যয় আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করেছি। এবারও তাই হবে। করোনা যুদ্ধে আমরা কিছুতেই হারব না। জয় আমাদের হবেই। আর এ ধরনের বালা-মুসিবত ও দুর্যোগের দুর্বিপাকে যথাযথ কর্মপন্থা গ্রহণ ও ধৈর্য ধারণ করাই উত্তম। একাত্তরের পর আমাদের জাতীয় জীবনে এমন দুর্যোগের ঘটনা আর ঘটেনি। তাই জাতির এ দুর্দশা লগ্নে সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে সময়ের সাহসী কান্ডারী বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে সঙ্কটের মেঘ অচিরেই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব আমরা। লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও ডিরেক্টর, বোর্ড অব ডিরেক্টরস, জীবন বীমা কর্পোরেশন
×