ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জুয়েল আশরাফ

গল্প ॥ কবুতর

প্রকাশিত: ০০:১৭, ৩০ এপ্রিল ২০২১

গল্প ॥ কবুতর

ব্যস্ত জীবনে নুসাইবা বোধহয় সবচেয়ে বেশি অবহেলা করে আলমারিকে। অথচ সেই আলমারিতেই থাকে তার পছন্দের পোশাক। কিন্তু সময় কোথায় আলমারি গোছানোর? বরং টেনে-হিঁচড়ে পোশাক বের করে, আবার দলা পাকিয়ে আলমারিতে ভরে রাখা হয়। নিজের প্রিয় পোশাকগুলো এভাবে যেমন নষ্ট হয়, তেমনই আলমারি কার্যত জামাকাপড়ের স্তূপে পরিণত হয়। যেখান থেকে দরকারের সময়ে কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। ইস্ত্রি করা জামাকাপড়গুলোও যায় নষ্ট হয়ে। নিজের প্রতি মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে। ধুর, আলমারিটা ঠিকমতো গোছানো হয় না। কেন যে কিনতে গেলা এটা। একরাশ বিরক্তি নিয়ে নেভি ব্লু কালারের থ্রিপিস পরে অফিসের উদ্দেশে বের হলো। নুসাইবা গ্রামে মানুষ হয়েছে। অনার্স পড়তে শহরে আসে। এখানে এসে উপলব্ধি করে শহরে টিকে থাকতে হলে তাকে সংগ্রাম করতে হবে। বছর সাত হলো এখানে আছে। মাস্টার্স পাস করার পরই একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি পায়। বাবা গরিব হলেও শুধুমাত্র মেধার জোরে এই পর্যন্ত আসতে পেরেছে। অনার্সে ভর্তির পর মা শিক্ষা লোন করে দিয়েছিল। সেই টাকা আর শহরে এসে টিউশনি করা শুরু করল। এ জন্য পড়াশোনা শেষ করতে পেরেছে। নুসাইবার ছোট ভাই ওর মতো মেধাবী। তাই ভাইকেও ভালো কলেজে ভর্তি করিয়েছে। পড়াশোনার খরচ নুসাইবা দেয়। শিক্ষা লোন, ভাইয়ের পড়ার খরচ, বাবা-মায়ের খরচ সবকিছু দেয়। এর জন্য তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। অফিস থেকে এসে একটি প্রকাশনা কোম্পানির প্রুফ রিডিংয়ের কাজ করে সে। রাত বারোটা পর্যন্ত করতে হয়। বাসা লক করে বেরোনোর সময় কেন জানি খুব আনন্দ লাগছিল। বাইরে এসে ওর মন খারাপ হয়ে গেল। একটি কবুতর আহত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে। কবুতর তুলে নিয়ে বাসায় এসে ক্ষত স্থানে হলুদ আর সরিষার তেল দিয়ে বেঁধে দিল। একবার ভাবল, কবুতর কি খাঁচায় রেখে যাবে? গ্রামের মোড়ল চাচার কথা মনে পড়ল। একদিন একটি আহত ময়না পাখি এসেছিল ওদের বাড়িতে। মোড়ল চাচা সেই ময়না পাখিটাকে খাঁচায় বন্দী করে রেখেছিল। তাই মোড়ল চাচা সেবার ভোটে ফেল করে। এসব ভাবনা-চিন্তা করে সে কবুতর ব্যালকনিতে রেখে দিল। ভাল হয়ে গেলে নিজেই চলে যাবে এখান থেকে। এরপর আবার অফিসের দিকে রওনা দিল। আজ পাক্কা এক ঘণ্টা লেট। ভয়ে ভয়ে অফিসে ঢুকতেই কলিগ রহিমা বলল, কী রে আজ দেরি করলি কেন? বস তোকে খুঁজছে। নুসাইবা বলল, বাসা থেকে বের হতেই দেখি একটা কবুতর আঘাত পেয়ে পড়ে আছে। হলুদ সরিষার তেল দিয়ে পট্টি বেঁধে ব্যালকনিতে রেখে এলাম। ইশ্। এর জন্যই লেট। ওকে, বসের সঙ্গে দেখা করে আয় তারপর কথা হবে। বসের রুমের সামনে গিয়ে বলল, স্যার আসব? নুসাইবা, ভেতরে এসো। আজও দেরি করে এসেছ। নুসাইবা ভয়ে ভয়ে বসের সামনে গিয়ে বসল। ওর বসার স্টাইল দেখে বস হেসে দিয়ে বলল, জড়োসড়ো হয়ে বসেছ কেন? তোমার জন্য একটা সুখবর আছে। এ কথা শুনে নুসাইবা সোজা হয়ে বসল। তোমাকে আমাদের অফিসের সিনিয়র অডিটর হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। অভিনন্দন। সবাই তোমার কাজ দেখে খুব খুশি। তাই তোমাকে যোগ্য বিবেচনা করে এ পদে পদোন্নতি দেয়া হলো। অনেক ধন্যবাদ, স্যার। আপনারা আমাকে এ পদে যোগ্য বিবেচনা করে পদোন্নতি দিয়েছেন এতেই আমি খুশি। আমি যেন আপনাদের এই বিশ্বাসের মান রাখতে পারি। নুসাইবা অধিক খুশি হয়ে বসকে কথাগুলো বলল। আমরা জানি তুমি কাজটি পারবে। আগামীকাল থেকে তোমার এক সপ্তাহের ট্রেনিং শুরু হবে সিনিয়র অডিটর হিসেবে। এরপর থেকে তোমার নুন কাজ শুরু হবে। ঠিক আছে স্যার। আমি তাহলে আমার কাজে যাই? অবশ্যই। বসকে সালাম দিয়ে নিজের ডেস্কে চলে এলো। ওর হাসিখুশি মুখ দেখে রহিমা বলল, কী রে, খুব খুশি লাগছে? সুখবর না কি? হ্যাঁ। আমি সিনিয়র অডিটর হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছি। অভিনন্দন। কখন মিষ্টি খাওয়াচ্ছিস বল? আগে ট্রেনিং শেষ করে নিই। তারপর দুজনে রেস্টুরেন্টে গিয়ে সেলিব্রেট করব। বিকেল পাঁচটায় অফিস শেষ করে বের হলো নুসাইবা। রোজ অফিস থেকে হেঁটে বাসস্ট্যান্ড যায়। ওর অফিস থেকে বাসস্ট্যান্ড যেতে দশ মিনিট লাগে। মাঝে কিছুটা নির্জন গলি আছে। পদোন্নতির কথা ভাবছে আর হাঁটছে। এটা নিশ্চয়ই কোনো সুকর্মের ফল। গলির কাছাকাছি আসতেই কেন জানি মনে হচ্ছে কেউ তাকে ফলো করতে করতে আসছে। পেছনে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। অথচ ঘাড়ের পেছনের শিঁরদাড়া বরাবর কেমন জানি অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে আর এই অনুভূতি কারও উপস্থিতি জানান দেয়। বাসস্ট্যান্ড এসে বাসে উঠে পড়ল। বাস থেকে নেমে ঘরে আসার পর সেই অনুভূতি আর নেই। স্বস্তিতে বিছানায় এলিয়ে পড়ল। যাক বাবা, বাঁচা গেল। এই যাহ, সারাদিনের কাজের চাপ ও পদোন্নতির খুশিতে কবুতরের কথা মনে ছিল না। মনে পড়তেই ধপ করে মেঝেতে নেমে ব্যালকনিতে এলো। কবুতরটি আর সেখানে নেই। আরও ভাল লাগল যে, কবুতরটি সুস্থ হয়ে উড়ে চলে গেছে। নুসাইবা আবার এসে বিছানায় বসল। এরপর ফ্রেশ হওয়ার জন্য আলমারি থেকে কাপড় বের করতে গিয়ে অবাক! আলমারির সব কাপড় খুব সন্দর করে গোছানো। সে ছাড়া আর কেউ আলমারিতে হাত দেয় না। ঘরে চোর ঢুকেছে নিশ্চয়ই। হঠাৎ মনে ভয় এলো। কারণ আলমারিতে টাকা রাখা থাকে। তাড়াতাড়ি চাবি দিয়ে টাকা রাখার বাক্সটা খুলে দেখে। সবই তো ঠিক আছে। কে গোছালো আলমারি? ভাবতে ভাবতে কাপড় বের করে ফ্রেশ হয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে খেতে বসল। কাপে চুমুক দিতে দিতে সারা দিনের ঘটে যাওয়া সবকিছু মনে করতে লাগল। সব কিছু যেন স্বপ্নের মতো একটি একটি করে ঘটে গেল। তাকে আলমারির বিষয়টি বেশি ভাবাচ্ছে। কিভাবে কী হচ্ছে। কেউ তাকে অনুসরণ করছে মনে হলো। আবার বাসায় এসে আলমারি! এদিকে ওর পদোন্নতি হয়েছে বেতনও ডাবল তাই প্রুফ রিডিংয়ের কাজ ছেড়ে দেবে ভাবছে। আজ রাতে কাজ করে কাজে ইস্তফা দেয়ার জন্য আবেদন করবে। তা ছাড়া আগামীকাল এক ঘণ্টা আগে অফিসে পৌঁছাতে হবে। ট্রেনিং শুরু হচ্ছে এক সপ্তাহের। চিন্তা বেড়ে গেল। এ ছাড়া অফিসে গলির পথ আর আলমারির ঘটনা ভাবলে হাত-পা ঠা-া হয়ে আসছে। সারা দিনের পরিশ্রমের পর এসব কাহিনী দেখে রাতের খাবারের কথা ভুলে গেল। বিছানায় শুয়ে পড়তেই তন্দ্রাভাব এলো। কফি খাওয়ার পরও ঘুম চলে এলো চোখে। দশটা বাজতেই ঘড়িটা এ্যালার্ম দিয়ে বেজে উঠল। কারণ দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত প্রুফ রিডিংয়ের কাজ করে সে। রাত বারোটা পর্যন্ত কাজ করল। এই কাজ আর করবে না জানিয়ে মেইল করে ঘুমিয়ে পড়ল। ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে ওঠে ফ্রেশ হয়ে সামান্য কিছু খেয়েই অফিসের উদ্দেশে বের হলো। আজ এক ঘণ্টা আগে অফিসে পৌঁছাতে হবে। এখন প্রায় সাতটা বাজে। আটটার ভেতর অফিসে পৌঁছে গেল। বসের সঙ্গে দেখা করার পর ট্রেনিং শুরু হলো। অফিস শেষ করে সাতটায় বাসায় ফিরল। আজও ফেরার পথে আগের দিনের মতো অনুভূতি হয়। কিন্তু পেছন ফিরে কাউকে দেখতে পেল না। বাসায় এসেও একই ঘটনা। ছড়ানো ছিটানো ঘর সুন্দর করে সাজানো। প্রথম প্রথম আমলে নেয়নি। কিন্তু চারদিনের দিন ভয় পেয়ে গেল। ওর সঙ্গে এসব কী ঘটছে? নুসাইবা ওর কলিগ রহিমাকে ঘটনা বলল। শুনে রহিমার তো চক্ষু বড় হয়ে গেল। বলিস কী! তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে সেই প্রাচীন ব্যাঙ আর রাজকন্যার কথা। যে কি-না রাজকন্যাকে আড়ালে সাহায্য করত। হা হা হা। ধুর। আমি মরছি ভয়ে আর উনি আমাকে কাহিনী শোনাচ্ছে। থাক তোকে হেল্প করতে হবে না। দেখি অন্য কাউকে পাই কি না। আহা রেগে যাচ্ছিস কেন? আচ্ছা আজকের দিনটা দেখ। কারণ এ ঘটনা শুনে আমার কাছে তেমন খারাপ মনে হচ্ছে না। যে-ই এসব কাজ করছে, করুক। তোর কোন ক্ষতি তো করেনি। তাই নয়? আচ্ছা, তুই যখন বলছিস। তবে আজকের দিনটা দেখি। তারপর কাল সকালে থানায় যাব। তবে যা-ই বলিস, অনেকে ক্ষতি করার আগে উপকার করে নেয়। তারপর ঝোপ বুঝে কোপ মারে। বুঝলি? আর আমি এ জন্য ভয় পাচ্ছি। বুঝলাম। তার পরও আজ তুই সাবধানে থাকবি। আচ্ছা। কাজে মন দিল নুসাইবা। কিন্তু মন বসাতে পারছে না। আজ বাসায় আসার সময় ওর আর সেই অনুভূতি জাগেনি। আজ তাহলে বাঁচা গেল। ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাসা কিন্তু আগের দিনের মতো গোছানো। সুন্দর করে সাজানো আছে। এবার মনের ভয় আর দূর করা যাবে না। আগামীকাল সকালেই অফিস থেকে থানায় যাবে। নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করবে। প্রুফ রিডিংয়ের কাজ ছেড়ে দিয়েছে। তাই বাড়তি কাজের চাপ নেই। খাওয়া আর ঘর গোছানো। ঘর তো এখন আর গোছানো লাগে না। শুধু খাওয়া আর বিশ্রাম। কিছু খেয়ে বাবা মা আর ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলল। ওর যে একটা সমস্যা হয়েছে সে কথা কাউকে বলল না। শুনলে সবাই চিন্তা করবে। রাত দশটা বাজতেই ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন সকালে অফিসে গিয়ে রহিমাকে নিয়ে থানায় গিয়ে নিরাপত্তা চেয়ে একটা সাধারণ ডায়েরি করে এলো। সাত দিনের ট্রেনিং শেষ করে বের হতেই আটটা বেজে গেল। অফিস থেকে বের হয়েই আজ রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে। রহিমা সেই পাঁচটায় চলে গেছে। ইস্, ওকে থাকতে বললে ভাল হতো। রাত আটটার পরে রিকশা কম পাওয়া যায়। সবাই যার যার মতো বাসায় চলে যায়। আধ ঘণ্টা রিকশার জন্য অপেক্ষা করে আল্লাহর নাম নিয়ে হাঁটা শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে নুসাইবা বুঝতে পারল ও বিপদে পড়তে যাচ্ছে। গলির মাঝামাঝি আসতেই চার জন মাতাল ছেলে ঘিরে ধরল। নুসাইবা ভয়ে চিৎকার দিতে পারল না। আস্তে আস্তে মাতালগুলো কাছাকাছি চলে এসেছে। হঠাৎ করে শিরদাঁড়া বেয়ে সেই অনূভুতি শুরু হয়। অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল সে। জ্ঞান ফিরে নিজের ঘরের বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করল। বাবা মা ও ভাইকে দেখতে পেল। আর একটি দৃশ্য দেখে খবই অবাক হলো। সেই কবুতরটি তার বিছানার আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নুসাইবা বলল, তোমরা কখন এলে? আমাকে কে নিয়ে এলো? আমাকে চারজন মাতাল ছেলে আক্রমণ করেছিল। আমি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাই। তারপর আর কিছু জানি না। মা বলল, রহিমা নামের একটি মেয়ে, তোর অফিস কলিগ না কি যেন? মেয়েটি ফোন করে আমাদের। ও তোর কাছে সারারাত ছিল। আমরা আসার পর চলে গেছে। পরে আবার আসবে। যা-ই হোক, তুই দুই দিনের অফিস ছুটি নিবি। কী হাল করে রেখেছিস শরীরের! আচ্ছা, ছুটি নেব। ভাই বলল, আপা তোর ঘরে কবুতর! কতো শান্ত হয়ে তোর কাছাকাছি ঘুরে বেড়াচ্ছে। তুই কবুতর কিনেছিস কেন আপা? নুসাইবা বলল, আমি কিনি নাই। একদিন কবুতরটি আঘাত পেয়ে রাস্তায় পড়েছিল, আমি যতœ করেছিলাম। পরের সপ্তাহ নুসাইবার খুব ভাল কেটে গেল। অফিস থেকে সাতদিন ছুটি পেয়ে ছিল। বাবা মা প্রায়ই এখন ওর কাছে এসে থাকে। তাই ও পুরো ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। সাতদিন বাবা মাকে আর ভাইকে নিয়ে আনন্দে দিন কাটিয়ে অফিসে নুন সিনিয়র জয়েন করল। বেতন বেশি হওয়ায় প্রুফ রিডিংয়ের কাজটা বাদ দিয়েছে। এখন ও খুব ভাল আছে। শুধু আলমারি গোছানোর বিষয়টি মাঝে মাঝে খুব ভাবিয়ে তোলে। এই রহস্যের সমাধান পেল না কিছুতেই।
×