ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রাহমান ওয়াহিদ

গল্প ॥ যুদ্ধ অবিরাম

প্রকাশিত: ০১:৩৯, ২৩ এপ্রিল ২০২১

গল্প ॥ যুদ্ধ অবিরাম

সার্চ লাইটের তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায় শুকুর আলীর। কানেও আসে আচমকা চিৎকার ধ্বনি- ‘কোন্ হ্যায় তুমলোগ্? কিধার জাঁরেহেঁ? বগলমে আ যাইয়ে, জলদি করকে..’ তির তির করে এগিয়ে চলা ডিঙি নৌকাটির গতি কমাতে বলে শুকুর আলী। সাথী মাহতাবের বৈঠার আওয়াজ কমতে থাকে। পাকি সেনারা দেখে ফেলেছে। নিশ্চিত বিপদের গন্ধ। ব্রহ্মপুত্র নদের শান্ত জলে সপ্তমীর প্রতিচ্ছায়া। আবছা জোছনা ও জলের ঝিকিমিকি খেলায় মেতে উঠেছিল রাতের শেষ প্রহর। শরতের মিষ্টি আমেজে প্রায় সবারই চোখ ধরে এসেছিল ঘুমে। চোখ খোলা রাখতে হয়েছিল শুধু কমান্ডার শুকুর আলীকে। কিলো দুই দূরেই অপারেশনের টার্গেট। পাকি বাহিনীর বড় একটা ক্যাম্প। ওটা উড়িয়ে দিয়েই একসঙ্গে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরিকল্পনা ছিল সবার। ময়মনসিংহ শহরের ঝুঁকিবহুল এলাকা নির্বিঘেœ পার হয়ে আসার পর সামনের কিলো খানেক দূরের ঘাটটাই ছিল সম্ভাব্য বিপদের ঘাঁটি। কিন্তু ঘাটের আধা কিলোমিটার আগেই পাকি পাঁঠারা যে ওঁৎ পেতে থাকবে, তা কারও ধারণায় ছিল না। না থাকারই কথা। নদীর পাশে এসব ঝোড় জঙ্গলের সঙ্গে তো ওরা পরিচিত না। কিন্তু যুদ্ধ বলে কথা। বাঙালী বিচ্ছুদের হাতে মার খেতে খেতে এখন হয়ত ওরা নাকডোবা পানি খাওয়াও শিখে ফেলেছে। তা শিখুক। কৌশলের খেলায় এখনও পর্যন্ত হারেনি শুকুর আলীর অকুতোভয় গেরিলা দল। যোদ্ধাদের বয়স সতেরো থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। সাথীরা পাকি সেনার এমন বিদঘুটে হুংকারে গা ঝাড়া দিয়ে বসে। অনিশ্চিত এক পরিস্থিতির মুখোমুখি এখন ওরা। শত্রুর খাঁচায় ধরা দেয়ার ডাক। না শুনলে নিশ্চিত ঝাঁঝড়া হয়ে যাওয়া। সুতরাং নৌকা না ভিড়িয়ে উপায় নেই। কিন্তু তারপর? আদৌ কি বাঁচা যাবে? নৌকা সার্চ করলেই তো অস্ত্রসহ ধরা খাওয়া। তার মানে অনিবার্য মৃত্যুর আলিঙ্গন। তাহলে? অবোধ পাখির মতো ফুটো হয়ে ঢলে পড়া? জান থাকতে সেটাই বা কি করে সম্ভব? উপায়হীনতার এক বোধহীন অসহায়ত্ব পেয়ে বসে সবাইকে। উজানে পানি ঠেলে এগোতে সময় লাগছে। কৌশল ঠিক করার জন্য এই সময়টা ওদের দরকারও। কিন্তু পাকিরা তো উজান ভাটি বোঝে না। আরেকবার জোর তাড়া আসে একই গলায়- ‘কেয়া হুয়া ভাই? এত্না দের কিঁউ? আ যাইয়ে, আ যাইয়ে—-।’ শুকুর আলীর ইশারায় মাহতাব গলা ফাটিয়ে বলে, ‘আঁরেহেঁ..ভাইও..আঁরেহেঁ...’। তাতে আস্বস্ত হয় পাকিরা। ত্রিশ পেরোনো কমান্ডার শুকুর আলীর মাথায় তখন অন্য ভাবনা। এতক্ষণ সে চুপচাপই ছিল। কেউ কিছু বলছে না দেখে সবার দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলে সে- ‘কি রে, ঝিমাইয়া গেলি ক্যান হগ্গলে? বুঝতে পারছস না শোওয়াইয়া দেব কুত্তারা? কিন্তু আমার সাফ কথা-মুরগির লাহান মরণ যাইব না। বাঁচনের জন্য কী করা যায়, ঝটপট ভাইবা ক। সময় নাই।’ সাথীরা ফিসফাস করে। কমান্ডার কয় কী! খালি হাতে ফাইট দিয়ে বাঁচা যাবে ক্যামনে? মারতে গেলেই তো নির্ঘাত ফুটো হয়ে যাওয়া। জানটা তো আর এখন তাদের হাতে নাই। তাই বলে কাপুরুষের মতো স্যারেন্ডার? সেটাও তো সম্ভব না। তাহলে দু’চারটে পাকিকে খামছে ধরে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া আর উপায় কী? তাতে জান যায় তো যাক। দু’একটাকে নিয়ে তো মরা যাবে। সাথীদের এমন মনোভাবের কথা শুনে শুকুর আলী খেপে আগুন। রাগী গলায় বলে- ‘স্যারেন্ডার না করলে বাঁচবি ক্যামনে বলদেরা। এই বুদ্ধি লইয়া যুদ্ধে আইছস? স্যারেন্ডারেও বুদ্ধি লাগে। শোন্, যা কই কান খুইলা শোন।’ শুকুর আলী সাথীদের মধ্যে বসে নিজের পরিকল্পনাটা নিচু গলায় বুঝিয়ে বলে সবাইকে। থ মেরে যায় সবাই তার গা ছম ছম করা পরিকল্পনা শুনে। মুখে সায় দিতে হলেও মন মানতে চায় না কারোরই। কিন্তু শুকুর আলীকে ভাল করেই চেনে ওরা। এমনিতে সে খুব হাসি খুশি কিন্তু কোন অপারেশনে গেলে তাকে আর চেনা যায় না। শক্ত দুই চোয়ালের ফাঁকে চোখ দুটো শিকারি বাঘের মতো জ্বল জ্বল করে। এ সময় তার সঙ্গে কথা বলতেও ভয় পায় সবাই। যুদ্ধের কৌশলে ঝুঁকি নিতে সে বরাবরই বেপরোয়া। পাকিদের কয়েকটা শক্ত ঘাঁটি ইতোমধ্যে শুকুর আলীর নিখুঁত এ্যামবুশে ছাতু হয়ে গেছে। সেইসব জ্বলজ্বলে স্মৃতি এখনও সবার চোখের পাতায়। কিন্তু এবারের কৌশলটা নিয়ে দ্বিধা কাটে না কারও। এমন আত্মঘাতী কৌশলে শেষ রক্ষা হবে তো? পাকিদের এতটা বোকা ভাবা কি ঠিক হচ্ছে? ভুল করছে না তো কমান্ডার? কিন্তু কে বোঝাবে তাকে? দ্বিমতের কথা বলতে গেলেই কমান্ডারের নিশ্চিত গলা ধাক্কা খাওয়া। কমান্ডিং এ ঘাড় ত্যাড়ামি চলে না। নৌকা ঘাটে ভেড়ায় মাহতাব। শেষবারের মতো আবারও চাপা কণ্ঠ শুকুর আলীর- ‘শোন্,যা কওনের সব মাহতাব কইব। ও ভাঙা ভাঙা উর্দুতে যা যা কইব, তরা হক্কলে হ হ কইরা মাথা লাড়বি। গড়বড় য্যান্ না হয়। আমার দিকে কেউ তাকাবি না। কী, মনে থাকব তো?’ শুকনো ঠোঁটে মাথা নেড়ে সায় দেয় সাথীরা। মাহতাবই প্রথম নৌকো থেকে নামে। বর্ষা থেমে গেলেও নদীতে ¯্রােতের বেগ কম নয়। নৌকাটা দুলছিল পানিতে। পানিতে বৈঠা পুঁতে কোনরকমে নৌকাটাকে আটকে রাখে শুকুর আলী। নৌকার পাটাতনের নিচে লুকিয়ে রাখা ‘দামী মাল’ মানে অস্ত্রসস্ত্র গ্রেনেড নিয়েই তার দুঃশ্চিন্তা। পাকিরা নৌকা সার্চ করার সুযোগ পেলে কারও আর বেঁচে থাকার উপায় থাকবে না। সেজন্য কৌশল একটা সে ভেবে রেখেছিল আগেই। সবার শেষে নামার আগে সে বৈঠার ওপর ভর করে পেছন দিকে জোরে ঠেলা দিয়ে এমনভাবে আছড়ে পড়ল মাটিতে, যে সবাই ধরে নিল কমান্ডার পা হড়কে পড়ে গেছে। ততক্ষণে হালকা পাতলা নৌকাটি সর সর করে দক্ষিণমুখী ¯্রােতের টানে ভেসে গেল। পাকিরা ব্যাপারটাকে তেমন পাত্তা দিল না। হয়ত বোঝেওনি চালাকিটা। তারা যেন তেরো বাঙ্গালকে হাতের মুঠোয় পেয়েই মহাখুশি। পাকি সেনার ইশারায় লাইন করে দাঁড়িয়ে যায় তেরোজন। পেছন থেকে মোটা গোঁফওয়ালা একজন এগিয়ে আসে। সম্ভবত প্লাটুন কমান্ডার। সবার সামনে মাহতাব। পাকি কমান্ডারের লাল চোখ তার দিকেই- ‘কোউন হো তোম বাচ্চে? কেয়া নাম?’ ‘হাম পাকিস্তানী হ্যায় স্যার। মেরা নাম মুহম্মদ মাহতাবউদ্দিন বিশ্বাস।’ ‘কিধার, কিঁউ যাঁরেহেঁ থে তোমলোগ এতনা রাত মে? সাচ্ বাতাইয়ে গা।’ ‘ওয়াতানকো (দেশ) হেফাজত করনেকে লিয়ে হামলোক রাজাকার ক্যাম্প মে যাঁরাহা থা স্যার। লেকিন বান্চোদ ‘মুক্তি’কা কমান্ডার হামলোগকে পাকড়াও করকে...’ ‘কমান্ডার? কোন্ হ্যায় কমান্ডার? হ্যায় হিঁয়াছে?’ ‘জরুর হ্যায় স্যার। শুকুর আলী।’ মাহতাব শুকুর আলীর দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে। পাকি কমান্ডার শুকুর আলীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করে। চোখে ক্রুর হাসি। শুকুর আলী নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। ওর একটা হাতে হ্যাচকা টান দিয়ে পাশে এনে দাঁড় করায় পাকি কমান্ডার। পরে রয়ে সয়ে তাকে সাইজ করা যাবে-এমন একটা ভাব তার মুখে। চোখদুটো ঘুরিয়ে আবারও মনোযোগ তার মাহতাবের দিকে- ‘হাঁ। বলিয়ে, উসকো বাদ কেয়া হুয়া?’ ‘শুকুর আলী বন্দুক উঁচা করকে হামলোগকো কিস্তিমে (নৌকা) উঠা লিয়া।’ ‘উসকো বাদ’? ‘শুকুর আলী কাঁহা-আগার তুমলোগ মুক্তিমে নাম না লিখিয়ে গা তো সবকো গুলি করকে খতম কর দে গা। বহুত ডর লাগাথা স্যার। ইছলিয়ে উসকো সাথ .. গোস্তাকি মা’ফ কিযিয়ে স্যার...’ বলে শুকনো মুখে ভয়ের ভান করে পুরো শরীর কাঁপাতে থাকে মাহতাব। অন্যরাও ওর মতো করে ভীত সন্ত্রস্ত ভাব দেখাতে থাকে। ওদের এমন নিখুঁত অভিনয় দেখে মনে মনে খুশি হয় শুকুর আলী। পাকি কমান্ডারের আগুন চোখ এবার বাকি সবার দিকে। কমান্ডিং এর ভারি গলায় বলে, ‘এহি বাঙ্গাললোগ, মাহতাব জো বাতায়া,সাচ্ হ্যায় কি নেহি? বাতাইয়ে।’ মাহতাব সবার দিকে মুখ ঘুরিয়ে কৌশলে চোখ টিপে ইশারা করে। সাথীরা এক সঙ্গে মাথা দুলিয়ে মাহতাবের কথায় সায় দেয়। পাকি কমান্ডার সন্তুষ্ট বোঝা গেল। পাশের একজন সহকারী কমান্ডারকে চোখের ইশারায় মাহতাবসহ বারোজনকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে নির্দেশ দেয় কমান্ডার। এ পর্যন্ত শুকুর আলীর দ্বিতীয় কৌশলটিও ভালভাবে কাজে লেগেছে। এরপরে যা ঘটবে তা আর জানার সুযোগ থাকবে না শুকুর আলীর। কারণ এরপরের কৌশলটি প্রয়োগ হবে তার নিজেরই ওপর। তাতে বাঁচামরার চান্স ফিফটি ফিফটি। সেটা যা হবার হবে কিন্তু আপাতত সাথীদের সম্ভাব্য পরিণতিই শুকুর আলীকে ভাবিয়ে তুলেছে বেশি। যদিও সে ওদেরকে সুযোগের অপেক্ষায় শেষ পর্যন্ত রাজাকার পরিচয়েই থাকতে বলেছে এবং সেভাবে থাকতে পারলে সাফল্যও নিশ্চিত বলে আস্বস্ত করেছে, তবুও যেন ভরসা রাখতে পারছে না শুকুর আলী। যদি ওরা পাকিদের কথার প্যাঁচে মুখ ফসকে মুক্তিটুক্তি বলে ফেলে কিংবা রাইফেলের গুতো খেয়ে যদি আসল পরিচয়টা ফাঁস করে দেয়,তাহলে?-এমন দুঃশ্চিন্তা নিয়েই শুকুর আলী পাকি কমান্ডারের তালুবন্দি হয়ে ওদের ক্যাম্পে গিয়ে ঢোকে। ধুরন্ধর পাকি কমান্ডার আর তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা শুকুর আলীর মতো একজন বাঙ্গাল কমান্ডারকে হাতের মুঠোয় পেয়ে তাদের আনন্দের সীমা ছিল না। কমান্ডার নতুন বোতলের ছিপি খুলে তরল অমৃত গলায় ঢাললো কয়েকবার। অন্যরা ভুনা মুরগির সুগন্ধে মাতোয়ারা। কমান্ডার চাইছিল-শুকুর আলী রেডিওতে বিবৃতি দিয়ে বলুক যে, সে চাপে পড়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল কিন্তু এখন সে বুঝতে পেরেছে যে মুক্তিরা আসলে ভুয়া, হিন্দুদের পোষা দালাল, একজন সাচ্চা মুসলমান হয়ে কিছুতেই সে পবিত্রভূমি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যেতে পারে না। বাঙালীদের স্বাধীনতার নামে যে সব প্রচার করা হচ্ছে সেগুলোও ডাঁহা মিথ্যা, বানোয়াট। তাই সে এখন থেকে মাতৃভূমির অখ-তা রক্ষায় শত্রুর বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যাবে। তার বারো জন সাথী ইতোমধ্যে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। আরও অনেকে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে দলে দলে রাজাকার ক্যাম্পে আসছে।..এ জাতীয় গাদ্দারি কথাবার্তার একটা চিরকুট (ভাঙা ভাঙা বাংলায় লেখা) ধরিয়ে দেয়া হয়েছে শুকুর আলীর হাতে। তখন থেকেই ওর চোয়াল শক্ত। চোখে আগুনের ফুলকি। শুকুর আলীকে চেনে ওরা? কেন সে বলতে যাবে এসব বানানো ফালতু কথা? সে যে বাঘের বাচ্চা আর তার রক্তে যে স্বাধীনতার অপ্রতিরোধ্য স্বপ্ননদী বহমান, সে খবর জানে কি মাথামোটা কুত্তা পাকিরা? শুকুর আলী মাথা নোয়াবার বাঙালী নয়, তার কাছে মৃত্যু বলেও কিছু নেই। প্রচ- ক্ষোভে, ঘৃণায় এক দলা থু থু ছিটিয়ে শুকুর আলী জোর গলায় বলে- ‘না। কখনোই না। জান থাকতে শুকুর আলী এসব আজগুবি কথা কইবে না। তোরা যা পারিস কর গা যা। শুকুর আলী কাউরে ডরায় না।’ বাংলা তেমন না বুঝলেও এটুকু অন্তত পাকি কমান্ডার বুঝে নেয় শুকুর আলী এসব মানবে না। অবাক চোখে রাগে থর থর করে কাঁপে সে। মারার জন্য হাত তুলেও পরে নামিয়ে নেয়। সহকারীদের যে কোনভাবে শুকুর আলীকে রাজী করানোর চেষ্টা চালানোর নির্দেশ দিয়ে তাঁবুতে ঢোকে সে। সেই চেষ্টাতেই গত চার দিনে শুকুর আলীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত নানা কায়দায় অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। পরশু ওর হাতের নখগুলো নির্মমভাবে উপড়ে ফেলা হয়েছে। অসম্ভব যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠেছে শুকুর আলী। তাতেও লাভ হয়নি পাকিদের। আজ তার লম্বা গোঁফ এক টানে ছিঁড়ে ফেলা হলো। মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে শুকুর আলীর। চোখে অন্ধকার দ্যাখে। ঝর ঝর করে রক্ত ঝরতে থাকে ঠোঁট বেয়ে। সারা শরীরে টনটন করা অসহ্য ব্যথা। তা নিয়েই শুকুর আলী অপেক্ষায় থাকে পরবর্তী এ্যাকশনের জন্য। পাকি কমান্ডার এবার ওর চুল মুঠোর মধ্যে ধরে মিহি গলায় বলে, ‘শুনিয়ে শকুর আলী, আপকা পেয়ারী বা-রা (বারো) আদমি অলরেডি পাক্কা রাজাকার বনগেয়া। উনলোগ মুক্তিকো খতম করকে লিয়ে আভি জোরসে অপারেশন চালারাঁহাহেঁ। আওর আপ কেইসা বাঙ্গাল হো শকুর আলী, কোই বাতই শুনতে নেহি! মুক্তি হো কার কেয়া ফায়দা হ্যায় আপ, বাতাইয়ে? রাজী হো জায়েগা তো আরামকা জিন্দেগী আওর খুব সুরত লাড়কিভি মিলে গা। আওর মাংতে তো বহুত ইনাম ভি মিল যায়ে গা। বহুত ইনাম। আগার (যদি) রাজী না হোনেছে...।’ (শুকুর আলী এটকু অন্তত বুঝল যে তার সাথীরা রাজাকার হয়েই টিকে আছে, আর তাকে এখন লোভ দেখানো হচ্ছে। তাই) কথা শেষ না হতেই শুকুর আলী চোখ দুটো বন্ধ করে আবারও এক দলা থু থু ছোড়ে। এবার থুথুর জোরটা একটু বেশিই। কারণ তার বীর সাথীরা পাক্কা রাজাকার সেজে অপারেশনে গেছে। এবার পাকি কুত্তারা টের পাবে-বিচ্ছু বাঙালীদের কামড়ানি কাকে বলে। রক্ত ভেজা ঠোঁটেও এক টুকরো হাসি ফুটে ওঠে শুকুর আলীর। পাকি কমান্ডার পরের শাস্তির ধরন নিয়ে ভাবছিল। এ সময়েই এক জুনিয়র কমান্ডার দৌড়ে এসে স্যালুট দিয়ে জানায়- ‘স্যার, বহুত খারাব খবর মিলা। রাজাকার আদমিলোগকো আচানক খুন করকে সব ভাগ গিয়া।’ ‘কোউন লোগ ভাগ গিয়া? কেইসে ভাগা? ঠিকছে বাতাইয়ে।’ ‘শকুর আলীকা লোগ স্যার। নদীমে জাম্প দে কার ভাগ গিয়া। উনলোগ সব আস্লি মুক্তি থা স্যার। হামলোগকো বহুত বড়া ধোকা দে দিয়া স্যার!’ ‘ধোকা দে দিয়া? শকুর আলীকা লোগ?’ বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল পাকি কমান্ডারের। শুয়োরের মতো রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে আগুন ঝরা চোখে তাকায় সে শুকুর আলীর দিকে। শুকুর আলী বোঝে-পুরো সফল সে। এত কষ্টের মধ্যেও আনন্দে বুক ভরে যায় শুকুর আলীর। মনে মনে লম্বা স্যালুট জানায় সে বীর সহযোদ্ধাদের। বিকট হুঁংকার ছাড়ে এবার পাকি কমান্ডার- ‘লে যাইয়ে ইস গাদ্দার বাঙ্গালকো। হাজারো গোলী করকে ভেজদো (পাঠিয়ে দাও) মালাউনকো পাছ। আভি। ইস ওয়াক্ত।’ সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। অনড়, নির্বিকার শুকুর আলীর দু’হাত পেছনে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হলো নদীর পাড়ে। পাড় থেকে সামান্য একটু নিচে। ঠা-া পানির স্পর্শ পায় শুকুর আলী। বুঝে নেয়-এই পানিতেই শোয়ানো হবে তাকে। শক্ত করে চোখ বাঁধা হলো। খুব সামনেই নিশ্চিত মৃত্যু। মিনিট কয়েকের অপেক্ষা শুধু। তারপরও শক্ত দু’পায়ের ওপরে স্থির দাঁড়ানো শুকুর আলী। অন্ধকার চোখেও সে যেন দেখতে পায়-পত্ পত্ করে উড়ছে তার প্রিয় লাল সূর্যের পতাকা। পাকিরা একটু অবাকই হয় তার এই শক্ত চেহারা দেখে। হয়তো বা ভাবে-বাঙ্গালকা এতনা হিম্মত কেইসে মিলা? কেইসে? কে যেন বলে ওঠে- ‘রেডি হো যায়ে শকুর আলী। কলেমা পড়লিযিয়ে। জলদিছে’। শুকুর আলী এবার একটু নড়ে ওঠে। আন্দাজ করে নেয়-তার বুক বরাবর মেশিন গানের নল। কালেমা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গুলি। তার আগেই তাকে তার শেষ কৌশলটা কাজে লাগাতে হবে। কালেমা তো পুরোই পড়তে হয়- সে জানে। কিন্তু লুচ্চা পাকিরা সেটা পুরো পড়ার সুযোগ দেবে কি? ধুর! না দিলেই বা কি? ওসব ভেবে লাভ নেই। শেষ চেষ্টাটা করেই ছাড়বে সে। তাতে যা হবার হবে। আবারও হুংকার আসে- ‘কেয়া হুয়া শুকুর আলী? দের কিঁউ? কলেমা পড়িয়ে-’ ‘লা-ই-লা-হা ই-ল্লা-ল্লা-হু....’ এইটুকু পড়েই চোখের পলকে উল্টো পায়ে ঝাঁপ দেয় শুকুর আলী। মাথাটা পানিতে ডুবিয়েই সবটুকু শক্তি দিয়ে ভাটির দিকে ডুব সাঁতার কাটতে কাটতে দ্রুত এগোতে থাকে সে। দু একটা গুলি পানিতে ঝপাৎ ঝপাৎ করে পড়ার শব্দ পায় কিন্তু ততক্ষণে সে বিপদ সীমার বাইরে। ভাঙাচোরা শরীর আর এগোতে চায় না। জ্ঞান হারাবার আগে এটুকু শুধু মনে পড়ে ওর যে, কলেমা অর্ধেক পড়ার কৌশলটা সত্যিই কাজে লেগেছে। জ্ঞান ফিরলে নদীর অপর পাড়ে একটা পুরনো মাজারের কাছে নিজেকে আবিষ্কার করে শুকুর আলী। ভোরের মিষ্টি আলো ওর মুখে আদরের পরশ বুলিয়ে দিয়ে যেন বলছে , ‘উঠে দাঁড়াও শুকুর আলী। সময় যে বয়ে যায়...। ওঠো। যুদ্ধ যে চলছে অবিরাম...।’ (এক বন্ধু মুক্তিযোদ্ধার মুখ থেকে শোনা সত্যি ঘটনা অবলম্বনে রচিত)
×