ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাহামুদুল হক

বই ॥ মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক দলিল

প্রকাশিত: ০১:৩৯, ২৩ এপ্রিল ২০২১

বই ॥ মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক দলিল

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের (১৯৬৭-৬৯) সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে সদ্য-উত্তীর্ণ, কৃতী, সাহসী, উদ্যমী তরুণ দুই ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুরজিৎ ঘোষাল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে সরাসরি খবর সংগ্রহের তাগিদে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধরত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢোকেন। এরপর তাঁদের আর খোঁজ মিলেনি। ধারণা করা হয় তাঁরাও শহীদ হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে। শুধু এই দু’জন না, মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কলকাতার অনেক সাংবাদিক। কলকাতার লেখক-সাংবাদিক তথা সংবাদ মাধ্যম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছে। কলকাতা প্রেসক্লাবও বাদ যায়নি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায়। অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার নীরব সাক্ষী কলকাতা প্রেসক্লাব। এর মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম অন্যতম। অসিযুদ্ধের সাথে মসিযুদ্ধও চলতো সমানতালে, কলকাতা প্রেসক্লাবে ও কলকাতার গণমাধ্যমে। তবে বেশিরভাগ কলমযুদ্ধ কলকাতা থেকেই হতো। কারণ যুদ্ধরত বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের কালি-কলম নিয়ন্ত্রিত। অন্যদিকে কলকাতার সাংবাদিকরা খবর সংগ্রহ করেছেন রণাঙ্গন থেকে, কলকাতা প্রেসক্লাবে বসে মুক্তিযুদ্ধের খবর লিখেছেন, বিদেশি গণমাধ্যমকর্মীদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। প্রকৃত কলমযুদ্ধ হয়েছে কলকাতা থেকে। সে সময় বাংলাদেশের খবরই প্রধান খবর ভারতে। কলকাতার সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর হামলা ও হত্যাকাে র সব খবর সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন। রণাঙ্গনের ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে সবকিছুর দ্রষ্টা হয়ে রিপোর্টাররা লিখেছেন। কলকাতার রিপোর্টাররা সে সময় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের কলমযোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন। বাংলাদেশ সরকার ভোলেনি ওইসব কলমযোদ্ধাদের, মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু হিসেবে সম্মাননা দিয়েছে। কলকাতার সাংবাদিকদের মুক্তিযুদ্ধের ওইসব ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা এবং যুদ্ধের নির্মমতা ও হত্যাযজ্ঞের অজানা সব কাহিনী বর্ণিত হয়েছে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : কলকাতার সাংবাদিক কলকাতা প্রেসক্লাব’ শীর্ষক গ্রন্থ সংকলনে। প্রথমেই গ্রন্থটিতে ভারতীয় ওই দুই নির্ভীক শহীদ সাংবাদিককে উৎসর্গ করে তাঁদের অবদানের স্বীকারোক্তির চিহ্ন এঁকেছেন গ্রন্থস্বত্ববাধিকারী। গ্রন্থের প্রায় অর্ধশত পৃষ্ঠায় ওই সময়ে কলকাতার গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিকদের বাংলাদেশের চলমান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কলাম/মতামত স্থান পেয়েছে। সে সব তথ্যবহুল লেখা পত্রিকার পাতা থেকে তুলে আনা হয়েছে এই গ্রন্থে। এসব লেখা কলকাতার সংবাদ মাধ্যম কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের মর্মস্পর্শী ভূমিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল বসুর মতো প্রথিতযশা লেখক-সাংবাদিকগণ মুক্তিকামী জনগণের সঙ্গে লেখনির মাধ্যমে সংহতি জানিয়েছিলেন। এছাড়া ৪৭ জন প্রথিতযশা সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধে কীভাবে খবর সংগ্রহ করেছেন, খবর ব্যবস্থাপনা করেছেন, কীভাবে দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি অভিজ্ঞতা-সাক্ষ্য বর্ণনাসহ তাদের প্রবন্ধে অজানা আরেক ইতিহাস রচিত হয়েছে। ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : কলকাতার সাংবাদিক ও কলকাতা প্রেসক্লাব’ গ্রন্থটি সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন কলকাতা প্রেসক্লাবের সভাপতি স্নেহাশিস সুর। ২০১৯ সালে কলকাতা প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার ৭৫তম বর্ষ উপলক্ষে গন্থটি প্রথম প্রকাশ করে কলকাতা প্রেসক্লাব। ২০২০ সালে গ্রন্থটি ঢাকা থেকে প্রকাশ করেন বাংলাদেশ জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান এমপি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এবছর গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ কভার করার জন্য কলকাতার গ্রান্ড হোটেল হয়ে ওঠে বিদেশী সাংবাদিকদের আস্তানা। বাংলাদেশের যুদ্ধ কলকাতা প্রেসক্লাবকে সুধারসে ভরিয়ে তোলে। কেউ আসে খবর সংগ্রহ করতে, কেউ খবর হতে। কলকাতার সংবাদ মাধ্যমের সংবাদ ও ছবি বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। বিশ্ববাসী জানতে পারে মুক্তিকামী জনগণের ওপর পাকিস্তানী আর্মির পৈশাচিক বর্বরতা। এভাবেই বিভিন্ন তীর্যক লেখার মাধ্যমে তৎকালীন কলকাতার সাংবাদিকরা অভিজ্ঞতার বয়ান করেছেন এই গ্রন্থে। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে বর্তমান চুয়াডাঙ্গায় ভারতীয় সাংবাদিকদের সাথে আমেরিকান সাংবাদিকের এক বাকযুদ্ধ হয়। কারণ ওই আমেরিকান সাংবাদিক ভারতীয় সাংবাদিকের কাছে জানতে চান- ইজ ইট ইস্ট পকিস্তান? ভারতের পিটিআইয়ের রিপোর্টাররা উত্তরে বলেছিলেন- নো, দিস ইজ বাংলাদেশ। ইতিহাসের এমন চরম সত্য ঘটনা সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্তের লেখনিতে উঠে এসেছে, স্থান পেয়েছে এ গ্রন্থে। তাই গ্রন্থখানি ইতিহাসের আরেকটি আকর গ্রন্থ বলা যায় নির্দ্বিধায়। কলকাতা প্রেসক্লাবের সভাপতি স্নেহাশিস সুর তাঁর গ্রন্থাভাষে বলেছেন, ‘একটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রতিবেশী দেশের সহায়তা এবং ফলশ্রুতিতে একটি সর্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম, এই বিশাল কর্মকাে র প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের অভিজ্ঞতায় ভরা এই সঙ্কলন গ্রন্থটি এক ঐতিহাসিক দলিল...।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্ধশত বর্ষের প্রাক্কালে গ্রন্থটি ইতিহাসের নতুন দলিল হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে, যা মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা ইতিহাস জানার খোরাক জোগাবে। সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, গবেষকসহ ইতিহাস পিপাসুদের গ্রন্থখানি জ্ঞানপিপাসা মেটাবে বলেই আমার বিশ্বাস। সাংবাদিকরা ইতিহাসের স্রষ্টা নন, ইতিহাসের দ্রষ্টা। ইতিহাসের নির্মম সত্য উদঘটিত হয় সাংবাদিকদের লেখনিতে। গ্রন্থখানি সাংবাদিক তথা কলমযোদ্ধাদের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ লেখনীতে ভরপুর বাংলাদেশের ঐতিহাসিক তথ্যের নিরেট দলিল। অসিযুদ্ধ, মসিযুদ্ধ ও বাকযুদ্ধের ফলে এই স্বাধীন সোনার বাংলাদেশ। এ সবের বয়ান-বিবরণ উঠে এসেছে কলমযোদ্ধাদের লেখনীতে। তাই গ্রন্থখানি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অবশ্য পাঠ্যও বটে।
×