ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হেফাজতী তাণ্ডব এ পর্যন্ত ১৪ জন গ্রেফতার

বাবুনগরীসহ ৪৮ নেতার তালিকা তৈরি, পুলিশ খুঁজছে

প্রকাশিত: ২৩:৫০, ২৩ এপ্রিল ২০২১

বাবুনগরীসহ ৪৮ নেতার তালিকা তৈরি, পুলিশ খুঁজছে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সহিংস সন্ত্রাসের তা-বের ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির আমির জুনায়েদ বাবুনগরীসহ হেভিওয়েট ৪৮ নেতার তালিকা তৈরি করেছে পুলিশ। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এদের সন্ধান দিয়েছে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক। তালিকা অনুযায়ী এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে ১৪ জন। অপর ৩৪ জনকে খুঁজছে পুলিশ। সরকারের কঠোর অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত গ্রেফতার অভিযানের মুখে হেফাজত আমির বাবুনগরী গ্রেফতার এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। বাবুনগরী গ্রেফতার হওয়ার পর হেফাজতের আমির পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়ে আমির পদে আল্লামা শফী পুত্র আনাস মাদানী কিংবা বর্তমান মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদীকে বসানোর প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত বলে জানা গেছে। স্বাধীণতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করে দেশব্যাপী সন্ত্রাসের তা-বের ঘটনায় এখন কোণঠাসা হেফাজতে ইসলাম। সরকারের কঠোর ভূমিকাতে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে সহিংস ঘটনায় দায়ের করা মামলার জালে আটকা পড়ছে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে শাহাদাত বরণ করে জান্নাত পাওয়ায় জন্য জিহাদের ডাক দেয়া নেতারাও এখন গা ঢাকা দিয়েছে। হেফাজতের নাশকতাসহ সহিংস সন্ত্রাসের তা-বের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা। সোনারগাঁও রিসোর্টকা-ের পর বেরিয়ে এসেছে হেফাজত নেতা মামুনুলের একাধিক বিয়ের ঘটনা। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এসব বিয়েকে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ বলেছেন মামুনুল হক। মামুনুল হকের এই কথা শুধু হেফাজতে ইসলামকেই নয়, গোটা আলেম সমাজকে ইমেজ সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তদন্ত সংর্শ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আদালত থেকে সাতদিনের রিমান্ড নিয়ে পুলিশের হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মামুনুল হক অন্তত ৪৮ জনের নাম বলেছেন যারা দেশব্যাপী নাশকতাসহ সহিংস সন্ত্রাসের তা-বের ঘটনায় সম্পৃক্ত। মামুনুল হক যে ৪৮ জনের নাম বলেছেন তাদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে ১৪ জনকে। অপর ৩৪ জন এখনও পলাতক। যারা পলাতক তাদের অনেকের বাড়িতেই খোঁজ করেছে পুলিশ। হেফাজতের এসব আলেম ওলামা কেরাম বলে যারা এতদিন ওয়াজ মাহফিলে পরিচিত ছিলেন তাদের মতো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের পালিয়ে বেড়ানোর ঘটনা অদূর ভবিষ্যতের জন্য কলঙ্কময় ঘটনার নজির হয়ে থাকবে বলে মনে করেন তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। হেফাজতে নতুন নেতৃত্ব আসছে ॥ তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, ওয়াজ মাহফিলে বয়ানে ধর্মের অপব্যাখ্যা করে সরকারবিরোধী রাজনীতি করার কারণে যারা উগ্রপন্থী আলেম ওলামা কেরাম নয় তারাও এই বিষয়গুলোকে ঘৃণার চোখে দেখছেন। সমমনা অন্য দলগুলোও হেফাজতের সরকারবিরোধী রাজনীতির সহিংস কর্মকা- নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে শুরু করেছে। হেফাজত থেকে পদত্যাগ, হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা, বিবৃতি প্রদান করা অব্যাহত আছে। এসব ঘটনার ধারাবাহিকতায় হেফাজতে ইসলামের ভাবমূর্তি উদ্ধার ও অক্ষুণœ রাখতে নতুন আঙ্গিকে সাজাতে চাইছেন সংগঠনকে। এ জন্য একটি পক্ষ ইতোমধ্যেই সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করে চলেছেন। যেহেতু হেফাজতে ইসলাম কোন রাজনৈতিক সংগঠন নয়, তাই ইসলাম প্রচার নিয়েই থাকতে চান ওই পক্ষ। হেফাজতে ইসলামের বর্তমান আমির জুনায়েদ বাবুনগরীকে বাদ দিয়ে প্রয়াত আল্লামা শফীর অনুসারীদের দিয়ে হেফাজতকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে চাচ্ছেন। এক্ষেত্রে বাদ পড়তে পারেন হেফাজত আমির বাবুনগরীসহ তার অনুসারী অন্তত দুই ডজন নেতা। বোর্ড গঠনের চিন্তা ভাবনা ॥ গেয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেছেন, বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক বা ইউটিউবে চোখ রেখে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে এক শ্রেণীর আলেম ওলামা মাশায়েখদের ওয়াজের নামে ধর্মের অপব্যাখ্যা। এসব আলেম ওলামা মাশায়েখদের ওয়াজ বা বয়ানে ধর্মের উগ্রপন্থী ব্যাখ্যা দেন। কওমি মাদ্রাসার কোমলমতি শিক্ষিার্থী, যুব সমাজকে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে শাহাদাত বরণ করে জান্নাতে যাওয়ার জন্য জিহাদের ডাক দেয়া হচ্ছে। জিহাদে ডাক দেয়ার নামে মূলত সরকারবিরোধী রাজনীতি করছেন তারা। বর্তমানে ফেসবুক ও ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওয়াজ মাহফিলের প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একেক মাওলানা তার মনগড়া মতবাদ দিয়ে ইসলামকে নানাভাবে উপস্থাপন করছে। একে বিভ্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মুসল্লিরা। পাশাপাশি নতুন প্রজন্মও প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছেন না। এ সমস্যা সমাধানে সরকার একটি বোর্ড গঠনের চিন্তা করছে। এই বোর্ডের অনুমতি নিয়ে ওয়াজ মাহফিল করতে হবে। যেসব মাওলানা ওয়াজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করবেন তারা এই বোর্ডের অনুমতি চাইবেন। অনুমতি পেলেই ওয়াজ করেতে পারবেন। আলেম ওলামা মাশায়েখদের নিয়ে গঠিত এই বোর্ড গঠন করা হবে। আইয়ুবী গ্রেফতার ॥ দেশব্যাপী তা-বের ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। সংগঠনের সহকারী মহাসচিব খুরশিদ আলম কাসেমীকে পাঁচদিনের রিমান্ড নিয়েছে পুুলিশ। এছাড়াও হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরীর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আতাউল্লাহ আমীনসহ তিনজনের পাঁচদিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেছে আদালত। রাজধানীর মতিঝিলে সহিংসতার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেফতার করেছে তাকে। মানিকগঞ্জের সিংগাইর থেকে বৃহস্পতিবার ভোরে তাকে গ্রেফতার করা হয় বলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক এএসপি আনম ইমরান খান জানিয়েছেন। হেফাজতের সাম্প্রতিক নাশকতা ও সহিংসতার ঘটনায় পল্টন থানায় দায়ের করা মামলায় খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহকারী মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর সহ-সভাপতি এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির আল্লামা খুরশিদ আলম কাসেমীর পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। বৃহস্পতিবার তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশ। ২০১৩ সালে রাজধানীর শাপলা চত্বরের হেফাজতের তা-বের ঘটনায় করা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করা হয়। পরে শুনানি শেষে পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকা মহানগর হাকিম বাকী বিল্লাহ। এর আগে, বুধবার বিকেল ৫টার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ওয়ারী বিভাগ। ওয়ারী গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) আব্দুল আহাদ জানান, কাসেমীর বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনায় মামলা রয়েছে। এ ছাড়াও হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরীর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আতাউল্লাহ আমীনসহ তিনজনের পাঁচদিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেছে আদালত। বৃহস্পতিবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বাকী বিল্লাহ রিমান্ডের এ আদেশ দেন। অপর দুজন হলেন- হেফাজত ইসলামের ঢাকা মহানগরীর সহ-সভাপতি মাওলানা জুবায়ের আহমদ ও হেফাজত নেতা মাওলানা সানাউল্লাহ। ২০১৩ সালের পল্টন থানায় দায়ের করা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাদের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করে ডিবি পুলিশ। শুনানি শেষে বিচারক পাঁচদিনের রিমান্ডের আদেশ দেন। এহেতাসামুল হক সাখী বিন জাকির গ্রেফতার ॥ হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ঢাকা মহানগরের সহ-দফতর সম্পাদক ও ইসলামী ছাত্র সমাজের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা এহেতাসামুল হক সাখী বিন জাকিরকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় তাকে পুরান ঢাকার আরমানিটোলা এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে ডিবির একটি দল। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, মাওলানা এহেতাসামের বিরুদ্ধে হেফাজতের সাম্প্রতিক তাণ্ডবে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এর আগে গত ১১ এপ্রিল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে হেফাজতের অন্তত ১৩ জন কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেফতার করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। মাদানী ফের রিমান্ডে ॥ স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর থেকে জানান, বিতর্কিত বক্তা রফিকুল ইসলাম মাদানীকে আবারও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদিনের রিমান্ডে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জিএমপির বাসন থানায় নেয়া হয়েছে। এর আগে জিএমপির গাছা থানার অপর একটি মামলায় গত রবিবার দুদিনের রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারগার-২ এর জেলার মোঃ আবু সায়েম জানান, ‘শিশু বক্তা’ হিসেবে পরিচিত রফিকুল ইসলাম মাদানীকে একটি মামলায় দুদিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের বাসন থানায় নেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ১টার দিকে তাকে পুলিশের প্রহরায় এ কারাগার থেকে বাসন থানায় নেয়া হয়।
×