ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হাতের নৈপুণ্যে তৈরি পণ্য যাচ্ছে ১৭ দেশে

হুইল চেয়ারে বসে ভাগ্যের চাকা ঘোরানো তরুণীর সাফল্যগাথা

প্রকাশিত: ২৩:৩৮, ২২ এপ্রিল ২০২১

হুইল চেয়ারে বসে ভাগ্যের চাকা ঘোরানো তরুণীর সাফল্যগাথা

মাহমুদুল আলম নয়ন ॥ তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে ছুটে চলার সামর্থ্য না থাকলেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার মনোবলই তার সাফল্যের স্বপ্ন সারথি। দু’পায়ে দাঁড়ানো বা মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে না ধরতে পারার আক্ষেপ নেই। আছে শুধু এগিয়ে চলা ও তার মতো অন্যদের জন্য কিছু করার দৃঢ়তা। হুইল চেয়ারে বসে অসহায়ত্বের সঙ্গে আত্মসর্মপণও নয়, হুইল চেয়ারের চাকার সঙ্গে ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে নিরন্তর সংগ্রামের এক প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছেন বগুড়ার জান্নাতুল ইসলাম মহুয়া। চলতশক্তিহীন এই তরুণী শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে সাফল্যে নিজের জীবন গল্প সাজাতে চান। অদম্য মনোবলের কারণে কিছু করার লক্ষ্য হইল চেয়ারে বসেই তিনি এখন উদ্যেক্তা। ব্যবহার করেছেন ডিজিটাল প্ল্যাটফরম। সুঁই-সুতার ছন্দে হাতের নিপুণতায় ঘরে তৈরি নানা ধরনের কাপড়ের হস্তশিল্প নিয়েই তার স্বপ্ন পথের যাত্রা। শাড়ি থেকে কামিজ, কুশন, বেডশিড, ওড়না, কটি, থ্রি-পিস, পর্দা, চাদরসহ পাঞ্জাবিতে হাতের সুনিপুণ কারুকাজে মহুয়া ও তার কর্মীদের তৈরি পণ্য এখন দেশের গ-ি পেরিয়ে বাইরের ১৭টি দেশের গ্রাহকের কাছে যাচ্ছে। অন লাইনে ব্যবসা ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার অসহায়ত্ব জয় করে মহুয়া প্রতিষ্ঠা পেতে চান একজন সফল উদ্যোক্তা হিসাবে। ছোটবেলা থেকেই মহুয়ার সঙ্গী হইল চেয়ার। হাঁটতে চলতে পারেন না। কারো সহায়তা ছাড়া হুইল চেয়ারে বসার সামর্থ্যও নেই। হাতের কবজি পর্যন্ত নড়াচড়া করতে পারেন। হুইল চেয়ারই তার সব কিছু। আর সার্বক্ষণিক সঙ্গী মা। মা’কে নিয়েই তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। সকালে মা তাকে হুইল চেয়ারে বসান আবার রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় পরম যতেœ বিছনায় শুইয়ে দেন। বগুড়ার চকলোকমান এলাকার মরহুম আব্দুল মজিদ ও সাহারা আখতার দম্পতির ৩ ছেলে মেয়ের মধ্যে মহুয়া ছোট। লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বাধা হতে পারেনি তার। চতুর্থ শ্রেণীতে প্রথম স্কুল। এরপর অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাল করে যাওয়া। স্কুল থেকে কলেজ কখনই ক্লাসে যাওয়া বাদ পড়েনি। মা সাহেরা হুইল চেয়ার ঠেলে পৌঁছে দিতেন স্কুল ও কলেজে। ২০১৪ সালে এইচএসসিতে মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫। স্বপ্ন ছিল বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার। তবে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা তার সে স্বপ্ন পূরণ না হলে বগুড়া সরকারী শাহসুলতান কলেজ থেকে ইংরেজীতে অনার্স করে এখন মাস্টার্স ফাইনালের অপেক্ষায়। বাড়ির আশপাশের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়িয়ে ৭ হাজার টাকা জমিয়েছিলেন মহুয়া। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও অন্য সবার মতো কিছু করে দাঁড়ানোর চেষ্টায় তার লক্ষ্য ছিল অনেক আগে থেকেই। প্রাইভেট পড়িয়ে জমানো টাকায় একটি এ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন কিনেন। এরপর থেকেই তার জীবন পাল্টাতে থাকে লক্ষ্যের দিকে। ২০১৬ সালের দিকে তিনি এক পরিচিত মহিলার হাতে তৈরি থ্রি-পিস ও বুটিকের পণ্য স্বজন ও প্রতিবেশীদের কাছে বিক্রি শুরু করেন। সেখান থেকে কমিশন পান ৬ হাজার টাকা। লেখা পড়ার সঙ্গে মহুয়া নিজের সামর্থ্যে কিছু করার স্বপ্ন পথের যাত্রার পুঁজি ছিল ওই ৬ হাজার টাকা। এই পুঁজি নিয়ে নানা রঙের সুতা ও আর বর্ণিল কাপড়ে নিজ হাতে তৈরি থ্রি-পিস বেডশীট, কুশন কভারসহ হাতে তৈরি ব্যবহার ও পরিধেয় নানা পণ্য বিক্রি শুরু করেন। এর সঙ্গে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে লক্ষ্য পূরণের যাত্রাও শুরু হয় তার। ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে অন লাইন প্ল্যাট ফরম ব্যবহার করে উদ্যোক্তা হওয়ার এই স্বপ্ন পথের যাত্রার তার লক্ষ্য- অসহায় ও প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য কিছু করা। মহুয়ার কথা- নিজে কিছু করতে না পারলে অন্যর জন্য যে কিছু করা যায় না। এটা মাথায় রেখে ২০১৭ সাল থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন অনলাইন বিজনেস প্ল্যাটফরমে যুক্ত হতে থাকেন। রংধুন নামে নিজের ফেসবুক পেজসহ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের গ্রুপের মাধ্যমে তিনি পণ্যর অর্ডার পান। যুক্ত হন ওমেন এ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) নামে একট্রি গ্রুপের সঙ্গে। পণ্যের বাজার তৈরি সংক্রান্ত একাধিক প্রশিক্ষণও নিয়েছেন অনলাইনে। শুরুতে মাত্র একজন কর্মীকে নিয়ে সুঁই সুতার ছন্দে কাপড়ের বিভিন্ন পণ্য তৈরি ও বিক্রি শুরু করেছিলেন অনলাইনে। এখন তার কর্মী অর্ধশত। বর্তমানে বগুড়ার শেরপুরের ছেনাকার চ-িপুর গ্রামে এক আত্মীয়ের বাসায় মা সাহেরা বেগম ও খালা নাছিমা খানমকে নিয়ে থাকেন। আশপাশের ২৫ জন এবং একই উপজেলার ধুনট মোড় এলাকার ২৫ জন নারী কর্মী নিয়ে তার কর্মযজ্ঞ। এর মধ্যে ১৫ জন রয়েছেন শিক্ষানবিশ। অর্ডার পাওয়ার পর কর্মীদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসে কাজ বুঝিয়ে দেন মহুয়া। কুমিল্লার খাদি থেকে রাজশাহীর মসলিন সিল্কসহ বিভিন্ন কাপড়ে তার রঙিন সুতা আর সুঁইয়ের নিপুণতায় তৈরি হয় মহুয়ার এক একটি স্বপ্ন। পণ্যের মান ও ভিন্নতার দিকে নজর রাখেন সবসময়। নিজে কাজ করার সঙ্গে কর্মীদের কাজের মান প্রতিনিয়ত তদারকি করেন তিনি। জান্নাতুল ইসলাম মহুয়া জানালেন, তার পণ্য যাচ্ছে জাপান, জার্মান, সুইজারল্যান্ড, আমেরিকা, কুয়েত, ব্রিটেন, কানাডা, মালয়েশিয়া অস্ট্রেলিয়া ও ইতালিসহ ১৭টি দেশে। অনলাইন প্ল্যাট ফরমের মাধ্যমে ব্যক্তি পর্যায় থেকে ছোট আকারে এসব অর্ডার আসছে। গত এক বছরে তিনি ৭ লাখ টাকার অর্ডার পেয়েছেন। বর্তমানে সুইজারল্যান্ড থেকে পাওয়া ছোট একটি অর্ডারের কাজ চলছে। মহুরার স্বপ্ন একজন সফল উদ্যোক্তা হিসাবে একদিন তার নিকট এসব দেশ থেকে ব্যক্তি পর্যায় ছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তার তৈরি হাতের কাজের বিভিন্ন পণ্যর অর্ডার আসবে। ইচ্ছে আছে ঢাকায় একটি শো রুম আর ছোনকা ও শেরপুর একটি অসহায় নারী- প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থানে একটি বড় মাপের কারখানা তৈরি। উদ্যোগের লভ্যাংশের বড় অংশ ব্যয় করতে চান অসহায় নারীদের কল্যাণে। তার ইচ্ছে একটি স্বয়ংক্রিয় হইল চেয়ার। যা তার কাজে সহায়তা করবে। মহুয়ার পিতা মারা গেছেন দু’ বছর আগে। বাবার স্বপ্ন ছিল মেয়েকে উচ্চ শিক্ষিত এবং বিসিএস ক্যাডারের যোগ্য হিসাবে তৈরি করা। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নয়, মেধা ও যোগ্যতা দিয়েই তার মেয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে। মহুয়া তার বর্তমান কাজের সঙ্গে ইংরেজীতে মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষার অপেক্ষায় রয়েছেন। আর বাবার ইচ্ছা পূরণে সামনের বিসিএস পরীক্ষাতেও অংশ নেয়া তার আরেকটি লক্ষ্য। তবে অসহায় ও প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু করার স্বপ্ন পূরণের যাত্রাও অব্যাহত রাখতে চান।
×