ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এপ্রিলে রেকর্ড রেমিটেন্স আহরণের প্রত্যাশা

১৫ দিনে এলো এক মাসের বেশি রেমিটেন্স

প্রকাশিত: ২৩:৩২, ২২ এপ্রিল ২০২১

১৫ দিনে এলো এক মাসের বেশি রেমিটেন্স

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বিশ্বজুড়ে মহামারী করোনার প্রকোপের মধ্যেও প্রবাসী বাংলাদেশীরা রেমিটেন্স পাঠানো অব্যাহত রেখেছেন। লকডাউনের মধ্যে গত ১৫ দিনে যে পরিমাণ রেমিটেন্স দেশে এসেছে, তা গত বছরের এপ্রিলের পুরো মাসের অঙ্ককে ছাড়িয়ে গেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি মাস শেষে রেকর্ড পরিমাণ রেমিটেন্স পাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, করোনাকালীন প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে প্রবাসীরা চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে রেমিটেন্স পাঠিয়েছে ১১৫ কোটি ৩২ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। গত বছর (২০২০ সাল) এপ্রিলের পুরো মাসে (৩০ দিনে) রেমিটেন্স এসেছিল ১০৯ কোটি ২৯ লাখ ৬০ হাজার। সেই হিসাবে ১৫ দিনেই পুরো মাসের চেয়ে ৬ কোটি ৩ লাখ ডলার বেশি রেমিােন্স এসেছে। প্রবাসী আয়ের এ গতি অব্যাহত থাকলে চলতি এপ্রিল মাস শেষে রেমিটেন্স আহরণ ২৩০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। তবে ব্যাংকাররা বলছেন, সব সময় ঈদের আগে প্রবাসীরা দেশে বেশি অর্থ পাঠান। সামনে ঈদ-উল-ফিতর। ঈদ উপলক্ষে মাসের বাকি দিনগুলোতেও রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়বে। এ মাসে রেকর্ড পরিমাণ রেমিটেন্স আসবেÑ প্রত্যাশা তাদের। এর আগে করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যে গত বছরের জুলাই মাসে মাইলফলক রেমিটেন্স পায় বাংলাদেশ। ওই মাসে প্রবাসীরা প্রায় ২৬০ কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন। এর আগে কোন একক মাসে এত রেমিটেন্স আসেনি। ওয়েব আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৬ থেকে ৭ লাখ মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন। তারা বছরে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠান। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এ অঙ্ক দেশের মোট রফতানি আয়ের অর্ধেকের বেশি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বর্তমানে ১৭৪টি দেশে বাংলাদেশ শ্রমিক পাঠিয়ে আসছে, অঙ্কে যার সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২০ লাখের বেশি। যাদের তিন-চতুর্থাংশ কর্মরত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশী শ্রমিক রয়েছেন এমন অনেক দেশ এখনও লকডাউন হয়নি। আবার লকডাউন হলেও পরিবার চালাতে ঋণ করে হলেও অনেকে টাকা পাঠাচ্ছেন। করোনার কারণে উন্নত দেশ থেকেও আয় আসা বেড়েছে। তবে এভাবে কতদিন আসবে তা অনিশ্চিত। এখনই প্রবাসীদের সহায়তায় সরকারের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের মার্চে মাসে রেমিটেন্স এসেছে ১৯১ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। এটি আগের মাস ফেব্রুয়ারির তুলনায় প্রায় ৮ শতাংশ এবং গত অর্থবছরের একই মাসের চেয়ে ৫০.৪০ শতাংশ বেশি। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ১৭৮ কোটি ডলার রেমিটেন্স আসে। আর গত অর্থবছরের মার্চ মাসে মাত্র ১২৭ কোটি ৬২ লাখ ডলারের রেমিটেন্স এসেছিল। সব মিলে চলতি অর্থবছরের (জুলাই-মার্চ) প্রথম ৯ মাসে রেমিটেন্স এসেছে এক হাজার ৮৬০ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৮২ কোটি ৯১ লাখ ডলার বা ৩৫.০৫ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে দেশে রেমিটেন্স এসেছিল এক হাজার ৩৭৭ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। আর গত অর্থবছরের পুরো সময়ে এসেছিল এক হাজার ৮২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘২ শতাংশ হারে প্রণোদনা, কোভিড-১৯ আতঙ্কে যার কাছে যে সঞ্চয় ছিল তা পরিবার-পরিবার পরিজনের কাছে পাঠিয়ে দেয়ায় রেমিটেন্স প্রবাহ ইতিবাচক ধারায় রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাংকে টাকা রাখলে কোন মুনাফা বা সুদ পাওয়া যায় না। অথচ বাংলাদেশে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে ১১ থেকে সাড়ে ১১ শতাংশের মতো সুদ পাওয়া যায়। প্রবাসী বন্ডের সুদের হারও ১১ শতাংশের ওপরে। ‘সে কারণে বেশি মুনাফার আশায় অনেক প্রবাসী এখন প্রবাসী বন্ডে বিনিয়োগ করছেন। পরিবারের অনেক সদস্যের নামে সঞ্চয়পত্র কিনছেন। তার একটা প্রভাব রেমিটেন্সে পড়েছে।’ মহামারীর কারণে হুন্ডি প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে অর্থ পাঠানোয় রেমিটেন্স বেড়েছে বলেও মনে করছেন আহসান মনসুর। বলেন, ‘রমজানের ঈদ সামনে রেখে এই প্রবাহ আরও বাড়বে। সব মিলিয়ে উল্লম্ফনের মধ্য দিয়েই অর্থবছর শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে।’ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গেল মাস মার্চে আসা প্রবাসী আয় গেল বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। মার্চে প্রবাসীরা দেশে ১৯১ কোটি ৬৬ লাখ ডলার পাঠান। যা ২০২০ সালের মার্চে ছিল ১২৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার। এছাড়া চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) রেমিটেন্স এসেছে এক হাজার ৮৬০ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, প্রবাসী আয় পাঠানোর নিয়ামকানুন সহজ করা, ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনাসহ সরকারে বিভিন্ন সংস্কারমুখী পদক্ষেপ রেমিটেন্স বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এ অর্জন দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমাদের প্রত্যাশা এটি আরও বাড়বে। এ বিষয়ে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে। কাউকে হয়রানি হতে হয় না, রেমিটেন্স সময়মতো উপকারভোগীর হাতে পৌঁছে যায়। যে কারণে এটি দিন দিন বেড়েই চলেছে এবং বাড়তেই থাকবে।’ ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। অর্থাৎ কোনো প্রবাসী ১০০ টাকা দেশে পাঠালে তার সঙ্গে আরও ২ টাকা যোগ করে মোট ১০২ টাকা পাচ্ছেন সুবিধাভোগী। এছাড়া ঈদ ও উৎসবে বিভিন্ন ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সকারের প্রণোদনার সঙ্গে বাড়তি এক শতাংশ দেয়ার অফার দিচ্ছে। এতে বৈধ চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠাতে উৎসাহী হচ্ছেন প্রবাসীরা। সর্বশেষ গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক হাজার ৮২০ কোটি ডলার বা ১৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। অর্থবছর হিসাবে যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিটেন্স আহরণ। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে রেমিটেন্স আহরণের রেকর্ড হয়। ওই সময় এক হাজার ৬৪২ কোটি ডলার রেমিটেন্স আসে দেশে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে দেশের প্রবাসী আয় আহরণের শীর্ষ ১৫টি উৎস দেশ হলো সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), মালয়েশিয়া, ওমান, যুক্তরাজ্য, কুয়েত, কাতার, সিঙ্গাপুর, ইতালি, বাহরাইন, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স ও জর্ডান। রিজার্ভ ৪৩.৮৫ বিলিয়ন ডলার ॥ প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ওপর ভর করে বাংলাদেশের বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে। মঙ্গলবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৩ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। তবে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে।
×