ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নওগাঁর ‘পাখা গ্রাম’ ভালাইন ॥ তীব্র তাপদাহে কদর বেড়েছে তাল পাখার

প্রকাশিত: ১৭:১৯, ২১ এপ্রিল ২০২১

নওগাঁর ‘পাখা গ্রাম’ ভালাইন ॥ তীব্র তাপদাহে কদর বেড়েছে তাল পাখার

নিজস্ব সংবাদদাতা, নওগাঁ ॥ উত্তরের নওগাঁসহ বরেন্দ্র অঞ্চলে তীব্র তাপদাহে জনজীবন অতীষ্ঠ। প্রচ- গরমে একটু শীতল পরশ পেতে কার না ভালো লাগে। বিশেষ করে বৈদুতিক লোডশেডিংয়ের সময়। তাইতো গরমের দিনে একটু স্বস্তি পেতে বিদ্যুৎ নির্ভরশীল এলাকার মানুষের হাতের কাছেও তাল পাতার কদর বেড়ে চলেছে। চাহিদা বাড়ায় পাখা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার দুই শতাধিক নারী-পুরুষ। গ্রামটি ‘পাখা গ্রাম’ নামে ইতোমধ্যেই পরিচিতি পেয়েছে জেলা জুড়ে। কিন্তু আসলে এ গ্রামের নাম ‘ভালাইন’। মহাদেবপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৬কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে উত্তরগ্রাম ইউনিয়নের ভালাইন গ্রামে প্রায় ৩৫ বছর যাবত পাখা বানানোর কাজ চলছে। গ্রামে প্রায় ৭০টি পরিবারের বাস। দরিদ্র এসব পরিবারের সদস্যরা হাত পাখা তৈরিকে এখন পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। সময়ের পরিক্রমায় গ্রামটি এখন ‘পাখা গ্রাম’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। হাত পাখা তৈরি করে অনেকের সংসারে ফিরেছে স্বচ্ছলতা। আর এই পাখা শিল্পকে ঘিরে তৈরি হয়েছে একটি দাদনচক্র। তাদের হাতে শিকলবন্দী হয়ে আছে পাখার কারিগররা। তবে স্বল্প সুদে ঋণ ও সরকারি সুযোগ সুবিধা পেলে আরও এগিয়ে যাবেন বলে মনে করছেন এসব কারিগররা। পাখার কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্রীষ্মকালে বিশেষ করে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আশ্বিন, কার্তিক ও চৈত্রসহ কয়েকটি মাসে প্রচ- তাপদাহ এবং ভ্যাপসা গরম পড়ে। এসময় তাল পাতা দিয়ে তৈরি হাত পাখার চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যায়। প্রতি বছরই ভালাইন গ্রাম থেকে ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ সারাদেশে কয়েক লাখ পাখা সরবরাহ করা হয়ে থাকে। পাখা তৈরির উপকরণ তালপাতা বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে সংগ্রহ এবং পাখা বিক্রির কাজ মূলত পুরুষরাই করে থাকেন। পাতা রোদে শুকিয়ে পানিতে ভেজানোর পর পরিষ্কার করে পাখার রূপ দেয়া হয়। এরপর রঙ মিশ্রিত বাঁশের কাঠি, সুঁই-সুতা দিয়ে পাখা বাঁধার কাজটা করে গৃহবধূরা। সংসারের কাজের পাশাপাশি তৈরি করা হয় এ পাখা। বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ। পড়াশোনার পাশাপাশি এ গ্রামের শিক্ষার্থীরা পাখা তৈরি করে বাবা-মাকে সহযোগিতা করে। পাখার কারিগররা অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে। এ গ্রামের পুরুষেরা সংসারের হাল টানেন আর নারীরা গৃহস্থালির পাশাপাশি তালপাখা তৈরি করে সংসারের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। তবে পাখা তৈরিতে যে পরিশ্রম ও খরচ হয়, সে তুলণায় দাম পান না কারিগররা। দাদনচক্র ও বিভিন্ন এনজিও (বেসরকারি সংস্থা) থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে কাজ করতে হয় তাদের। স্বল্প পরিশ্রমে টাকা বিনিয়োগ করে বেশি লাভে বিক্রি করে ব্যবসায়ীরা। ২৭ বছর আগে বিয়ে করে ভালাইন গ্রামে আসেন গৃহবধূ আনজুয়ারা বেগম। এরপর দরিদ্র স্বামী মুক্তার হোসেনের কাছে পাখা তৈরির কাজ শিখেন। সেই থেকে পাখা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, সংসারে ফিরিয়েছেন স্বচ্ছলতা। তিনি বলেন, ‘পুরুষরা শুধু তালপাতা নিয়ে এসে শুকানোর পর পরিষ্কার করে দেয়। এরপর সাংসারিক কাজের পাশাপাশি গৃহবধূরা পাখাকে সুই-সুতা দিয়ে সেলাই ও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করে। একজন নারী প্রতিদিন ১০০-১২০ টা পর্যন্ত পাখা তৈরি করতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গ্রামের দুই শতাধিক মানুষ পাখা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। বিভিন্ন এনজিও এবং দাদন চক্রের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে তাদের পাখা তৈরি করতে হয়। সুদ দিতে লাভের একটি বড় অংশ চলে যায়। সরকার যদি স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে দিতো, তাহলে কিছুটা লাভ হতো।’ পাখার কারিগর আব্দুর রহিম ৩০ বছর থেকে নওগাঁ জেলার বিভিন্ন হাটে ঘুরে ঘুরে পাখা বিক্রি করেন। এটি তার পৈত্রিক ব্যবসা। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি তাল পাতার দাম পড়ে পাঁচ টাকা, বাঁশের কাঠি ও সুতা খরচ হয় দেড় টাকা। প্রতিটি পাখা তৈরিতে খরচ হয় সাড়ে ছয় টাকা। প্রতিপিচ পাখা ১২-১৩ টাকা দরে পাইকারি বিক্রি করা হয়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা ৩০-৩২ টাকা করে প্রতিটি পাখা বিক্রি করে।
×