ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকারোক্তি

কওমি শিক্ষার্থীদের মাঠে নামিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন মামুনুল

প্রকাশিত: ২৩:২৪, ২১ এপ্রিল ২০২১

কওমি শিক্ষার্থীদের মাঠে নামিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন মামুনুল

শংকর কুমার দে ॥ দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঠে নামিয়ে বর্তমান সরকারের পতন ঘটিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত হেফাজতে ইসলাম ও হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক। মঙ্গলবার দুপুরে মামুনুল হককে জিজ্ঞাসাবাদ বিষয়ে নিজ কার্যালয়ে ব্রিফিং দেয়ার সময় ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশীদ এ তথ্য জানান। তিনি জানান, উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে কওমি মাদ্রাসার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঠে নামিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেছিলেন মামুনুল। পূর্ব পরিকল্পিত ছক কষে হেফাজতে ইসলামের সহিংস সন্ত্রাসের তা-বকে সহযোগিতা করেছে বিএনপি-জামায়াত। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশের এক সপ্তাহ আগে বৈঠক করেছিলে তৎকালীন মহাসচিব ও বর্তমান আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। সোমবার আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে এমন তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ জনসেবা আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও হেফাজতের তৎকালীন ঢাকা মহানগর কমিটির প্রচার সম্পাদক মুফতি ফখরুল ইসলাম। মামুনুল হককে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করবে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। হেফাজতের তা-বের মামলা থেকে বাঁচার জন্য সোমবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আসাদুজ্জামান কামালের সঙ্গে তার ধানম-ির বাসভবনে দেখা করে সহায়তা চেয়েছেন হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের আলোচিত ৫ মে’র ঘটনার এক সপ্তাহ আগে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন মহাসচিব ও বর্তমান আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। ৫ দিনের রিমান্ড শেষে সোমবার, ১৯ এপ্রিল ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম দেবদাস চন্দ্র অধিকারীর আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে এমন তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ জনসেবা আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও হেফাজতের তৎকালীন ঢাকা মহানগর কমিটির প্রচার সম্পাদক মুফতি ফখরুল ইসলাম। এর আগে গত ১৪ এপ্রিল লালবাগ এলাকা থেকে মুফতি ফখরুল ইসলামকে গ্রেফতারের পর পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। রিমান্ড শেষে সোমবার তাকে আদালতে হাজির করা হয়। পরে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়। আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে মুফতি ফখরুল ইসলাম বলেন, ২০১৩ সালের ৫ মে’র সেই ঘটনায় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াতের একাধিক শীর্ষ নেতা অর্থ সহায়তা দিয়েছিলেন। এতে অংশ নিয়েছিলেন বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরাও। ৫ মে’র ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালের ৫ মে আমি কারাঙ্গীরচর মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক ও এলাকার ৮-১০ হাজার হেফাজত কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে লালবাগ-চকবাজার হয়ে নয়াবাজারে আসি। জোহরের নামাজ পর্যন্ত আমরা ৮-১০ হাজার লোকসহ এখানেই ছিলাম। জোহরের নামাজ আদায়ের পর দুপুর ২টার দিকে হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ সাহেব ফোন দিয়ে সবাইকে নিয়ে শাপলা চত্বরে যাওয়ার জন্য বলেন। জবানবন্দীতে তিনি আরও উল্লেখ করেন, শাপলা চত্বরে যাওয়ার সময় গোলাপশাহ মাজারের (গুলিস্থান) সামনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের বাধা দেয়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। দুপুর ৩টার দিকে তার নেতৃত্বে ৫-৭ হাজার শাপলা চত্বরে পৌঁছেন। শাপলা চত্বরে গিয়ে তিনি মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফি, জুনায়েদ আল হাবিব, মামুনুল হক, মাওলানা জাফর উল্লাহ, আবুল হাসনাতমহ অনেককেই দেখতে পান। এর মধ্যে ৪৩ জনের নাম জবানবন্দীতে উল্লেখ করেছেন তিনি। মামুনুল হকসহ অন্যান্য হেফাজত নেতারা তাদের ১৩ দফা দাবি আদায় না করতে পারলে সরকার পতনের আন্দোলন করা হবে বলে তাকে জানিয়েছিলেন। জবানবন্দীতে তিনি আরও বলেন, ‘মাওলানা মাঈনুদ্দীন রুহী তাকে বলেছেন, আন্দোলনের বিষয়ে দু’জন বিএনপি নেতা ও এক জামায়াত নেতা তাদের অর্থ সহযোগিতা করছে। এছাড়া ২৮ এপ্রিল (২০১৩) বাবুনগরীর সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠক হয়। বৈঠকে হেফাজতের প্রোগ্রাম শাপলা চত্বরে স্থায়ী হলে বিএনপি ও জামায়াতও যোগ দেবে বলে আলোচনা হয়। ২০১৩ সালের ৫ মে’র একদিন আগে ঢাকায় এক সমাবেশ থেকে হেফাজতের অবরোধ কর্মসূচীকে সমর্থন জানিয়ে নেতাকর্মীদের পাশে থাকার নির্দেশনা দিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। কিন্তু দলের একটি অংশ দ্বিমত পোষণ করায় সাংগঠনিকভাবে হেফাজতের অবরোধে অংশ নিতে পারেনি বিএনপি। বিচ্ছিন্নভাবে বিএনপি নেতাকর্মীরা হেফাজতের আন্দোলনে অংশ নেয়। তিনি কামরাঙ্গীরচর জামিয়া নূরীয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন। হেফাজতে ইসলামের বর্তমান কমিটির আগের কমিটির ঢাকা মহানগরীর প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জনসেবা আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও মারকাজুল আজিজ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হিসেবে কর্মরত বলে জবানবন্দীতে বলেছেন মুফতি ফখরুল। কোমলমতি কওমি শিক্ষার্থীদের মাঠে নামানোর ছক ॥ হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হকের রিমান্ড শুরু হয়েছে মঙ্গলবার। সোমবার তার ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হলে মঙ্গলবার থেকে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করছে গোয়েন্দা পুলিশ। মামুনুল হক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, ওয়াজের মজলিসে উঠলে শরীরে জোশ আসে। আর তা থেকে সরকার, মন্ত্রী ও দেশবিরোধী বক্তব্য এসে যায়। এসব তথ্য জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁ বিভাগের উপ কমিশনার হারুন অর রশীদ। এ ছাড়া তবলিগের সাদপন্থীদের মারধরের কথা স্বীকার করেছেন তিনি। কওমি মাদ্রাসাগুলোর কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ইসলাম ও খেলাফত রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনের নামে রাজপথে পুলিশের সামনে ঠেলে দিয়ে জিহাদ করার ডাক দিতেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন মামুনুল হক। রবিবার দুপুরে মোহাম্মদপুর থেকে মামুনুলকে গ্রেফতার করা হয়। নতুন-পুরান মিলিয়ে হেফাজতের তা-বের ঘটনায় রাজধানী ও নারায়ণগঞ্জের বেশ কয়েকটি মামলায় আসামি মামুনুল। এছাড়া ২০১৩ সালের ৫ মের নাশকতার ঘটনায় একাধিক মালার তদন্তে নাম এসেছে মামুনুলের। সোমবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় করা হত্যা চেষ্টা ও ধর্মীয় অনুভূতিতে বাধা দেয়ার মামলায় মামুনুল হককে ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। আজ মঙ্গলবার থেকে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করছে গোয়েন্দা পুলিশ। হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য রাষ্ট্র, সরকার ও ইসলামকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশিদ। মঙ্গলবার, ২০ এপ্রিল দুপুরে মামুনুলকে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে নিজ কার্যালয়ে ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান তিনি। ডিসি হারুন অর রশিদ বলেন, উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে মাদ্রাসার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঠে নিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেছিলেন মামুনুল। এছাড়া তবলিগের সাদপন্থীদের মারধরের কথা স্বীকার করেছেন তিনি। জোশের কারণে ওয়াজ মাহফিলের বক্তৃতায় বিশিষ্ট নাগরিকদের মানহানিকর বক্তব্য দিয়েছেন বলেও স্বীকার করেছেন মামুনুল। মামুনুল হককে রিমান্ড চাইবে সিআইডি ॥ সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক মাহবুবুর রহমান বলেন, হেফাজত নেতা মামুনুল হককে তারা নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় দায়ের করা মামলায় শীঘ্রই গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডের আবেদন জানানো হবে। নারায়ণগঞ্জে তা-বের ঘটনায় দায়ের করা একটি মামলায় প্রাথমিক তদন্তে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এখন তিনি (মামুনুল) একটি মামলায় রিমান্ডে আছেন। সেটি শেষ হলে আমরা তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে আবেদন করব। হেফাজতের তা-বের ঘটনায় ইন্ধনদাতা, সহযোগিতাকারী এবং সরাসরি নাশকতায় যারা অংশ নিয়েছেন, তাদের বিষয়ে খোঁজ রেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে রাতের বৈঠকে ॥ দেশজুড়ে তা-ব, সহিংসতা চালানোর পর একের পর এক বড় নেতা গ্রেফতারে দিশেহারা হেফাজতে ইসলাম। সোমবার, ১৯ এপ্রিল রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে বৈঠক করেন সংগঠনটির নেতারা। রাত ১০টার দিকে বৈঠকে হেফাজতের অন্তত ১০ জন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা উপস্থিত ছিলেন। তবে বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে সে বিষয়ে মুখ খুলছেন না কেউ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসা থেকে বের হয়ে আসার পর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কথা বলেন হেফাজত নেতারা। তবে গণমাধ্যমকর্মীদের এড়িয়ে যেত চাইছিলেন। এ সময় হেফাজতের মহাসচিব নূরুল ইসলাম জিহাদি বলেন, ‘আমি অসুস্থ। কথা বলতে পারছি না। পরে হেফাজতের মহাসচিব হিসেবে কিছু বলার অনুরোধ করা হলে তিনি বলেন, আমরা একটু কথা বলেছি। বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে মামুনুল হকের ভাই মাওলানা মাহফুজুল হক বলেন, আলোচনা হয়েছে, তবে আর কিছু বলার নেই। এরপর উপস্থিত কয়েকজন সাংবাদিক তাদের কাছে কিছু বলার অনুরোধ জানালেও তারা দ্রুতগতিতে গাড়িতে উঠে চলে যান। এর আগে রাত ১০টার দিকে হেফাজতের শীর্ষস্থানীয় নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় প্রবেশ করেন। এ সময় পুলিশের উর্ধতন কয়েকজন কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। এর আগে দুপুরে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে হেফাজতের পাঁচ শীর্ষ নেতা বৈঠক করেন। হেফাজতের পক্ষ থেকে বৈঠকে নেতৃত্ব দেন সংগঠনটির মহাসচিব মাওলানা নূরুল ইসলাম জিহাদি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বৈঠকে অংশ নেয়া হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে ছিলেন দলটির নায়েবে আমির মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজী, মহাসচিব নূরুল ইসলাম জেহাদী, মামুনুল হকের ভাই বেফাকের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক, অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান (দেওনার পীর), মাওলানা হাবিবুল্লাহ সিরাজী প্রমুখ। গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ৫০ বছর এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের বিরোধিতা করে আন্দোলনের নামে তা-ব চালায় হেফাজতে ইসলাম। সে সময় হেফাজতের শীর্ষ নেতাকর্মীদের নাম উল্লেখ না করেই একাধিক মামলা করা হয়। তবে ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে মামুনুল হকের রিসোর্টকা-ের পর শক্ত অবস্থানে যায় সরকার। নেপথ্যের রাজনীতিতে হেফাজত ॥ হেফাজতে ইসলাম শুরুতে দেশের রাজনীতিতে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে ধর্মীয় বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলে আলোচনায় ছিল। এবং দেশের মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ একটি অংশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতাও ছিল হেফাজতের। আর এর পেছনে অনেক বড় ভূমিকা ছিল হেফাজতের প্রয়াত আমির আল্লামা শাহ আহমেদ শফীর। তিনি আলেম হিসেবে যেমন সবার কাছে পছন্দের ছিলেন তেমনি একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে হেফাজতকে একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের তকমা ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু সমস্যা তখনই বাঁধে যখন আল্লামা শফীর মৃত্যু হয়। আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতে আমির হন জুনায়েদ বাবুনগরী। বাবুনগরী ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে হেফাজত তার অরাজনৈতিক তকমা হারাতে থাকে। তখন থেকেই একটি অংশের নেতাদের অভিযোগ ছিল বাবুনগরীর বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এবং নেপথ্যে থেকে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছেন বাবুনগরী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। হেফাজতের তা-ব এমন রূপ নেয় যে তারা অনেক বড় রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমেছে এবং তাদের কর্মকা-গুলো বিএনপি-জামায়াতের আদলে করা হয়। হেফাজতের নেপথ্যের বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের ধারণা ছিল হেফাজত তা-ব চালালে সরকার কঠোর হস্তে দমন করবে এবং দেশের অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হবে তখন তারা দেশকে অস্থিতিশীল করবে এবং সরকারকে বেকায়দায় ফেলবে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী হেফাজত তা-ব চালায় এবং মানুষের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের সেই জ্বালাও পোড়াও তা-বে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি দেখে বোঝা যাচ্ছিল বিএনপি-জামায়াত পেছন থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে আর সামনে আনা হয়েছে হেফাজতে ইসলাম নামক একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। এরপর থেকে হেফাজতে ইমলাম তার অরাজনৈতিক তকমা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু সরকার তখন নীরব অবস্থান গ্রহণ করে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের ভিডিও সংগ্রহ করে একে একে অপরাধীদের গ্রেফতার করতে শুরু করেছে এখন। আর এর সর্বশেষ গ্রেফতার করে হেফাজতের আলোচিত নেতা দলটির যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে। এরপর থেকে একে একে নেতাদের গ্রেফতার এবং দলের আমির বাবুনগরীও গ্রেফতার আতঙ্কে রয়েছেন। আর এসব কারণে দলের পরিস্থিতি নিয়ে হিসেব নিকেশে বসেছে দলটির শীর্ষ নেতারা। হেফাজতে ইসলামের নেতাদের অনেকেই এখন বলাবলি করছে, সংগঠনটির মধ্যে এখন একটি বিষয় সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে তা হলে অন্যের রজানৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হেফাজতের এই অবস্থা। আর এর জন্য দলের একটি বড় অংশই জুনায়েদ বাবুনগরী ও মামুনুল হককে দায়ী করছেন। তারা মনে করছেন বিএনপি-জামায়াতের আর্থিক ও রাজনৈতিক প্রলোভনে পড়ে হেফাজত বিপথগামী হয়েছে এবং তাদের সংগঠনের মূল আদর্শ থেকে সরে গিয়ে নেপথ্যের রজানীতির হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল আর এ জন্য সংগঠন হিসেবে হেফাজতকে মাশুল দিতে হচ্ছে। এই মাসুলের পরিমাণে কতটা ভয়াবহ হবে সেটার কারণে সংগঠনটি কি শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে যাবে তা নিয়েও দলের মধ্যে চলছে। হেফাজতের একটি বড় অংশ এখন চাইছে দল থেকে বাবুনগরী এবং মামুনুল হককে বাদ দিয়ে তুলনামূলক ক্লিন ইমেজের নেতাদের সামনে এনে আপাতত হেফাজতকে ‘হেফাজত’ করতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের একটি অংশের কলকাঠি নাড়ানোর কারণে হয়তো সেটা নাও হতে পারে। তারা নেপথ্যে থেকে হেফাজতে তাদের ভাবাপন্নদের ক্ষমতায় বসানোর পাঁয়তার করবে ফলে হেফাজতকে আগের জায়গায় ফিরে নেয়া কঠিন হবে। বিএনপি-জামায়াত নেপথ্যে থেকে হেফাজতকে তাদের মতো করে চালাতে চাইছে। এই নেপথ্যের রাজনীতি হেফাজতের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, হেফাজতে ইসলামের মূল নেতৃত্ব আর্থিক বা অন্য কোন কারণে কোন বিশেষ রাজনীতির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। হেফাজতের আমির বাবুনগরী ও যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল বিশেষ সুবিধার কারণে অন্য বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির প্রতি বেশি সাহনুভূতিশীল এটা স্পষ্ট। হেফাজতের নেপথ্যে থেকে বিএনপি-জামায়াত যে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিল সেটা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে। হেফাজতের স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করা হয়েছে প্রকাশ্যে। কিন্তু পর্দার আড়ালে ছিল সরকারের পতন ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার গভীর ষড়যন্ত্র। পূর্ব পরিকল্পিত ছক কষেই দেশব্যাপী ২৬ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত টানা তিন দিন সহিংস সন্ত্রাসের তা-ব চালিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে ‘থলের বিড়াল বেরিয়ে আসছে’ বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্মকর্তার দাবি।
×