ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রুমেল খান

ক্রীড়া অন্তঃপ্রাণ সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ

প্রকাশিত: ২০:৫৭, ২১ এপ্রিল ২০২১

ক্রীড়া অন্তঃপ্রাণ সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ

২২ মার্চ ভোরে জনকণ্ঠ সম্পাদক ও প্রকাশক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। ২৫ মার্চ বিকেলে বনানীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে শায়িত হয়েছেন অন্তিম শয়ানে। তার আগে নিজ হাতে গড়া প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান দৈনিক জনকণ্ঠে তাঁর জানাজা হয় এবং তাঁর শবদেহ রাষ্ট্রীয় পতাকায় ঢেকে পুলিশের একটি চৌকস দল তাঁকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অব অনার জানায়। ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় তাঁর স্মরণে অনুষ্ঠিত হয় মিলাদ মাহফিল ও দোয়া। মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ ছিলেন। জনকণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকর। ‘ছিলেন’ শব্দটি লিখতে গিয়ে হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে। কিন্তু এটাই নির্মম সত্য, চরম বাস্তবতা! মাসুদ স্যারের সঙ্গে গত সাড়ে ১১ বছরে দেখা হয়েছে অনেকবার। যতবারই সালাম দিয়েছি, ততবারই গম্ভীর মুখে মাথা ঝাঁকিয়ে নিঃশব্দে সালাম গ্রহণ করার দৃশ্যটি এখনও চোখে ভাসে। শুক্রবার স্যার ছুটি কাটাতেন। এছাড়া যতদিনই অফিসে গিয়েছি (ফিল্ডে কাজ না থাকলে) ততদিনই রাত ৮টার দিকে স্যারকে আমাদের ফ্লোরে দেখতে পেয়েছি। স্যার যখন নিজের চেম্বার নয় তলা থেকে লিফটে চড়ে ছয় তলায় আমাদের ফ্লোরে আসতেন, তখন তাঁর আসার দৃশ্যটি ছিল রীতিমতো দেখার মতো। তাঁর হাঁটার মধ্যে ছিল রাজকীয় ভাব। স্যারের পোশাক ছিল কখনও এক রঙা ফুল হাতা শার্ট ও প্যান্ট, কখনও বা ডিজাইন করা পাঞ্জাবি-পায়জামা। এক হাতে থাকত দামী রোলেক্স ঘড়ি, অন্য হাতে ব্রেসলেট। গলায় ঝুলতো সুদৃশ্য চেন। ভীষণ শৌখিন ছিলেন। মাথার সব চুল ও গোঁফ ধবধবে শাদা হলেও সেগুলো দেখতে দারুণ লাগত। জানা ছিল না কোন বয়স্ক ব্যক্তি এতটা সুপুরুষ, এতটা হ্যান্ডসাম, এতটা ড্যাম স্মার্ট হতে পারেন। কথাবার্তায় ছিলেন চৌকস সাবলীল ও স্পষ্টভাষী। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে তিনি বুঝি ভীষণ রাগী, রাশভারী ও গুরুগম্ভীর। তবে একবার পরিবেশ সহজ বা হাল্কা হয়ে গেলে, আলাপ জমে গেলে তাঁর মতো সদালাপী ও রসিক মানুষের জুড়ি মেলা ভার। খেলা বিষয়ক কিছু জানতে চেয়ে মাঝে মাঝে স্যার আমাদের ক্রীড়া সম্পাদক মজিবর রহমান ভাইকে ইন্টারকমে ফোন করতেন। মজিবর ভাই মাঝে মাঝে তার সিটে থাকতেন না (ওয়াশরুমে যাওয়া কিংবা পেজ মেকাপের জন্য)। তখন মাঝে মাঝে ফোন ওঠাতাম। স্যার তখন দরাজ গলায় বলতেন, ‘তুমি কে? মজিবর কই?’ নিজের পরিচয় দিলে স্যার তখন বলতেন, ‘রুমেল, তুমি কি বলতে পারবে অমুক খেলাটি কবে এবং অমুক খেলোয়াড়ের ইনজুরি বা পরিসংখ্যান কি?’ জানা থাকলে সঙ্গে সঙ্গেই বলতাম, নইলে বলতাম স্যার, জেনে আপনাকে জানাচ্ছি। স্যার ছিলেন ক্রীড়া সংগঠকও। অনেকেরই জানা নেই দেশের ক্লাব ফুটবলে স্থানীয় ফুটবলারদের মধ্যে প্রথম রেকর্ড পরিমাণ অর্থ দর উঠেছিল প্রয়াত তারকা ফুটবলার মোনেম মুন্নার। ৯০ দশকের শুরুতে ২২ লাখ টাকা দাম উঠেছিল মুন্নার। মাসুদ স্যার তখন ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান। তিনিই উদ্যোগী হয়েছিলেন তখনকার দেশের সেরা সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার মুন্নাকে ওই সময়ে ২২ লাখ টাকা দিতে। শুনেছি জাতীয় ক্রিকেট দল যেদিন ৯৯-এর বিশ^কাপে পাকিস্তানকে হারায়, সেদিনই মাসুদ স্যার ঘোষণা দিয়েছিলেন এই ঐতিহাসিক জয়ে জনকণ্ঠের প্রতিটি স্টাফ ওই মাসে একদিনের বেতন বেশি পাবে। ওই বিশ^কাপে খেলা বাংলাদেশের প্রতিটি ক্রিকেটারকে অনেক ঘটা করে ২০০০ সালে ১ লাখ টাকা অর্থ পুরস্কার দেন তিনি। জাতীয় ক্রিকেট দলকে কোন পত্রিকার পক্ষ থেকে প্রথম সংবর্ধনা ও প্রতিশ্রুত অর্থ পুরস্কার প্রদানের প্রথম নজির স্থাপন করে জনকণ্ঠ। একটি দৈনিক পত্রিকাও যে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের স্পন্সর হতে পারে, সে নজিরও স্থাপন করেছিলেন মাসুদ স্যার। ১৯৯৮-২০০০ এই তিন বছর ঢাকার প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগের স্পন্সর ছিল জনকণ্ঠ। স্যারের মহাপ্রয়াণের পর বাংলাদেশের সমস্ত সংবাদপত্রে, অনলাইন পোর্টালে, টিভি চ্যানেলে তাঁকে নিয়ে নিউজ হয়েছে। এখনও সারাদেশ থেকে বিভিন্ন সংগঠন শোকবার্তা পাঠাচ্ছে। তাঁর জীবনী পড়তে গিয়ে বেশকিছু অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেছি। সেগুলো আমার কাছে বেশ চিত্তাকর্ষক মনে হয়েছে। প্রথমেই আসি ‘৭১’ প্রসঙ্গে। মাসুদ স্যার ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরের মতো লড়াই করেছিলেন। আর তিনি ইন্তেকাল করেন ৭১ বছর বয়সে! তাঁর জন্ম ১৯৫২ ভাষা আন্দোলনের আগের বছরে। কাকতালীয়ভাবে তাঁর প্রকাশনায় জনকণ্ঠ সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে, ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে স্মরণীয় তারিখে! তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর মাসও বেশ স্মরণীয়। বাঙালী জাতির কাছে শোকের মাস হচ্ছে আগস্ট, সেই মাসেই তাঁর জন্ম। আর যে মাস হচ্ছে স্বাধীনতার মাস, সেই মার্চেই তিনি মারা গেলেন! গত ২২ মার্চ মাসুদ স্যার সবাইকে শোকসাগরে ভাসিয়ে আচমকাই চলে যান না ফেরার দেশে। কি আশ্চর্য, ওই একই দিন তাঁর বাবা দবির উদ্দিন খানেরও মৃত্যু তারিখ (তিনি মারা গিয়েছিলেন ১৯৬০ সালে)! স্যার যেদিন মারা যান, সম্ভবত তার দু-একদিন পর থেকে অফিসের প্রশাসন বিভাগ নিচতলায় স্যারের স্মরণে বাঁধানো একটি মোটা খাতার ‘শোক বই’ চালু করে। এজন্য একটি চেয়ার ও একটি টেবিলের ব্যবস্থা করা হয়। টেবিলের একপাশে স্যারের বাঁধানো বড় একটি ছবি। ২৫ মার্চ বইটিতে মন্তব্য করতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম সব পৃষ্ঠাই ফাঁকা, কিছুই লেখা নেই! অবাক হলাম। দায়িত্বরতদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, এটা দ্বিতীয় খাতা। প্রথমটি শেষ হয়ে গেছে। তাহলে কি প্রথমটিতে বেশিরভাগই মন্তব্য করে ফেলেছেন নাকি? উত্তর শুনে দ্বিগুণ বিস্মিত হলাম, ‘না। এখনও অফিসের অর্ধেক লোকই বাকি।’ মন্তব্য লিখে বইটি বন্ধ করে সেটা খুঁটিয়ে খঁটিয়ে দেখে মুগ্ধ হলাম। স্বীকার করতে বাধ্য হলাম এমন সুন্দর শোক বই জীবনে এই প্রথম দেখলাম। কালো রঙের চমৎকার কভার, তাতে চার কোনায় সুদৃশ্য নক্সা করা। ইংরেজীতে লেখা কন্ডোলেন্স বুক। তার নিচে স্যারের ছবি। তার নিচে লেখা ‘ইন লাভিং মেমোরি অব আওয়ার অনারেবল চেয়ারম্যান, হিরোইক ফ্রিডম ফাইটার, মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ।’ এরপর তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ-সাল। তারপর একটু গ্যাপ দিয়ে সবশেষে নিচে লেখা গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবার, এডিটর, প্রিন্টার এ্যান্ড পাবলিশার, দ্য ডেইলি জনকণ্ঠ। মন্তব্য লিখে শেষ করে চলে আসার আগে লক্ষ্য করলাম টেবিলের নিচে ও আশপাশে বেশকিছু ফুলের তোড়া। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী সংগঠনের ফুলের তোড়া সাজানো। ফুলের সৌরভে পুরো রুমটা ম ম করছে। মাসুদ স্যারও বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে এরকম সৌরভময় ব্যক্তিত্ব হয়ে থাকবেন চিরকাল। লেখক : স্পোর্টস রিপোর্টার, দৈনিক জনকণ্ঠ
×