ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ২১:০৩, ২০ এপ্রিল ২০২১

ঢাকার দিনরাত

মন খারাপ করা এক সময়ের ভেতর দিয়ে চলেছি আমরা। প্রতিদিনই জাতীয় পর্যায়ের কোনো গুণীজনের মৃত্যু-সংবাদ আসছে। প্রথমবারের মতো দেশে পর পর কয়েকটা দিন করেনায় মৃত্যুর সংখ্যা এক শ’ পেরিয়ে গেল। পুরনো রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়ছে। এই রেকর্ড গড়ার বিষয়টি যে নিদারুণ দুঃখের, মোটেই আনন্দের নয়, সে কথা না বললেও চলে। পবিত্র মাস রমজানের চিরচেনা ছবি বদলে গেছে। মসজিদগুলোতে ২০ জনের বেশি মুসল্লির নামাজ আদায় করার সুযোগ না থাকায় এবার ঘরে ঘরে হচ্ছে তারাবিসহ বিভিন্ন ওয়াক্তের নামাজ। বৈশাখের তীব্র গরমে রোজাদাররা যে ইফতারিতে ডাবের পানি খাবেন, সে উপায় কি আর আছে। একটি ডাব ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ বাজারে ডাবের এতটুকু ঘাটতি পড়েনি, যথেষ্ট পরিমাণেই সরবরাহ রয়েছে। তার মানে ঢাকার বাইরে থেকে ডাব আসছে। তার পরও এত বাড়তি দাম কেন, তার কোন সদুত্তর নেই। লেবুর দামও বাড়ছে এবার দফায় দফায়। রোজাদারদের জন্য লেবুর শরবতও ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। নক্ষত্র কি নিভে যায়! কিংবদন্তিতুল্য অভিনয়শিল্পী সারাহ বেগম কবরীর অকাল প্রয়াণ আমাদের চলচ্চিত্র অঙ্গনের জন্য এক বিরাট দুঃসংবাদ। মিষ্টি মেয়ে হিসেবেই সর্বস্তরে তাঁর পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা গড়ে উঠেছিল। এ তো আর এমনি এমনি পাওয়া নয়। একনিষ্ঠ সাধনা, ধারাবাহিকভাবে ভাল থেকে আরও ভাল কাজ করে যাওয়া এবং সমাজে ইতিবাচক ভাবমূর্তি ধরে রাখাÑ এর কোনটারই ঘাটতি ছিল না তাঁর। একবার সংসদ সদস্য পর্যন্ত হয়েছিলেন তিনি। বয়স তাঁর একাত্তর হয়েছিল বটে, কিন্তু তিনি ছিলেন কর্মঠ, সদা উদ্যোগী ও তারুণ্যে ভরপুর। সময়ের পরিবর্তনে পর্দার সামনে থেকে তিনি চলে এসেছিলেন পর্দার পেছনে, কাজ করতেন নেপথ্যে একজন চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবে। হাতে বেশ কিছু কাজ ছিল তাঁর। কিন্তু দুর্ভাগ্য করোনার কামড়ে তিনি পর্যুদস্ত হলেন। অল্প সময়ের মধ্যে রোগে ভুগে তিনি মারা গেলেন। লাইফ সাপোর্ট থেকে অনেকেরই ফিরে আসার নজির রয়েছে। কবরীও ফিরবেন এমন শুভ কামনা ছিল কোটি ভক্তকুলের। অমোঘ মৃত্যু শেষ পর্যন্ত তাঁকে ছিনিয়ে নিল। করোনাভাইরাসকে অভিসম্পাত দেয়া ছাড়া অসহায় আমাদের যেন আর কিছু করার নেই। তাঁর এই আকস্মিক প্রয়াণে শোকের প্রগাঢ় ছায়া নেমে এসেছে চলচ্চিত্রাঙ্গনে, সমাজের সর্বস্তরেই। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক প্রকাশ করেছেন। শোক জানাচ্ছেন সারা বাংলার সর্বস্তরের মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভরে উঠেছে শোকবিহ্বল বাক্যে। কবরীর নামোচ্চারণের সঙ্গে আমাদের মনের মণিকোঠায় ভেসে ওঠে বিশেষ একজন নায়কের মুখ, তিনি নায়করাজ রাজ্জাক। রাজ্জাক ও কবরীÑদু’জনের জীবনী আসতেই পারত আমার কলমে। কিংবদন্তি অভিধাটির স্বেচ্ছাচারী অপব্যবহার খুব চোখে পড়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের চিরকালীন সত্যিকার সেলিব্রেটি জুটি হলেন রাজ্জাক-কবরী, উভয়েই কিংবদন্তিতুল্য সর্বোচ্চ জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। রাজ্জাক আগেই প্রস্থান করেছিলেন, কবরীও অনুপস্থিত হয়ে গেলেন। সোনালি অধ্যায়ের যবনিকাপাত ঘটল। এই দুজন গুণী ব্যক্তির ভেতরের মানুষটাকে দেখার বাসনা নিশ্চয়ই আমার মতো বহুজনেরই ছিল। আমি সিনেসাংবাদিক নই, তাই দু’জনের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও ছিল না। আমিও উদ্যোগী হইনি। কিন্তু সাক্ষাত ঘটেছিল। সেই পনেরো-কুড়ি বছর আগের কথা। ভিন্ন ভিন্ন বছরে দুটি পত্রিকার পক্ষ থেকে ঈদ সংখ্যার লেখার প্রয়োজনে তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছিল। পত্রিকা কর্তৃপক্ষই দু’জনার সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দিয়েছিলেন। উত্তরার রাজলক্ষ্মী জায়গাটার নাম রাজ্জাক-লক্ষ্মী দম্পতির নামে, তরুণরা এ তথ্য জানবেন না। সেখানেই নায়করাজের কার্যালয়ে আমাদের প্রথম সিটিং। কয়েকদিন পর পরবর্তী দুটি সিটিং গুলশানে তাঁর বাসায়। আমাদের চোখে তো পর্দার নায়কের প্রিয়দর্শন মুখ আর চমৎকার হাসিই লেগে থাকে। তাই সর্বক্ষণ টুপি পরিহিত দারুণ ধার্মিক ব্যক্তির আদলে তাঁকে পেয়ে হতাশ হই। এক কথায় মানুষ হিসেবে উদার, প্রাণখোলা, কৃত্রিমতারহিত, সম্পূর্ণ ফিট, ভারসাম্যপূর্ণ মনে হয়েছিল তাঁকে। আর কবরীর সঙ্গে আলাপন এক বর্ষাদুপুর জুড়ে, বনানীতেই বোধহয়। তাঁর হাসির মূল্য এক কোটি টাকা মাত্র, সেটি তিনি বিলক্ষণ জানতেন। তবু হেলায়ফেলায় শতকোটি টাকা ছড়ানোয় তাঁর কার্পণ্য ছিল না। মনে হয়েছিল দারুণ সপ্রতিভ তিনি, সদাসজাগ আর স্পষ্টভাষী। দু’জনাই ভাল মানুুষ। রাজ্জাকের দীর্ঘ সাক্ষাতকার বেরিয়ে ছিল সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকায়। বলাবাহুল্য তাতে নিজের নাম দিইনি। আর প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় অপর লেখাটি গিয়েছিল কবরীর নামে। রাজ্জাক ও কবরী, দু’জনারই জীবন উপন্যাসোপম। আর কে না জানে বাস্তব জীবন হলো উপন্যাসের চাইতেও বিস্ময়কর, অভাবিত, উত্তেজনায় ভরপুর। খুব ভেবেচিন্তে নয়, কথায় কথায় বলে ফেলেছিলাম আত্মজীবনী লেখার কথা। দু’জনকেই। এ প্রসঙ্গে দুজনার ভাষ্য ছিল প্রায় কাছাকাছি: হ্যাঁ, এ নিয়ে ভেবেছি, কিন্তু তেমন লেখক পাইনি। আপনি লিখলে আছি। লিখবেন?... আবার তৎপর করোনাকালের প্রতারক কথায় বলে কারও সর্বনাশ, কারও পৌষ মাস। করোনাকাল এসে মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে। আর এই সঙ্কটকেই পুঁজি করে অপকর্ম চালিয়ে মুনাফা লোটার পাঁয়তারা করছে একদল অমানুষ। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসার পর এই অবৈধ কর্মের দ্বিতীয় ঢেউও শুরু হয়ে গেছে। অননুমোদিত মেডিক্যাল ডিভাইস আমদানি, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ মেডিক্যাল টেস্টিং কিট এবং রি-এজেন্টে জালিয়াতির মাধ্যমে নতুন করে মেয়াদ বসিয়ে বাজারজাতকরণের অভিযোগে রাজধানীর তিনটি প্রতিষ্ঠানে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে ৯ জনকে গ্রেফতার করেছে। জন্ডিস, ডায়াবেটিস, নিউমোনিয়া, করোনা, ক্যান্সার প্রভৃতি রোগসহ অন্যান্য প্যাথলোজিক্যাল টেস্টের জন্য এসব কিট ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ঘটনায় র‌্যাব বিপুল পরিমাণ অননুমোদিত, মেয়াদোত্তীর্ণ এবং ভেজাল টেস্ট কিট ও রি-এজেন্ট জব্দ করেছে। শুক্রবার র‌্যাব লালমাটিয়ায় বায়োল্যাব ইন্টারন্যাশনাল, তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বনানী থানা এলাকায় অবস্থিত এক্সন টেকনোলজি এ্যান্ড সার্ভিস ও হাইটেক হেলথ কেয়ার নামে তিনটি প্রতিষ্ঠানের ওয়্যারহাউজে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের প্রতিনিধিদের সহযোগিতায় অভিযান চালায়। গ্রেফতারকৃতরা হলেন বায়োল্যাব ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী শামীম মোল্লা, ম্যানেজার শহীদুল আলম, এক্সন টেকনোলজিস এ্যান্ড সার্ভিসেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুল হাসান, হাইটেক হেলথ কেয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম মোস্তফা কামাল, বায়োল্যাবের টেকনিশিয়ান আবদুল্লাহ আল বাকী ছাব্বির, জিয়াউর রহমান, সুমন, জাহিদুল আমিন পুলক ও সোহেল রানা। করোনাকালের নতুন ভয়ঙ্কর প্রতারকদের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকেই সজাগ থাকতে হবে। নজরদারি ও অভিযান বাড়াতে হবে। কেননা রোগীর পক্ষে এসব যাচাই করা অসম্ভব। গাড়ি বাড়ছে বহু মানুষ ঘরের বাইরে কঠোর লকডাউনের প্রথম দিন প্রথম রোজায় পরিস্থিতি কিছুটা সন্তোষজনক ছিল। এরপর পথে-ঘাটে মানুষ ও গাড়ির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। জনকণ্ঠের সিএনজি অটোরিক্সায় বাসা থেকে জনকণ্ঠ ভবনে আসা-যাওয়ার সময়ে সড়ক এবং সড়কের দু’পাশে যে চিত্র দেখেছি তাতে কোনভাবেই বলতে পারছি না যে লকডাউন যথেষ্ট সফল হচ্ছে। গত তিন দিন যাবত ঢাকা শহরে প্রচুর মোটরসাইকেল, প্রাইভেট গাড়ি এবং যন্ত্রচালিত রিক্সা দেখছি। গত বছরের কথা মনে আছে। সে সময় আমাদের কর্মীদের বহনকারী সিএনজির সামনের দিকে লাল কাপড়ের ব্যানারে সংবাদপত্র কথাটি যথারীতি লেখা ছিল। এ ছাড়াও উইন্ডস্ক্রিনের সঙ্গে জনকণ্ঠ/সংবাদপত্র লেখা স্টিকার থাকে। তাও দফায় দফায় ঢাকার পুলিশ আমাদের সিএনজি আটকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। সংবাদপত্র লেখা ব্যানার দেখেও গাড়ি আটকানোর কারণ হিসেবে এক পুলিশ সদস্য বলেছিলেন, অনেকেই এভাবে লিখে রাস্তায় বের হচ্ছেন। এবার একবারও আমাকে বহনকারী গাড়ির পথ আটকায়নি পুলিশ। আমার এক অধ্যাপক বন্ধু তার স্ত্রীর জন্য বিধি অনুযায়ী আবেদন করে মুভমেন্ট পাস সংগ্রহ করেছিলেন। ব্যক্তিগত গাড়িতে ভদ্রমহিলা ঢাকার ভেতরে পঞ্চাশ কিলোমিটার ভ্রমণ করেছেন। তাঁর কাছে একটিবারের জন্যও যাতায়াতের পাস দেখতে চায়নি পুলিশ। এত যে গাড়ি দেখছি রাস্তায় তার সবই কি যৌক্তিক কারণ দেখাতে পারছে বাইরে বেরুনোর? যদি না দেখাতে পারে তাহলে কি তাদের জরিমানা গুনতে হচ্ছে? সেই জরিমানার রিসিট কি তারা পাচ্ছেন? বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো না হলেই হয় ব্যাপারটা। অন্যদিকে বহু মানুষ হেঁটে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছেন। বাসস্ট্যান্ডগুলোতেও জটলা দেখছি, কোন না কোন গাড়ি আসবে এমন ভরসাই করছেন অপেক্ষারত মানুষ। সোজা হিসাব হলো, কোন একটি পয়েন্টে সড়কের আড়াআড়ি রেখা বরাবর সচল গাড়ি যদি অতিক্রম করে প্রতি কয়েক সেকেন্ড পর পর একটি করে, তা হলে মিনিটে কয়টি গাড়ি চলছে? ঘণ্টায় একটি রাস্তায় কত গাড়ি চলছে! সুপ্রচুর। তার পরও লকডাউনের বড় সুবিধা হলো দুটি। এক. প্রধান সড়কের দু’পাশের সব দোকানপাট বন্ধ থাকা, এমনকি অলিগলির ভেতরের দোকানপাটও নির্দিষ্ট কয়েকটি ঘণ্টা বাদ দিয়ে বন্ধ রাখার নিয়ম গড়ে ওঠা। দুই. সরকারী চাকুরের প্রায় শতভাগ, বেসরকারী ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের বড় অংশের কর্মকর্তা-কর্মচারী অফিস যাচ্ছেন না। অফিস বন্ধ। তবে তারা সব সময় ঘরে থাকছেন, এমনটিও নয়। এদেশে লকডাউন সফল করার জন্য মানুষের সদিচ্ছাটাই বড় ব্যাপার। জনভারাক্রান্ত ঢাকার জনচাপ অন্তত ৪০ লাখ মানুষ ঢাকা ছেড়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ভাড়াটিয়া পরিষদ। কিন্তু পরিবহন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ৫০ লাখ হতে পারে। যাদের বেশিরভাগ নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত। তবে পরিবহন খাতের নেতারা বলছেন, ১২ ও ১৩, এমনকি ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত সড়কে ছিল ভয়াবহ ভিড়। মানুষ যেভাবে পেরেছে বাড়ি গেছে। সদরঘাট, গাবতলী বাস টার্মিনাল, এমনকি পাটুরিয়া ঘাটে ছিল চোখে পড়ার মতো ভিড়। গত বছর সরকার যখন প্রথমবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল, তখনও এত লোক ঢাকা ছাড়েনি বলেও মন্তব্য করেন তাঁরা। আমরা আগেও দেখছি, তারাই শহর ছাড়ছে যাদের লকডাউনে ঢাকায় কাজ করার মতো কিছু থাকছে না। এতে সমাজে যে প্রভাব পড়ছে তার মধ্যে জীবনমান নেমে যাওয়া, শিক্ষা থেমে যাওয়া, গ্রামে গিয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হওয়ার পাশাপাশি দেশে নতুন দারিদ্র্যের সংখ্যা বাড়া। ঢাকা যারা ছেড়ে গেছেন তাদের ফিরে আসাটা হয়ত ঈদের পরেই হবে। শ্রমজীবী মানুষের অনুপস্থিতিতে ঢাকার ছন্দপতন ঘটে, প্রাণও অনেকটা ¤্রয়িমাণ হয়ে যায়, সে কথা দুঃখের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে। বাতাসে কি ছড়ায় করোনাভাইরাস? করোনাভাইরাস কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে এবং একই সঙ্গে সারা বিশ্বে আগ্রাসন চালিয়ে বছর পেরিয়েও মহাশক্তিধর হয়ে উঠতে পারে এ বিষয়ে বিজ্ঞানীদের কথা কোন দেশেরই সাধারণ নাগরিকবৃন্দ কানে তোলেননি। গত বছর মার্চ-এপ্রিলে দেখেছি ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশগুলোর সরকাররা হিমশিম খেয়েছে সংক্রমণ কমিয়ে রাখা এবং রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায়। অথচ খানিকটা অবাক হয়েই দেখতে হয় যে ভিয়েতনাম এক্ষেত্রে দারুণ সফল হয়েছে। কোন ফর্মুলায়? না, এমন কোরও জাদুকরী ব্যাপার নয়। তারা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সার্বিকভাবে করোনভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলা করেছে। একটু খোলাসা করে বলি। তাদের প্রস্তুতি ছিল আগেভাগেই। তিন স্তরের কনট্রাক্ট ট্রেসিং করেছে। সেটা কি রকম? আক্রান্ত ব্যক্তি তো আছেই, তারা কার কার সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং আক্রান্ত হওয়ার পর কাদেন সঙ্গে মিশেছেন- সবাইকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর পরের ধাপ আইসোলেশন বা তাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। করোনা টেস্ট অব্যাহত রাখা। সীমান্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া। শারীরিক দূরত্ব বজায়ে কড়াকড়ি আরোপ। প্রতিটি কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এই ধারাবাহিক কাজগুলোর জন্য জনবল দরকার। সত্যি বলতে কি আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এর প্রতিটি কার্যক্রম কীভাবে সফল করা সম্ভব সেটি চিন্তাও করতে পারছি না। সাধারণ লকডাউনই আমরা মানি না, এটি সফল করে তোলা যায় না। আর একজন কোভিড রোগী কার সংস্পর্শে এসেছিলেন, তাদের শনাক্ত করা অত সহজ কাজ নয়। এত এত নিরাপত্তাকর্মী ও স্বাস্থ্যকর্মী আমরা পাব কোথায়। তবে হ্যাঁ, আমরা সীমান্ত বন্ধ করতে পারতাম। বিদেশ থেকে আগতদের ক্ষেত্রে শতভাগ কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে পারতাম। আর বিশেষ বাহিনীর সহায়তা নিলে অন্তত সাতদিনের জন্য রাস্তা ও অলিগলি সুনসান রাখা সম্ভব হতো। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রিত রাখা টোটাল বা সার্বিক কাজ। এর কোনো একটি ধাপে সমস্যা থাকলে পুরোটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আমরা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না। আর অনিয়ন্ত্রিত সংক্রমণ হলে পৃথিবীর কোন দেশের পক্ষেই শতভাগ রোগীকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া সম্ভব নয়। অত বেড নেই হাসপাতালে। অত স্বাস্থ্যকর্মী নেই। সে কারণেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজের বুঝ নিজে বোঝা। নিজে সম্পূর্ণ সতর্ক ও সচেতন থাকা এবং সে অনুযায়ী সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ। এই কলাম লেখার সময়ে সুখবরটি এলো বার্তা বিভাগে। উদ্বোধন হলো ১০০০ শয্যার ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতাল। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম এতবড় হাসপাতাল শুধু করোনা রোগীদের জন্য তৈরি করা হলো। আইসিইউ বেড : ২১২, এইচডিইউ বেড : ২৫০ এবং আইসোলেটেড কক্ষ : ৫৩৮। এ ছাড়াও রয়েছে ৬ শয্যা ট্রায়াজ বেড ও ৫০ শয্যাবিশিষ্ট জরুরী বিভাগ। সব ক’টি বেডের সঙ্গেই অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর ও সিলিন্ডার রয়েছে। হাসপাতালটি মহাখালিতে। শনিবার থেকে বাংলাদেশ এবং ভারতের মিডিয়ায় সম্প্রতি আন্তর্জাতিক জার্নাল ল্যান্সেটে প্রকাশিত একটি গবেষণা নিয়ে যেসব রিপোর্ট প্রকাশ করা হচ্ছে (করোনাভাইরাস বায়ুবাহিত বা এটি বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়) তা জনমনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এই বিষয়ে ক্যানাডার টরন্টোতে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণরত একজন জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক শামীম আহমেদ জিতুকে অনুরোধ করেছিলাম অভিমত জানাতে। তিনি গত মার্চ থেকেই এ বিষয়ে নিয়মিত লিখে আসছেন। তাই তাঁর কাছ থেকে বাস্তবোচিত খাঁটি মত পাবো, এমনটাই প্রত্যাশা। তিনি সুন্দরভাবে তার বিশদ ও ইতিবাচক ব্যাখ্যা দেন। বলেন, গবেষণায় কী বলা হয়েছে, কেন এখনই এই ফলাফলকে চূড়ান্ত মেনে নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নেই এবং করোনা বায়ুবাহিত হলেও কেন আমরা আতঙ্কিত হব না, এই বিষয়ে আলোকপাত করেছি। এই গবেষকরা করোনাভাইরাস শুধু বাতাসে ছড়ায় কিনা সেটি জানার জন্য আলাদা কোন প্রাথমিক বা মৌলিক গবেষণা করেননি। করোনা সংক্রান্ত অন্যান্য গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে ধারণা প্রকাশ করেছেন যে করোনাভাইরাস সম্ভবত বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়, হাঁচি-কাশি থেকে বের হওয়া জলকণার মাধ্যমে নয়। বার বার মনে করিয়ে দিতে চাই যে করোনাভাইরাস বায়ুবাহিত নয় এমন দাবি কখনই করা হয়নি। শুরু থেকেই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলে আসছিলেন বাতাসের মাধ্যমে করোনা ছড়াতে পারে, তবে মূলত বাতাসে ভেসে বেড়ানো ‘ফৎড়ঢ়ষবঃ’-এর মাধ্যমে অর্থাৎ হাঁচি-কাশির সময় বের হওয়া জলকণার মাধ্যমে এই জীবাণু একজন থেকে আরেকজনে যায়। কিন্তু নতুন এই গবেষণাপত্রে বলা হচ্ছে ‘ফৎড়ঢ়ষবঃ’-এর মাধ্যমে অর্থাৎ হাঁচি-কাশি থেকে বের হওয়া জলকণায় ভেসে করোনাভাইরাস একজন থেকে আরেকজনে পৌঁছায় সেটি তারা মনে করেন না। তারা মনে করছেন এই ভাইরাস ছড়ানোর জন্য জলকণার দরকার নেই, শুধু বাতাসের মাধ্যমেই এটি ছড়াতে পারে। এই গবেষণায় ‘ফৎড়ঢ়ষবঃ’-এর গুরুত্ব কমিয়ে ‘ধবৎড়ংড়ষ’-এর গুরত্ব বাড়ানো হয়েছে। সহজ বাংলায়, হাঁচি-কাশি থেকে সতর্ক থাকলেই শুধু হবে না, বরঞ্চ শুধু দু’জন মানুষের কথা বলার সময়ে বাতাসে ছড়ানো ভাইরাসই কোভিড-১৯ সংক্রমণের জন্য যথেষ্ট এমন ধারণার ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। করোনা বায়ুবাহিত হলে নতুন কী কী সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার হতে পারে? ১। অন্যের শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে দূরে থাকতে হবে। শুধু ৬ ফুট দূরত্বে থাকলেই হবে না, ঘরে বাইরে যে কোন জায়গায় যেখানে পরিবারের সদস্যের বাইরে মানুষের আনাগোনা আছে সেখানে উন্নত মানের মাস্ক পরে থাকতে হবে। কেননা কেউ যদি ওই মুহূর্তে ওই জায়গায় নাও থাকে, তার ছড়ানো ভাইরাস বাতাসে থেকে যেতে পারে ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত। ২। হাঁচি-কাশির সঙ্গে সঙ্গে কারোর সঙ্গে কথা বলার দূরত্ব বাড়াতে হবে, গান গাইলে সেখান থেকে দূরে থাকতে হবে, চিৎকার করে কথা বলা মানুষ থেকে বা বক্তৃতা থেকে দূরে থাকতে হবে। ৩। বদ্ধ জায়গায় থাকা কমাতে হবে। নিজের বাসা নয়, এমন বদ্ধ জায়গায় পারলে না থাকার চেষ্টা করতে হবে। ৪। ঘরে থাকলে বা বদ্ধ জায়গায় থাকলে সেখানকার দরজা-জানালা খোলা রাখতে হবে, বদ্ধ জায়গায় বা ঘরে ভেন্টিলেশনের ভালো ব্যবস্থা রাখতে হবে। ৫। যেন তেন মাস্ক পরলে হবে না। মোটামুটি মানের মাস্ক হাঁচি-কাশির জলকণা থেকে প্রতিরক্ষা দিলেও বায়ুবাহিত ভাইরাস থেকে প্রতিরক্ষা দিতে পারে না, তাই মাস্কের মান বাড়াতে হবে। আমাকে যদি বলেন, আমি মনে করি মানুষের জীবনযাত্রায় বর্তমানের চাইতে বেশি পরিবর্তন আনা অসম্ভব প্রায়। ধরুন আপনার স্বামী বা স্ত্রী ব্যাংকে কাজ করেন। তিনি যদি সাধারণ মানের মাস্ক পরেন, তবে কর্মক্ষেত্র থেকে তিনি ভাইরাস এনে বাসায় ছড়িয়ে দিতে পারেন। এখন স্বামী বা স্ত্রীর মাধ্যমে ভাইরাস থেকে মুক্ত হবার জন্য আপনি কি বাসাতেও ২৪ ঘণ্টা মাস্ক পরবেন? এটি অসম্ভব একটি ব্যাপার। খাতা-কলমে আমি আপনাকে এই পরামর্শ দিতে পারি, কিন্তু আমার নিজের পক্ষেও সেটি মানা সম্ভব নয়। আমি মনে করি করোনাভাইরাস যে মাধ্যমেই ছড়াক না কেন, আমাদের করণীয় প্রধান কাজ হচ্ছে : ১) সুযোগ পেলেই ভ্যাক্সিন নিয়ে নেয়া। ২) যতদূর সম্ভব পরিবারের সদস্য নয়, এমন মানুষের সঙ্গে শারীরিক দেখা-সাক্ষাত এড়িয়ে চলা। ৩) বাইরে গেলে যতটা সম্ভব উন্নত মাস্ক ব্যবহার করা। ৪) মানসিক অবস্থা মানুষের শারীরিক সক্ষমতাকেও প্রভাবিত করে। সুতরাং মনকে চাঙ্গা রাখা, নাহলে ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শরীর ভাইরাসকে ঠেকাতে যথেষ্ট সক্ষম নাও হতে পারে। আমার অনুরোধ থাকবে, করোনাভাইরাস বায়ুবাহিত এটি নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা না করা। এই গবেষণাই চূড়ান্ত নয় এবং বায়ুবাহিত হলেও গত দেড় বছরে এটি পৃথিবীর এক শ’ ভাগের এক ভাগেরও অনেক কম মানুষকে মৃত্যুমুখে নিয়ে গেছে (যদিও একজন মানুষের জীবনও গুরত্বপূর্ণ), সুতরাং আমাদের সবকিছু আমূল পাল্টে ফেলতে হবে, এমন না। আপনার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে সুস্থ থাকার চেষ্টা করুন। আল্লাহ্ ভরসা। ১৮ এপ্রিল ২০২১ [email protected]
×