ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ওয়াজের নামে তান্ডবের উস্কানি

প্রকাশিত: ২২:৩৮, ১৯ এপ্রিল ২০২১

ওয়াজের নামে তান্ডবের উস্কানি

মোরসালিন মিজান ॥ নারী কেলেঙ্কারিতে নাককাটা গেলেও মামুনুল হক সবচেয়ে বেশি সমালোচিত ধর্মীয় উগ্রবাদী হিসেবে। হেফাজতে ইসলামের নেতা ওয়াজের নামে সুকৌশলে ধর্মবিদ্বেষ ছড়িয়ে গেছেন। সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়েছেন। পারিবারিক উত্তরাধিকার হিসেবেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালী সংস্কৃতির ঘোর বিরোধী। নিজের ভ্রান্ত অবস্থান থেকে যে কোন ছুতোয় তান্ডব চালানো, অগ্নিসংযোগ, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, মানুষের মুন্ডু কাটা, জ্যান্ত কবর দেয়া, চোখ উপড়ে ফেলাসহ ভয়ঙ্কর সব অপরাধ সংঘটিত করতে নিয়মিত উস্কানি দিয়ে গেছেন। ধূর্ত বর্ণচোরা মাওলানা হেলিকপ্টারে চড়ে নিয়মিত ওয়াজ করে বেড়ান। রবিবার তাকে গ্রেফতার করা হলেও তার ওয়াজের অসংখ্য ভিডিও ক্লিপ ইউটিউবে ফেসবুকে গিজগিজ করছে। সেখান থেকে শতাধিক ভিডিও দেখে, বিশ্লেষণ করে মামুনুলের উগ্রবাদ জঙ্গীবাদ প্রচারের প্রমাণ পাওয়া যায়। ভিডিও ক্লিপের বিশ্লেষণ বলছে, উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার চেঁচামেচি করে মাহফিল গরম করাই মামুনুলের ওয়াজের প্রধান বৈশিষ্ট্য। অতিরিক্ত জোর দিয়ে কথা বলায় বক্তার মুখের ভেতর থেকে থুথু এসে ঠোঁটে জমা হতে দেখা যায়। সেই থুথু হাতের তালুতে রাখা টিস্যু পেপারে নিয়মিত মুছতে মুছতে ওয়াজ করে যান তিনি। গরম এই বক্তাকে ঠান্ডা করার জন্য বিশালাকার ফ্যানের ব্যবস্থা রাখা হয়। এরপরও একজনকে ওয়াজের পুরো সময় পেছনে দাঁড়িয়ে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে দেখা যায়। এ অবস্থায়ও কিছুক্ষণ পরপর বক্তাটি গরমে ঘামেন, উত্তেজনায় কাঁপতে থাকেন। তার এ উত্তেজনা দ্বিগুণ তিনগুণ হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে অনুসারীদের মাঝে। বসা অবস্থা থেকে পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে ঘন ঘন দাঁড়িয়ে যেতে দেখা যায় মামুনুলকে। একইভাবে জঙ্গী স্লোগান দিয়ে হুজুরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন তার অনুসারীরা। এ সময় মাহফিলে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জলোচ্ছ্বাসে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, ঠিক তার আগের মুহূর্তটি দৃশ্যমান হয় মাহফিলে। ধারণা করা যায় এ উত্তেজনাই পরে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। যে কোন ছুতোয় তান্ডব চালায় মামুনুলের অনুসারীরা। এ কারণে যেখানে তিনি উপস্থিত হন সেখানকার মানুষ ভীষণ উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় কাটান। মামুনুলের নিজের বক্তব্যেও সাধারণ মানুষের সেই উদ্বেগ উৎকণ্ঠার কথা ওঠে এসেছে। এক ওয়াজে তাকে বলতে শোনা যায় ‘আমি কোথাও গেলে সেখানে সবাই উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষমাণ থাকেন, ভাবেন না জানি কি হবে।’ মামুনুল হকের ওয়াজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ধর্মের নামে চরম হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো, মনগড়া ফতোয়া দেয়া, মানুষ খুন, রক্তারক্তি, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি তার মূল টার্গেট। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালীত্বের বোধ, উদারনৈতিক সংস্কৃতিকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করেন। অন্যের অনুভূতি, অন্যের ধর্ম দেশ ও জাতিকে ছোট করা তার নিত্যদিনের কাজ। মামুনুলের ওয়াজে শান্তির ধর্ম ইসলামের আলোচনা খুব কমই চোখে পড়ে। জঙ্গী মতবাদ তুলে ধরতেই বেশি আগ্রহী তিনি। ধর্মের অপব্যাখ্যা করে আইন হাতে তুলে নেয়া এমনকি মানুষ খুনে অনুসারীদের সরাসরি উস্কানি দিতে দেখা যায় মামুনুলকে। যাকে তাকে ‘ইসলামের দুশমন’, ‘নাস্তিক’ ইদ্যাদি বলে তাদের হত্যায় প্ররোচণা দেন তিনি। এক ওয়াজে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘কটূক্তি করে কোন দুশমন কল্লা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে না।’ তার এ ঘোষণা এমন উত্তেজনা ছড়ায় যে, অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা উন্মাদের মতো আচরণ করতে থাকেন। স্লোগানে স্লোগানে কটূক্তিকারী খুঁজে বের করা ও নিজ হাতে শাস্তি প্রদানের যেন প্রতিজ্ঞা করেন তারা। ইতোমধ্যে ধর্মের নামে যেসব নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে সেসবে সমর্থনও দেন উগ্রবাদী নেতা। যুক্তি দিয়ে বলেন, ‘অপারগ’ হয়ে কেউ খুন করে ফেললে সেটা দোষের হবে না। যাকে তাকে অপবাদ দিয়ে ‘জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে’ ফেলারও ঘোষণা দেন তিনি। মামুনুলের বক্তব্যে চরম সাম্প্রদায়িক উস্কানি লক্ষ্য করা যায়। অন্যসব ধর্মকে অকারণে এবং অবলিলায় ছোট করেন তিনি। হেয় করেন। ওয়াজে অপরের ধর্মকে ‘অন্তঃসারশূন্য’, ‘ভেলকিবাজির ভাওতাবাজির ধর্ম’ বলে মন্তব্য করেন। গালপল্পের মতো করে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন হাজার হাজার খ্রীস্টান ভাওতাবাজির মিথ্যা ধর্ম ছেড়ে দিয়ে ইসলামের কালেমা পড়ে মুসলমান হচ্ছে।’ এমন মিথ্যা তথ্যে দারুণ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন অনুসারীরা। একইভাবে মামুনুল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার উস্কানি দেন। সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে ঘুরে ফিরেই আসে সুনামগঞ্জের শাল্লার ঘটনাটি। সেখানে ওয়াজ করে আসার পরপরই তার অনুসারীরা হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা চালায়। হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে নারী বিদ্বেষের অভিযাগ অনেক পুরনো। একই ইস্যুতে ওয়াজে চরম নোংরা ভাষায় নারীদের আক্রমণ করেন মামুনুল। কো-এডুকেশনের বিরোধিতা করতে গিয়ে ছাত্রীদের চরিত্র হনন করেন তিনি। বলার চেষ্টা করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সিট পেতে মেয়েরা ছাত্রনেতাদের কাছে যায়। আরও বিভিন্ন ইস্যুতে নারীকে নসিহত করেন এই কট্টর পুরুষ। ওয়াজের ভিডিও বলছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঙালীর নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ঘোর বিরোধী মামুনুল। ধর্ম ও সংস্কৃতিকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা করেন তিনি। দুটি চর্চার মধ্য থেকে একটিকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের চেষ্টা করেন। যারা গান করেন নাচেন কবিতা আবৃত্তি করেন তাদের ‘বাতিল’ বলে ফতোয়া দেন তিনি। বলেন, ‘বাতিলরা যদি একদিন গানের আয়োজন করে আপনারা ওয়াজ মাহফিল করবেন তিনটা।’ ওয়াজে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনেরও তীব্র সমালোচনা করতে দেখা যায় মামুনুলকে। বাঙালীর বর্ষবরণ উৎসবকে ‘পশ্চিমবঙ্গ থেকে অশ্লীলতা বেহায়াপনা আমদানি’ বলে মন্তব্য করেন। একইভাবে সঙ্গীত নৃত্যসহ সবধরনের শিল্পচর্চাকে ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেন। অভিযোগ রয়েছে, তার ভাস্কর্যবিরোধী উস্কানিতে কুষ্টিয়ায় এমনকি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুর করা হয়। নিজ দেশের পাশাপাশি ওয়াজে অন্য দেশ জাতি ও গোষ্ঠীর প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করেন মামুনুল হক। ফ্রান্সে নবীর অবমাননা করা হয়েছে এমন অভিযাগে দেশে চরম উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। ওয়াজে ফ্রান্সকে ‘অসভ্য’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। একইভাবে পশ্চিমাদের তিনি ‘অসভ্য সংস্কৃতির’ বলে প্রচার করেন। ফ্রান্সের দূতাবাস আক্রমণের প্রকাশ্য নির্দেশও আসে তার মুখ থেকে। একইভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগদানের বিরোধিতা করেন। মামুনুল হক ওয়াজে পুলিশ ও প্রশাসনকে নিয়মিত টার্গেট করে থাকেন। কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুরের ঘটনায় সারাদেশে ক্ষোভ দেখা দিলে জেলা পুলিশ বিশেষ তৎপর হয়ে ওঠে। এর অংশ হিসেবে সম্প্রতি সামনে আসে কুষ্টিয়ার এসপির একটি বক্তব্য। হেফাজতের নাম না নিলেও তাদের কর্মকান্ডের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় পুলিশ সুপারকে টার্গেট করেন মামুনুল হক। পুলিশ সুপারকে ‘ফাসেক’ ফতোয়া দিয়ে তার বিরুদ্ধে অনেকটা লেলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন কর্মীদের। ওয়াজে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধেও উস্কানি দেন মামুনুল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাম্প্রতিক তান্ডবের খবরে গোস্বা প্রকাশ করে তিনি সাংবাদিকদের তীব্র সমালোচনা করেন। গণমাধ্যম পরিহার করে ফেসবুক ইউটিউবে আস্থার কথা জানান তিনি। গণমাধ্যম তাদের মতো করে ‘সত্য’ না বললে পরিণতি ভাল হবে না বলেও হুঙ্কার দেন মামুনুল। এভাবে প্রায় প্রতিটি ওয়াজে চরম উগ্রবাদী এক মামুনুলকে পাওয়া যায়। সুকৌশলে এই উগ্রবাদ ছড়িয়ে দেশে তান্ডব ও বিশৃঙ্খলা চালান মামুনুল। নেপথ্যের মানুষটি যে তিনি, ওয়াজ শুনে সেটি বুঝতে আর বাকি থাকে না।
×