ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিহাব উদ্দিন

একটি শহীদ মিনারের গল্প

প্রকাশিত: ০০:২০, ১৮ এপ্রিল ২০২১

একটি শহীদ মিনারের গল্প

একুশ মানে একটি ভাষার আত্মকথা, একুশ মানে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ উপাখ্যান। হৃদয় রাজ্যের গভীরতম অঞ্চলে শক্তি যোগানো এক প্র¯্রবণের নাম অমর একুশ। ব্যাপক অর্থে বলা যায়, হৃদয়ের গভীরে আমরা যে ভালবাসা লালন করি, তারই অনন্ত প্রকাশ যেন একুশ। ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’। এখানে ওরা বলতে পাকিস্তানীরা। পাকিস্তানী শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে এদেশের দামাল ছেলেরা। বাংলাদেশের মানুষ তাদের এই আত্মত্যাগকে আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার উদ্দেশ্যে দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ বা মিনার। শহীদ মিনারের দিকে তাকালেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে বিখ্যাত সেই গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’ আমাদের জাতীয় জীবনে অগ্রযাত্রার এক অন্যতম প্রেরণার উৎস এই শহীদ মিনার। নির্মিত এ সকল মিনারের মধ্যে সর্বোচ্চ শহীদ মিনার স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ^বিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে খ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মনে ভালোবাসা ও আবেগে স্থান করে নেয়া জায়গাগুলোর মধ্যে শহীদ মিনার অন্যতম। শহীদ মিনারকে ঘিরে এখানে প্রতিদিন জমে উঠে হাজারো স্মৃতি ও ভালবাসার আবেগ জড়ানো গল্প। এই শহীদ মিনারকে ঘিরে রয়েছে একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পরপরই ১৯৭১ সালে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আলবেরুনী হলের সামনে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক ড. মফিজউদ্দিন আহমদের নির্দেশে নির্মাণ করা হয় ছোট একটি শহীদ মিনার। এই হলের সামনে এখনও রয়েছে পুরনো শহীদ মিনারটি। এর নাম ফলকে এখনও লেখা রয়েছে ‘১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগী বীর শহীদদের স্মৃতির স্মরণে জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়।’ কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে শহীদ মিনারটি স্থানান্তর করা হয়। তবে সেটিও খুব একটি বড় আকারে ছিল না। যার ফলে দীর্ঘদিন ধরে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একটি দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান ২০০৬ সালে শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ২০০৮ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হয়। পরে একই বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি দেশের সবচেয়ে উঁচু এ শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন। দেশের সর্বোচ্চ এ শহীদ মিনারটির স্থপতি বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিল্পী রবিউল হোসাইন। শহীদ মিনারের স্থাপত্যকর্মে চিত্রিত হয়েছে বাংলার ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি ও গৌরবগাথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সোজা পশ্চিমে এবং কলা ও মানবিক অনুষদের সামনে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই মিনারটি। এর চারপাশে তিনটি রাস্তা ত্রিভুজাকৃতির কাঠামো তৈরি করেছে যা এই সুউচ্চ মিনারকে আরও সৌন্দর্যম-িত করে তুলেছে। প্রাঙ্গণটি সবুজ ঘাসে ও বাহারি রঙের ফুলগাছে আচ্ছাদিত। চারপাশ ঘিরে বিস্তৃত সবুজ পটভূমিকায় টকটকে লাল রঙের এই শহীদ মিনার যেন আমাদের জাতীয় পতাকাকেই নির্দেশ করে। বলাবাহুল্য, অন্যান্য শহীদ মিনারের তুলনায় এই শহীদ মিনারের কাঠামো যেমন ভিন্ন তেমনি রয়েছে ভিন্ন তাৎপর্য। ১৯৫২ সালকে সকল অর্জনের ভিত্তি বিবেচনা করে এর ভিত্তিমঞ্চের ব্যাস রাখা হয়েছে ৫২ ফুট এবং ৭১ সালের অবিস্মরণীয় মর্যাদার প্রতি সম্মান জানিয়ে ভিত্তিমঞ্চ থেকে উন্মুক্ত আকাশগামী স্তম্ভত্রয়ের উচ্চতা রাখা হয়েছে ৭১ ফুট। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর বাঙালীর জাতীয় জীবনের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার নানা আন্দোলনে তাৎপর্যম-িত ৮টি বছর- ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের সংবিধানকে ঘিরে বাংলায় গণঅসন্তোষ, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধকে তুলে ধরার জন্য ধারাবাহিকতার প্রতীক হিসেবে ভিত্তিমঞ্চে ব্যবহার করা হয়েছে ৮টি সিঁড়ি। দৃঢ়তার প্রতীক ত্রিভুজাকৃতির ঋজু কাঠামোর মিনারের স্থাপত্বশৈলীতে বিধৃত হয়েছে সেইসব জাতীয় বীরদের বীরত্বগাথা যারা মায়ের ভাষা ও ভূমির জন্য লড়েছেন এবং জীবন দিয়েছেন। উর্ধগামী আকাশচুম্বী স্তম্ভ তিনটি এদেশের মানুষের ‘ভাষাপ্রেম, সংগ্রাম ও মুক্তি’ এই তিনটি ভিন্ন বিষয়কে নির্দেশ করে। অর্থাৎ এর একটি বাংলাভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, দ্বিতীয়টি মাটি-মানুষ, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, আন্দোলন-সংগ্রাম এবং তৃতীয়টি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক মুক্তি ও গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি এ শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা- কর্মচারী ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, সবুজে আচ্ছাদিত এই ক্যাম্পাস প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এক আরাধ্য স্থান। আর ক্যাম্পাসের ভেতরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আরাধ্য স্থান হিসেবে বিবেচিত হয় অনবদ্য এই শহীদ মিনার। তাছাড়া এটি শিক্ষার্থীদের কাছে গল্প, গান ও কবিতার অন্যতম একটি আড্ডাস্থল। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয় এই প্রাঙ্গণটি। ক্যাম্পাসের অধিকাংশ সাংস্কৃতিক কর্মকা-ও অনুষ্ঠিত হয় এখানে। শুধু তাই নয়, শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ন্যায্য আন্দোলনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এ শহীদ মিনারটি। শহীদ মিনারের পবিত্রতা রক্ষার ব্যাপারে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা সদা সচেতন। এছাড়াও পর্যটকদের সচেতন করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সাইনবোর্ড টানিয়ে রাখে এখানকার সামাজিক সংগঠনগুলো।
×