ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বাঙালী নারীর সরল প্রতিচ্ছবি, মায়ামুখ

প্রকাশিত: ২৩:৩২, ১৮ এপ্রিল ২০২১

বাঙালী নারীর সরল প্রতিচ্ছবি, মায়ামুখ

মোরসালিন মিজান ॥ বাঙালী নারীর মায়ামুখ, সরল প্রতিচ্ছবি বলতে যা বোঝায় সিনেমায় ঠিক তা-ই হয়ে উঠেছিলেন কবরী। গ্রামের অতি সাধারণ নারীর সুখ দুঃখ প্রেম বিরহের সূক্ষতিসূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে তিনি অসাধারণ অভিনয় দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন। এই ধারার অভিনয়ে একের পর এক সাফল্য বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়িকা হিসেবে তাকে প্রতিষ্ঠিত করে। পরবর্তী জীবনে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করলেও, সাদাকালো যুগের কিংবদন্তি নায়িকা হিসেবেই সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা কুড়িয়েছেন কবরী। ষাটের দশকে সিনেমায় অভিষেক হয় কবরীর। ১৯৬৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সুতরাং’ ছবিতে প্রথম দেখা যায় তাকে। এই দশকের আরও কত নায়িকা! সুলতানা জামান, সুচন্দা, কবরী, সুজাতা, শবনম, শাবানা, সুমিতা দেবী- সবাই দাপটের সঙ্গে অভিনয় করছিলেন। এ অবস্থায়ও স্বতন্ত্র এবং খুব শক্ত একটি জায়গা করে নিয়েছিলেন কবরী। তার অভিষেকের সময়টা এই অর্থে ভাল ছিল যে, তখন সিনেমা আর যাপিতজীবনের গল্পের মধ্যে বড় কোন ফারাক ছিল না। জীবন থেকেই অতি যত্নে গল্পের উপাদান খুঁজে নেয়া হতো। পরিবার ও সমাজ জীবনের নানা টানাপোড়েন, ঘাত প্রতিঘাত, মূল্যবোধের কথা রুপালি পর্দায় ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপন করা হতো। সমকালীন এসব চাওয়ার কথা মাথায় রেখেই কবরীকে নায়িকা হিসেবে নির্বাচন করা হয়। কবরী তার চোখে মুখে সাজে পোশাকে চলায় বলায় গ্রামীণ নারীর সারল্য বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরেন। ‘সুজন সখী’ বা ‘সারেং বৌ’র মতো ছবিগুলো আজও তার উদাহরণ হয়ে আছে। বিখ্যাত ‘সারেং বৌ’ ছবিতে গ্রামের আদর্শ সতী সাধ্বী প্রতিব্রতা স্ত্রীর ভূমিকায় পাওয়া যায় তাকে, চরিত্রটির কথা আজও ভুলতে পারেননি দর্শক। কবরী সবচেয়ে আলোচিত মিষ্টি মেয়ে হিসেবে। সরল একইসঙ্গে মিষ্টি একখানা মুখ ছিল তার। চোখ ছিল মায়াবী। সেই চোখ কাজল দিয়ে আঁকতেই প্রেমিক হৃদয়ে ঝড় উঠে যেত। আজকের দিনে যে গ্ল্যামারের পেছনে সবাই হন্যে হয়ে ছুটেন, সেই গ্ল্যামারের পুরোটাই ছিল কবরীর। তবে সবার আগে মায়ায় আদরে দর্শকদের বাঁধতে চাইতেন সে সময়ের পরিচালকেরা। সেভাবেই কবরীকে উপস্থাপন করা হয়েছিল। তাতেই অনবদ্য হয়ে ধরা দেন তিনি। সিনেমার পর্দায় ঘুরে ফিরেই অদ্ভুত লাজুক এক কবরীকে দেখেছেন দর্শক। গ্রামবাংলার নারীদের কথা আমরা জানি। কারণে তো বটেই, অকারণেও তারা লজ্জায় ডুবতেন। বলা হতো, লজ্জাই নারীর ভূষণ। তো সেই লজ্জা নিজের মধ্যে চমৎকারভাবে ধারণ করেছিলেন কবরী। সিনেমার পর্দায় বাংলার লজ্জাবতীদের নিজ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তার অস্ফুট কণ্ঠে বলা, ভীরু চোখে তাকানো পর্দায় আলাদা এক আবেদন সৃষ্টি করত। কবরী লাজ বোঝাতে লাজুক ভঙ্গি করতেন। প্রেম বোঝাতেও তা-ই। ‘রংবাজ’ সিনেমার সে গানটির কথাই যদি বলি, ‘সে যে কেন এলো না/কিছু ভাল লাগে না/এবার আসুক তারে আমি মজা দেখাবো...।’ ঠোঁট মেলানোর সঙ্গে সঙ্গে চোখের তারায় অঙ্গ সঞ্চালনে অদ্ভুত এক লজ্জা ধরে রাখেন কবরী। তার লজ্জা প্রেমানুভূতি মিলে মিশে একাকার হয়ে যেতে দেখি আমরা। কিন্তু এত লাজ কোথা থেকে পেয়েছিলেন তিনি? অনেকে আজও তা ভেবে পান না। তবে একটি কারণ এই ছিল যে, কবরী অনেক কম বয়সে অভিনয়ে আসেন। তখন তার বয়স মাত্র ১৩। ওই বয়সে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে যাওয়া, বড়দের সঙ্গে অভিনয় করা, সহজ কাজ তো নয়। এ কারণে এক ধরনের জড়তা তার মধ্যে ছিল। লজ্জা ছিল। অভিনেত্রী নিজেও তা স্বীকার করেছেন। তার ভাষায় : চোখ তুলে তাকাতে সাহস পেতাম না, খুব লজ্জা পেতাম। সব দত্ত দা শিখিয়েছেন। দত্ত দা, বলার অপেক্ষা রাখে না, সুভাষ দত্ত। খ্যাতিমান এই পরিচালক ও অভিনেতার হাত ধরেই সিনেমা জগতে আসা কবরীর। প্রথম ছবি ‘সুতরাং’-এ সুভাষ দত্তের বিপরীতেই অভিনয় করেন তিনি। সুভাষ দত্ত নিজেও জীবদ্দশায় বলে গেছেন, কিভাবে তিনি কবরীকে গড়ে নিয়েছিলেন। এর পরের দুই দশকে রংবাজ, নীল আকাশের নীচে, দ্বীপ নেভে নাই, তিতাস একটি নদীর নাম, সুজন সখী, সারেং বৌ- সব ছবিতেই দারুণ সফল তিনি। রোম্যান্টি নায়িকা হিসেবেও কবরীর জুড়ি ছিল না। বিশেষ করে রাজ্জাক-কবরী জুটি দর্শকের বিপুল প্রশংসা কুড়িয়েছিল। কবরীর মিষ্টি হাসিতে শুধু রাজ্জাক নন, হলভর্তি দর্শক আকৃষ্ট হতেন। নায়িকার কান্নাও একইভাবে দর্শকের চোখ ভিজিয়ে দিত। দর্শককে সঙ্গে নিয়ে এভাবে ক’জন পারেন সামনে এগিয়ে যেতে? কবরী পেরেছিলেন। মৃত্যুতেও তার সেই অর্জন ফিকে হওয়ার নয়। কোনদিন ফিকে হবে না।
×