ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

গার্ড অব অনার

বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন কবরী

প্রকাশিত: ২৩:২৫, ১৮ এপ্রিল ২০২১

বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন কবরী

গৌতম পাণ্ডে ॥ ‘দীপ নেভে নাই’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘সুজন সখী’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘সারেং বউ’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সহ অসংখ্য সিনেমায় পর্দা মাতানো কবরীর ভাষায়, ‘জীবন হচ্ছে একটি চলচ্চিত্র। জীবন কিন্তু স্থিরচিত্র নয়’। সেই জীবন-চলচ্চিত্রের বাঁকে বাঁকে নানা ঘটনার কথা তিনি নিজেই গ্রন্থিত করেছেন তার আত্মজৈবনিক রচনায় ‘স্মৃতিটুকু থাক’ শিরোনামের বইটিতে। ফুলের শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাজধানীর বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন কিংবদন্তি অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাবেক সংসদ সদস্য সারাহ বেগম কবরী। করোনাভাইরাসের ভায়াল থাবায় রাজধানীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার রাতে জীবন প্রদীপ নিভে গেল কবরীর। শনিবার দুপুর একটায় বনানী কবরস্থান প্রাঙ্গণে তাকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। জোহরের পর জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয় তাকে। এর আগে বেলা ১২টায় শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল থেকে কবরীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর গুলশানে তার নিজ বাসায়। সেখান থেকে মরদেহ দাফনের জন্য বনানী কবরস্থানে নেয়া হলে তাকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। শেষবারের মতো এ শিল্পীকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর ও সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল হকের তরফ থেকে এ শিল্পীকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। তাকে শ্রদ্ধা জানায় বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট। কবরীর নমুনা পরীক্ষায় করোনাভাইরাসের রিপোর্ট পজিটিভ আসে ৫ এপ্রিল। এরপর ওইদিন রাতেই তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ৮ এপ্রিল দুপুরে তাকে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের আইসিইউতে নেয়া হয়। ১৫ এপ্রিল নেয়া হয় লাইফ সাপোর্টে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার দিনগত রাত ১২টা ২০ মিনিটে না ফেরার দেশে চলে যান নন্দিত এই অভিনেত্রী। কবরীর মৃত্যুতে চলচ্চিত্রসহ সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। কবরীর মৃত্যুর একদিন আগে অসুস্থতার কথা শুনে তার সুস্থতা কামনা করেছিলেন আরেক কিংবদন্তি অভিনেত্রী শাবানা। যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে বসবাসরত শাবানা অভিনেতা মিশা সওদাগর থেকে কবরীর মৃত্যুর খবর শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। কান্নাভেজা কণ্ঠে কবরীকে জানিয়েছেন শ্রদ্ধা। কবরীর অকাল প্রয়াণে নায়ক আলমগীর বলেন, কবরী ম্যাডাম কত বড় মাপের একজন শিল্পী ছিলেন তা বলার যোগ্যতা আমি রাখিনা। কারণ আমি চলচ্চিত্রে আসার অনেক আগেই তিনি নায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। যদিও বা আমাদের বয়স একেবারেই কাছাকাছি। কিন্তু যেহেতু তিনি আমার আগেই সিনেমাতে এসেছিলেন, তাই তিনি আমার বড় বোনই ছিলেন। তার সঙ্গে অনেক স্মৃতি। সিনেমায় এমন প্রাণবন্ত শিল্পী খুব কমই পাওয়া যায়। কিছুদিন আগে আমার আপন ছোট বোনকে হারালাম। আর এখন হারালাম বড় বোনকে। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে বেহেশত নসিব করেন। কবরীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ববিতা বলেন, ভেবেছিলাম কবরী আপার মৃত্যুর খবরটা গুজব। কারণ আমার বিশ^াস ছিল আল্লাহ নিশ্চয়ই তাকে সুস্থ করে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু গভীর রাতে খবরটি পেয়ে আর ঘুমাতে পারিনি। কবরী আপার মৃত্যু নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে যে জীবন আসলে খুব ছোট। করোনায় যেভাবে আমরা একের পর এক প্রিয় মানুষদের হারাচ্ছি, তাতে কখন যে কে চলে যান তা কেউই বলতে পারেন না। যাই হোক, দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে বেহেশত নসিব করেন। নায়ক ফেরদৌস বলেন, ভীষণ মন খারাপ, কিছু কিছু সময় আসে যে সময় মন খারাপের বিষয়টা আসলে ভাষায় প্রকাশের নয়। এত কাছের একজন মানুষ ছিলেন কবরী আপা, যে তার এই চলে যাওয়াটা অবিশ^াস্যই মনে হচ্ছিল আমার কাছে। একটা অদ্ভুত বিশ^াস কাজ করেছিল যে তিনি হয়তো ফিরে আসবেন। কারণ তাকে কখনই অসুস্থ হতে দেখিনি আমি। তিনি সবসময় সুস্থ স্বাভাবিক একজন মানুষ। তার সঙ্গে আমার একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তার প্রথম নির্দেশিত সিনেমার নায়ক হতে পেরেছি, এটা আমার জন্য সত্যিই অনেক বড় সৌভাগ্য। সবচেয়ে বড় কষ্টের বিষয়, এমন মহান একজন মানুষ চলে গেলেন তাকে আমরা রাজসিকভাবে বিদায়ও জানাতে পারলামনা। এটা খুব কষ্টের, যন্ত্রণার। তার সেই মিষ্টি হাসি আজীবন আমাদের মধ্যে রয়ে যাবে, সত্যিই কবরী আপা আপনিই একমাত্র মিষ্টি মেয়ে। নায়িকা সোহানা সাবা বলেন, কত বড় সৌভাগ্যবান হলে আমি কবরী আপা নির্দেশিত প্রথম সিনেমাতে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তার সিনেমায় কাজ করার কারণে অনেকেই আমাকে তার মেয়ে মনে করতেন, এখনও করেন। আমার বাবা মা আমাকে জন্ম দিয়েছেন, সত্যি। কিন্তু সোহানা সাবাকে দর্শকের কাছে সোহানা সাবা হিসেবে জন্ম দিয়েছেন কবরী আপা। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন। গত শতকের ষাটের দশকে সেলুলয়েডের পর্দায় আবির্ভূত হয়ে ঢাকাই চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে হিসেবে দর্শক হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নেয়া কবরী পরের অর্ধশতকে দুই শতাধিক সিনেমায় আলো ছড়িয়েছেন। শীর্ষ পাঁচ ঢাকাই নায়কের অভিষেক ঘটেছে তার হাত ধরেই। ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে জন্ম নেয়া মিনা পালের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজারে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে নির্মাতা সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রে অভিষেকের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন কবরী। ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘ময়নামতি’, ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ’, ‘পরিচয়’, ‘অধিকার’, ‘বেঈমান’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘সোনালী আকাশ’, ‘অনির্বাণ’সহ অর্ধশতাধিক সিনেমায় অভিনয় করা এই শিল্পীকে পরে ‘আমাদের সন্তান’ চলচ্চিত্রে বয়স্ক বাবা-মায়ের ভূমিকাতেও দর্শক দেখেছে। ১৯৭৩ সালে ‘রংবাজ’ সিনেমায় দর্শক এক লাস্যময়ী কবরীকে আবিষ্কার করে। সেই চলচ্চিত্রের ‘সে যে কেন এল না, কিছু ভালো লাগে না’ গানটি এখনও বহু দর্শকের বুকে বাজে। তারুণ্যের সেই দিনগুলোতেই এল বাঙালীর ইতিহাস বদলে দেয়া একাত্তর। অভিনেত্রী কবরী কলকাতায় গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেখানে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেন। পরে দেশে ফিরে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন সিনেমায়। ২০১১ সালের নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে গণসংযোগ করেন তখনকার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সারাহ বেগম কবরী। সেলুলয়েডের সেই রঙিন জীবন শেষে কবরীর পরের জীবন-চলচ্চিত্রও কম বর্ণময় ছিল না। রাজনীতিতে নেমে জীবনের আরেক চলচ্চিত্রের মুখোমুখি তাকে হতে হয়েছিল বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে। এক সময় নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের বধূ কবরীকে ভোটের মাঠে সেই নারায়ণগঞ্জেই নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সব জয় করেই নবম সংসদে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হয়েছিলেন তিনি। ২০০৬ সালে মুক্তি পায় কবরীর পরিচালার প্রথম চলচ্চিত্র ‘আয়না’। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবেও যোগ দিয়েছিলেন। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে সরকারী অনুদানে ‘এই তুমি সেই তুমি’ নামে দ্বিতীয় চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন তিনি। সে কাজ আর তার শেষ করা হল না। ঢাবি উপাচার্যের শোক ॥ বরেণ্য অভিনেত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য সারাহ বেগম কবরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান। গতকাল শনিবার এক শোক বাণীতে উপাচার্য বলেন, সারাহ বেগম কবরী ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় অভিনেত্রী, পরিচালক ও প্রযোজক। অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন এই সফল অভিনেত্রী ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের একজন অন্যতম পথপ্রদর্শক ও প্রাজ্ঞজন। দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে তিনি অনন্য অবদান রেখেছেন। তিনি আরও বলেন, এই খ্যাতিমান অভিনেত্রী সাবেক সংসদ সদস্য হিসেবে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও অসাধারণ অবদান রেখেছেন। তার অসাধারণ অভিনয় ও মূল্যবোধ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের শিল্পীদের গভীরভাবে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করবে। চলচ্চিত্র শিল্পে অসামান্য অবদানের জন্য সবার প্রিয় এই অভিনেত্রী স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বলে উপাচার্য উল্লেখ করেন।
×