ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুজিবনগর দিবসেরও সুবর্ণজয়ন্তী

প্রকাশিত: ২৩:৩৬, ১৭ এপ্রিল ২০২১

মুজিবনগর দিবসেরও সুবর্ণজয়ন্তী

১৭ এপ্রিল। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে একটি ঐতিহাসিক ধাপ পেরিয়েছিল বাংলাদেশ। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বাঙালী জাতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা কেবলই নিপীড়িত হয়েছে। বাঙালীকে বঞ্চিত করা হয়েছে প্রতি পদে পদে। ১৯৭০-এ পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সরাসরি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু বাঙালীদের পাকিস্তানের শীর্ষ ক্ষমতায় যেতে দিতে পাঞ্জাবী শাসকরা রাজি ছিল না। আবার ষড়যন্ত্রের শুরু। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার জন্য ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং ২১ মার্চ জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা আসেন। তারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করেন। আরও আলোচনা হবে এই মর্মে বঙ্গবন্ধুকে জানানোও হয়েছিল। কিন্তু সেই আলোচনা আর হয়নি। হয়েছে কেবল কালক্ষেপণ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন তাঁর বাসভবনে অপেক্ষায় তখন জেনারেল ইয়াহিয়া ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়ন করার নির্দেশ দিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে রাত ১০টার আগেই করাচীর বিমানে উঠলেন। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুকে আলোচনায় ব্যস্ত রেখে ইয়াহিয়া-ভুট্টো তাদের জেনারেলদের দিয়ে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করেন। নানা সূত্র থেকে যতদূর জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১০টার আগে বঙ্গবন্ধু গোপন সূত্রে খবর পান পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিকে নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য সামরিক আক্রমণ শুরু করবে। এরপর তিনি টি এ্যান্ড টি/ ই পি আর-এর কাছে এর আগে পাঠানো স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করার নির্দেশ দেন। ঐতিহাসিক ছয় দফা বার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসমাবেশে দেয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘২৫ মার্চ রাত ১১টায় সমস্ত সহকর্মী, আওয়ামী লীগ নেতাদের হুকুম দিলাম, বের হয়ে যাও। যেখানে পার, এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর। খবরদার স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেও।’ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতা চলে যান। সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম। সেখানে গিয়ে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে অচিরেই দেখা করার ব্যাপারে মনস্থির করেন। কিন্তু একজন সরকারপ্রধান হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে তাজউদ্দীনকে ব্যক্তিগত সাক্ষাত দেয়ার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল না। এরই মধ্যে ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ ভারতীয় পার্লামেন্টে গৃহীত এক প্রস্তাবে পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনসাধারণের ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান সফল হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়। ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল লন্ডন থেকে প্রকাশিত দ্য টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, মিসেস গান্ধী নিজে এই প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি ভারতীয় জনগণের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে এবং তারা সর্বপ্রকারে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত। ৩ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগালেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে জানালেন, ২৫-২৬ মার্চেই শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপ্রধান করে একটি সরকার গঠিত হয়েছে এবং আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের সবাই এই মন্ত্রিসভায় আছেন এবং তাজউদ্দীন আহমদ নিজে এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী বলে উল্লেখ করেন। তাজউদ্দীন আহমদের এই উপস্থিত ও বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনন্যসাধারণ ভূমিকা রেখেছিল। কারণ এতে কাজ হয়েছিল এবং এ বৈঠকের পর পরই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের সাহায্য ও সহযোগিতা দ্রুতগতিতে প্রসার লাভ করেছিল। অন্যদিকে ১০ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এক অধ্যাদেশ জারি করে আইনগত দিক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি দলিল প্রকাশ করে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র হিসেবে পরিচিত। ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাজউদ্দীন আহমদ একটি বেতার ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি দেশব্যাপী পরিচালিত প্রতিরোধ যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। একই দিন তিনি আগরতলায় মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত করেন। ১৭ এপ্রিল ‘মুজিবনগরে’ নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের এই শপথ অনুষ্ঠান ছিল এক অনন্যসাধারণ ঘটনা। শপথ অনুষ্ঠানের বিবরণ দিয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায়। তার পূর্ব-পশ্চিম গ্রন্থের ৮৫ থেকে ৮৭ পৃষ্ঠায় সেদিনের বিবরণ আছে এভাবে, ‘...গাড়িগুলো শেষ পর্যন্ত এসে থামল একটি বিশাল আমবাগানের মধ্যে। এই গ্রামটির নাম বৈদ্যনাথতলা, জেলা কুষ্টিয়া, মহকুমা মেহেরপুর। কিছু লোক সেখানে দৌড়াদৌড়ি করে চেয়ার সাজাচ্ছে, অধিকাংশই হাতল-ভাঙা চেয়ার, কাছাকাছি গ্রামের বাড়িগুলো থেকে জোগাড় করে আনা হয়। জায়গাটিকে ঘিরে রাইফেল-এলএমজি হাতে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশ-পঁচিশজন সৈন্য, তাদের ঠিক মুক্তিবাহিনীর ছেলে বলে মনে হয় না, খুব সম্ভবত প্রাক্তন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলের একটি বিদ্রোহী-বাহিনী। আশপাশের গ্রাম থেকে ধেয়ে এসেছে বিপুল জনতা। অস্ত্রধারী সেনাদের বৃত্ত ভেদ করে তারা হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়তে পারছে, না বলে অনেকেই আমগাছগুলোতে চড়তে শুরু করেছে। অনুষ্ঠান শুরু হলো এগারোটার পর। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ সবাই এসে গেছেন। তবে যার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় ছিল তিনি নেই, তিনি আসবেন না। শেখ মুজিব যে কোথায় আছেন তা এখনও জানা যায়নি। তবু অনুপস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হলো রাষ্ট্রপতি হিসেবে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। মন্ত্রিসভার অন্য তিনজন সদস্য হলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ, এইচএম কামারুজ্জামান এবং এম মনসুর আলী। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চীফ নিযুক্ত হলেন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ওসমানী। এর সাতদিন আগেই কলকাতার থিয়েটার রোডের অস্থায়ী ‘মুজিবনগর’ সরকার থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করা হয়েছিল। আজ ১৭ এপ্রিল (১৯৭১) বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। ঐতিহাসিক দলিলটি পাঠ করলেন চীফ হুইপ ইউসুফ আলী।’ ইতিহাসের দায় শোধ হয়েছিল মুজিবনগর সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে। সব ধর্মের, সব বর্ণের মানুষের সম্প্রীতির বন্ধনে যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন, এই দিনে তা সত্যিকার অর্থে বাস্তবে রূপ নিল সরকার গঠনের মাধ্যমে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ ধাপটি সেদিন অর্জিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নির্দেশিত পথেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়, এই সত্য অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। বার বার বলতে হবে- এই স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে কাজ করেছে দীর্ঘ আন্দোলন ও ত্যাগ। প্রতিটি আন্দোলনের সম্মিলিত সুফলই হলো স্বাধীনতা। ১৯৪৮ সাল থেকে ধাপে ধাপে এগিয়ে গেছে স্বাধীনতা আন্দোলন। তারই চূড়ান্ত পরিণতি ১৯৭১ সালে। বিশ্ব মানচিত্রে যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল একটি ঐতিহাসিক ধাপ পেরিয়েছিল বাংলাদেশ। সেদিনই শপথ নিয়েছিল বিপ্লবী সরকার। আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সঙ্গে মুজিবনগর দিবসেরও সুবর্ণজয়ন্তী। একাত্তরের বীরদের জানাই সশ্রদ্ধ অভিবাদন। লেখক : সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকারকর্মী, লেখক ও সাংবাদিক [email protected]
×