ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যে কোন সময় বিপর্যয়ের আশঙ্কা পোশাকের দাম কমে যাওয়ায় লোকসান বেড়েছে

সঙ্কট বাড়ছে গার্মেন্টসে ॥ করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা

প্রকাশিত: ২২:২৫, ১৭ এপ্রিল ২০২১

সঙ্কট বাড়ছে গার্মেন্টসে ॥ করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা

রহিম শেখ ॥ করোনার প্রথম ঢেউ কাটিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত ভালভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এবার দ্বিতীয় ধাপে দেশে রেকর্ড মাত্রায় করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় আবারও শঙ্কা বাড়ছে তৈরি পোশাক শিল্পে। ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন করে লকডাউনে আবারও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন রফতানিকারকরা। তারা বলছেন, এখনও বড় মাত্রায় পোশাক ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়নি। তবে যে কোন সময় পরিস্থিতি বদলে যাওয়ার আশঙ্কায় আছেন তারা। জানা গেছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বৈশ্বিক পোশাক আমদানি ২৩ শতাংশ কমে যায়। করোনায় দেশে দেশে লকডাউনের কারণে মানুষ পোশাক কেনা কমিয়ে দেয়। ফলে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে জমে পোশাকের স্তূপ। এতে অনেক ব্র্যান্ড কারখানা আগের কার্যাদেশ বাতিল করে, অনেকে দামও কমিয়ে দেয়। তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ করোনায় পোশাক খাতে একটি ক্ষতির হিসাব করেছে। তারা বলছেন, গত বছর করোনা শুরুর পর মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ৩.৮১ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার স্থগিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত স্থগিত হওয়া অর্ডারের শতকরা ৯০ ভাগ ফিরে আসে। ৫০ মিলিয়ন ডলারের অর্ডার শেষ পর্যন্ত আর ফিরে আসেনি। এর পর গত কয়েক মাসে পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি অনেকাংশেই কমে যায়। কেভিড-১৯সহ বিভিন্ন কারণে প্রতি মাসেই কমছে পোশাক রফতানি। মাসে এখন গড়ে ৩ বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়। এ হারে এগোলে অর্থবছরের বাকি চার মাসে আরও এক হাজার ২০০ কোটি ডলার যুক্ত হতে পারে। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরেও পোশাক খাতের মোট রফতানি দাঁড়াতে পারে তিন হাজার ৩০০ কোটি ডলার। মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে এখনও বড় ধরনের অর্ডার স্থগিত হয়নি। তবে অর্ডার ও পোশাকের দাম কমেছে। গত অক্টোবর, নবেম্বর ও ডিসেম্বরে গড়ে দাম কমেছে শতকরা পাঁচ ভাগ। জানুয়ারি থেকে মার্চ সময়ে পোশাকের দাম কমেছে ৪ শতাংশের মতো। যা এখন পর্যন্ত খুব একটা উন্নতি হয়নি দামে। যদিও পোশাক রফতানি করে লাভ হয় গড়ে শতকরা দুই-তিন ভাগ। ফলে লাভ কমে গেছে বা লোকসান বেড়েছে বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ। জানা যায়, বর্তমানে বিশ্বের বেশ কিছু দেশে আবারও লকডাউন দেয়ায় সেখানকার খুচরা ক্রেতারা পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। তাই বায়াররাও সতর্ক। তারা আগে যদি একসঙ্গে এক লাখ পিস অর্ডার করতেন এখন পাঁচবারে অর্ডার করছেন। এখানে কারখানাগুলো সাধারণত তিন মাস আগে অর্ডার পেত। কিন্তু এখন সেই লিড টাইম পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে কারখানাগুলোকে সক্ষমতার চেয়ে কম উৎপাদন করতে হচ্ছে। এ বিষয়ে ফতুল্লা এ্যাপারেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফজলে শামীম এহসান বলেন, দ্বিতীয় ধাক্কায় আমরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আমাদের অর্ডার কমে গেছে। করোনার প্রথম ধাক্কায় কিছু অর্ডার স্থগিত হয়েছিল, কিন্তু পরে ক্রেতারা সেগুলো পুনরায় দেয়। কিন্তু সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেছে। গার্মেন্টস এমন একটা ব্যাপার, ফ্লোরে যদি কমপক্ষে ৯০ শতাংশ অর্ডার না থাকে, তাহলে লোকসানে চলতে হয়। আমাদের ফ্যাক্টরিগুলো সেপ্টেম্বরের শেষ থেকেই লসে চলছে। সম্প্রতি ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল এ্যান্ড এ্যাপারেলের (অটেক্সা) হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে গত বছর করোনার সংক্রমণ ছিল অন্য যে কোন দেশের চেয়ে বেশি। সে কারণে ২০২০ সালে দেশটিতে তৈরি পোশাক আমদানি এক-চতুর্থাংশ কমে যায়। তবে করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে আবারও দেশটিতে পোশাক রফতানি বাড়ছে। সেই সুফল বাংলাদেশও পেয়েছে। তবে নতুন করে সংক্রমণ বাড়ায় দেশটিতে পোশাক রফতানি নিয়ে আবারও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান গত বছর ৬ হাজার ৪০৭ কোটি ডলারের পোশাক আমদানি করে। ২০১৯ সালের চেয়ে এই আমদানি ২৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ কম। তবে চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে বিভিন্ন দেশ থেকে ১ হাজার ৯১ কোটি ডলারের পোশাক আমদানি করেছে দেশটির ব্যবসায়ীরা, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ কম। অটেক্সার তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ১০০ কোটি ডলার বা সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার পোশাক রফতানি করেছে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ কম। এই বাজারে চীন ও ভিয়েতনামের পর বাংলাদেশ তৃতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রফতানিকারক দেশ। গত বছর একপর্যায়ে চীনকে ছাড়িয়ে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শীর্ষ পোশাক রফতানিকারক হলেও পরিস্থিতি আবার বদলেছে। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে চীন ২৪৫ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ দশমিক ২২ শতাংশ কম। অন্যদিকে ভিয়েতনাম গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ২০৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করেছে। গত বছরের প্রথম দুই মাসে দেশটি ২৩৪ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছিল। সেই হিসাবে চলতি বছর তাদের রফতানি কমেছে ১২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। শীর্ষ তিন রফতানিকারক দেশের মতোই ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার পোশাক রফতানিও কমেছে। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ভারত ৫৯ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করলেও গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২১ দশমিক ৮৯ শতাংশ কম। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চতুর্থ সর্বোচ্চ পোশাক রফতানিকারক দেশ। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়া রফতানি করেছে ৫৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক। তাদের রফতানি কমে গেছে ২৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া এখনও শ্লথ। দেশটির ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান সব ধরনের পোশাক নিলেও পরিমাণে কম। বিপুলসংখ্যক মানুষ টিকা নিলেও দেশটিতে নতুন করে আবার সংক্রমণ বাড়ছে। আসলে করোনার নিত্যনতুন ধরনের কারণে পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। ফজলুল হক আরও বলেন, করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে ব্যবসায় ঘুরে দাঁড়াতে আরও বেশি সময় লাগবে। কারণ, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো ছয়/সাত মাস পরের অবস্থা কী হবে, সেই পূর্বাভাস দেখে সিদ্ধান্ত নেয়। তাই দ্রুত করোনা পরিস্থিতি উন্নতি না হলে তৈরি পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যদিও ক্রেতারা সে ধরনের কোন বার্তা এখনও দেয়নি।
×