ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার দাবি

প্রকাশিত: ২১:২২, ১৭ এপ্রিল ২০২১

হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার দাবি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত এক ওয়েবিনারে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও সন্ত্রাসের অপরাধে মামুনুল-বাবুনগরীসহ হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়। শুক্রবার বিকেলে ‘জামায়াত-হেফাজত চক্রের বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা : সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়’ শীর্ষক এই আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি। নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওয়েবিনারে আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু, কথাশিল্পী অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সমাজকর্মী রাশেক রহমান, ব্লগার এ্যান্ড অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের সভাপতি ড. কানিজ আকলিমা সুলতানা, ওয়ান বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক রাশেদুল হাসান, টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফোরাম ফর হিউম্যানিজম তুরস্কের সাধারণ সম্পাদক লেখক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা শাকিল রেজা ইফতি, গৌরব ’৭১-এর সাধারণ সম্পাদক এম শাহীন, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন ও নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল। সভাপতির বক্তব্যে শাহরিয়ার কবির জামায়াতে ইসলামীর পাশাপাশি হেফাজতে ইসলামের মৌলবাদী সন্ত্রাসী রাজনীতি অবিলম্বে নিষিদ্ধকরণের দাবি পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিনাশী সন্ত্রাসী উত্থানের পর থেকে আমরা ক্রমাগত বলছি জামায়াত ও হেফাজতকে পৃথক দল কিংবা পরস্পরবিরোধী মনে করার কোন কারণ নেই। হেফাজতের ১৩ দফা জামায়াতেরই পুরনো দাবি। মুক্তিযুদ্ধকালে হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতারা নেজামে ইসলামের নেতৃত্বে ছিলেন, যে দল এবং তাদের ঘাতক বাহিনী জামায়াতের চেয়ে কম নৃশংস ছিল না। ’৭১-এ যে ভাষায় তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতার করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী বাঙালীদের ‘কাফের’, ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘ভারতের এজেন্ট’, ‘ইসলাম ও পাকিস্তানের দুষমন’ আখ্যা দিয়ে পাকিস্তানের অখন্ডতার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিল, এখন তাদের রাজনৈতিক ও আদর্শিক উত্তরসূরিরা আরও ভয়ঙ্কর ভাষায় ভিন্নমত ও ভিন্ন ধর্মের মানুষের ওপর হামলাসহ এবং যাবতীয় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। প্রশাসন মাঠপর্যায়ের হেফাজত কর্মীদের গ্রেফতার করলেও মামুনুল, বাবুনগরীর মতো মৌলবাদী সন্ত্রাসের গডফাদারদের এখন পর্যন্ত কেন গ্রেফতার করছে না এটা আমাদের বোধগম্যের বাইরে। হেফাজতের মতো জঙ্গী সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে যে কোন ধরনের সমঝোতা শুধু ক্ষমতাসীন দলের জন্য আত্মঘাতী হবে না- অন্তিমে বাংলাদেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে, যা বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত চক্রের মূল উদ্দেশ্য। বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তারা দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকা ও পশ্চিমের হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে যে কোন ধরনের নমনীয়তা, কালক্ষেপণ কিংবা দ্বিধা দেশ ও জাতির জন্য সমূহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। শাহরিয়ার কবির হেফাজত-জামায়াতের মৌলবাদী সন্ত্রাস তদন্তে নির্মূল কমিটি এবং জাতীয় সংসদের আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক ককাসের যৌথ উদ্যোগে সদ্য গঠিত গণতদন্ত কমিশনের মাঠপর্যায়ে তথ্য অনুসন্ধানে প্রশাসন এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সহযোগিতা কামনা করে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মদান অর্থবহ করতে হলে এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ গড়তে হলে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দ্বিতীয় কোন বিকল্প নেই।’ প্রধান অতিথির বক্তব্যে আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, হেফাজতে ইসলাম জামায়াতের মতো একই ধারায় ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে চায়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে হেফাজতের তান্ডব ও কর্মকান্ডে সেটা পরিষ্কার হয়েছে। স্বাধীনতা মানে না বলেই তারা সুবর্ণজয়ন্তী বানচাল করার চেষ্টা করেছে। তাদের উদ্দেশ- মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে বাংলাদেশ থেকে ক্ষমতাচ্যুত করা ও বাংলাদেশকে পাকিস্তানে পরিণত করা। যারা জাতীয় সঙ্গীত মানে না, জাতির পিতাকে মানে না, সংবিধান মানে না- তাদের ছাড় দেয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবারের আগে আরও দুবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন হেফাজতকে কোথাও দেখা যায়নি। এবার তারা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বানচাল করার জন্যই মোদির বিরোধিতার কথা বলে সারাদেশে তান্ডব চালিয়েছে। বিলম্বে হলেও সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। তারা যেন ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত করতে না পারে সে ব্যবস্থাই সরকার করবে বলে আমি আশা করি। রাশেদ খান মেনন বলেন, ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের তান্ডবে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট। হেফাজতের বর্তমান আমির বাবুনগরী জামায়াতের প্রতিনিধি। কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতির পরও মাদ্রাসাগুলোতে সরকারের ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। হেফাজতের নেতৃবৃন্দের বড় অংশ একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকান্ডে অংশ নিয়েছিল। হেফাজতের বর্তমান কমিটির অধিকাংশ জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী রাজনীতিতে যুক্ত। মোদিবিরোধী বিক্ষোভ ছিল মূলত বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী নস্যাৎ করার চক্রান্ত। তাদের লক্ষ্য বাংলাদেশে তালেবানি অভ্যুত্থান ঘটানো। বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে জ্ঞাত নয়। বিএনপি তাদের মৌন সমর্থন দিয়েছে। তান্ডবের সঙ্গে যুক্ত হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের এখনও গ্রেফতার করা হয়নি। ভবিষ্যতে তারা সকল ইসলামিক দলগুলোকে এক জায়গায় এনে সরকারবিরোধী আন্দোলনের চেষ্টা করছে এবং বাংলাদেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে। এসব বিষয়ে এখনই যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বনাশের বিষয় হচ্ছে- আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা হেফাজতের তা-ব ও রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দলগুলোর ভেতর হেফাজতের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতি সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা তৈরি করতে হবে এবং বিভ্রান্তি দূর করতে হবে। হাসানুল হক ইনু বলেন, হেফাজত ও জামায়াত ধর্মের লেবাসধারী পাকিপন্থার নব্য রাজাকারচক্রের সংগঠন। তারা ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দেয় ও তারা দ্বৈতনীতি অবলম্বন করে। তারা প্রকাশ্যে বিবৃতি দেয় এবং গোপনে সশস্ত্র কার্যক্রম পরিচালনা করে। এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, দেশবিরোধী- কখনও প্রকাশ্যে, কখনও সশস্ত্রভাবে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করছে। রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং সন্ত্রাসের দায়ে বাবুনগরী, মামুনুলসহ সকল নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার ও বিচার করতে হবে। সকল মাদ্রাসাকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। সকল মসজিদে রাজনৈতিক বক্তব্য নিষিদ্ধ করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকীকরণ দূর করতে হবে। সরকারের প্রতি আবেদন জামায়াত-হেফাজত-বিএনপিকে আলাদা করার রাজনীতি বাদ দিয়ে এদেরকে এক ব্রাকেট করে তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ও বাঙালী সংস্কৃতিবিরোধী রাজনীতিকে ধ্বংস করে দিতে হবে। সাপের শেষ রাখতে নেই এবং বেইমানকে ক্ষমা করতে নেই। মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, হেফাজত যদি রাজনৈতিক দল হয়ে থাকে, তাহলে মাদ্রাসায় বাচ্চাদের ভর্তি করে আমরা কেন তাদের সদস্য তৈরি করে দিচ্ছি? মাদ্রাসাগুলো থেকে আমরা দক্ষ জনশক্তি পাচ্ছি না। দরিদ্রতার কারণে বাবা মা তাদের কোমলমতি শিশুদের মাদ্রাসায় পাঠায়। আমরা দরিদ্র মা-বাবাদের সন্তানের জন্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান-হোস্টেল এগুলো তৈরি করছি না। এ বিষয়গুলো আমাদের ভবিষ্যত কর্মপন্থায় রাখতে হবে। বাউলদেরকে আমরা মূল্যায়ন না করে হেফাজতকে মূল্যায়ন করি। বাংলাদেশের বাউলদের সম্প্রীতির গান ও তাদের আদর্শ জনগণের নিকট প্রচার করতে হবে। হেফাজতে ইসলাম এদেশের ভাল ও শক্তিশালী সবকিছুরই বিরোধিতা করে। পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ রোধ করতে আমরা যেসব সুপারিশ করেছিলাম সেগুলোর অধিকাংশই সরকার গ্রহণ করেনি। এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’
×