ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ পবিত্র রমজানের শুভাগমনে আমাদের দায়িত্ব

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ১৬ এপ্রিল ২০২১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ পবিত্র রমজানের শুভাগমনে আমাদের দায়িত্ব

আমরা আল্লাহ তায়ালার অপার রহমতে দু’দিন আগ থেকে পবিত্র মাহে রমজানুল মোবারকের সিয়াম সাধনা শুরু করেছি। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বিশ^ কঠিন বিপর্যয় মোকাবেলা করছে। আমাদের দেশেও সাধারণ জনগণ করোনার থাবায় দিশেহারা। এরপরও রহমত মাগফিরাত ও নাজাতের মাসকে মুমিন মুসলমানরা স্বাগত জানিয়েছে। তাই আজ ঘরে ঘরে সিয়াম সাধনা, তিলাওয়াত তারাবীহ ও তাসবি তাহলিলে মত্ত, সাহরী ও ইফতারে সমাদর। মুসলমানরা মাহে রমজানকে নিজের জীবন নিষ্পাপ, পুণ্যময় করার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। তাই দেখা যায়, রমজানের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার বিভিন্ন আয়োজন, এ মাসের মাহাত্ম্য, ফজিলত ও বরকত অর্জনের জন্য নানা আমল ও কর্মসূচী। ইতিহাসে আমরা দেখি সোনালি যুগের মুসলমানরা এ মাসকে যথাযথ ভাবগম্ভীর পরিবেশে অতিবাহিত করার জন্য রজব মাস থেকে প্রস্তুতি নিতেন এবং তারা রজব থেকে মাহে রমজান পর্যন্ত পুণ্য অর্জনের যে অবারিত ধারা প্রবাহিত হয় তা পাওয়ার জন্য খোদা তায়ালার কাছে ফরিয়াদ করতেন। খোদ আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) দুআ মুনাজাতে বলতেন: আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রাজাবা ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগানা রামাদান।’ - হে আল্লাহ, পরওয়ার দিগার! আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দান কর আর মহাপবিত্র মাহে রমজানে পৌঁছার তাওফিক দাও।’ রমজানুল মোবারক উপলক্ষে কুরআন ও হাদিসে যে সব বাণী এসেছে তা সত্যিই একজন মুমিনকে সৎপথে জীবন রচনার এক দুর্দমনীয় প্রতিযোগিতায় উদ্বেলিত করে তোলে। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তাঁর পবিত্র আখেরী কালাম কুরআন মাজিদে ইরশাদ করেছেন : ‘রমযান মাস হলো সেই মাস- যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন, যা মানুষের জন্য হিদায়াত এবং সত্য পথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসে রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্যদিনে গণনা পূর্ণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না- যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হিদায়াত দান করার দরুন আল্লাহ তায়ালার মাহাত্ম্য বর্ণনা কর, (আর) যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।’ এর পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে : ‘আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে; বস্তুত আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে তাদের প্রার্থনা কবুল করে নিয়ে থাকি, যখন (তারা) আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করা তাদের একান্ত কর্তব্য, যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে।’ - (সূরা বাকারা: ১৮৫,১৮৬)। উপরোক্ত আয়াত দু’টোর প্রথমটিতে রমজান মাসকে অন্য এগারোটি মাস থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যে তুলে ধরা হয়েছে এবং এ মাসকে কুরআনের মাস হিসেবে আখ্যায়িত করে এর মধ্যে সুনির্দিষ্ট করণীয় বিবৃত হয়েছে। এ মাসকে প্রকৃত হিদায়াত ও পথপ্রাপ্তির মোক্ষম মৌসুম বলেও এখানে ইশারা করা হয়েছে। দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তায়ালার দরবারে আলীশানে ইবাদত বন্দেগী ও প্রার্থনার গুরুত্ব এবং এসব ব্যাপারে খুলুসিয়াত বা আন্তরিক বিশ্বাসের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। আয়াতের মর্মার্থ দ্বারা বুঝা যায়, রমজান মুসলিম জিন্দেগীতে একটি ট্রেনিং পিরিয়ড এবং এ থেকে ফায়দামন্দ হওয়ার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিবেশ। শুরুর দিকে আমাদের প্রত্যাশা, মাহে রমজান হোক মুমিন মুত্তাকীগণের দীনতা, হীনতা দূরীকরণের সাক্ষী, রমজান হোক সকলের আত্মোপলব্ধির - আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল সিয়ামানা, ওয়া কিয়ামানা, ওয়া রুকুআনা ওয়া সুজুদানা, ওয়া তিলাওয়াতানা, ওয়া তাসাবিহানা কামা তাকাব্বালতা মিন ইবাদিকাস সালিহীন- ‘আল্লাহ দয়া করে আমাদের রোযা, আমাদের নামাজ, কালাম, আমাদের রুকু, সিজদা আমাদের তিলাওয়াত, তাসবীহ পূর্ববর্তী পুণ্যাত্মা মহান সৎকর্ম পরায়নশীলদের ন্যায় কবুল কর।’ হাদিস শরীফে বারবার এ মাসকে প্রথম থেকেই অনুধাবন ও সদ্ব্যবহার করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হযরত সালমান ফারেসী (রাদিঃ) একটি দীর্ঘ হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, একদিনকার ঘটনা। হযরত (স.) শাবান মাসের শেষ তারিখ আমাদের উদ্দেশে এক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। এতে তিনি ইরশাদ করেছেন : হে লোক সকল! একটি মহান ও বরকতময় মাস তোমাদের সামনে উপস্থিত। এ মাসের রাতগুলোর মধ্যে এমন এক রাত বিদ্যমান যার মর্যাদা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ মাসের রোজাকে ফরজ করেছেন এবং এ মাসের রাত্রিজাগরণকে করেছেন অতিরিক্ত ইবাদতে শামিল। তিনি আরও বলেন, যে ব্যক্তি এ মাসে একটি সাধারণ ভাল কাজ করবে অন্য মাসের তুলনায় তাকে একটি ফরজ ইবাদতের সাওয়াব প্রদান করা হবে। যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ ইবাদত পালন করবে তাকে সত্তরটি ফরজ ইবাদতের সমপরিমাণ সাওয়াব প্রদান করা হবে। এ মোবারক মাস ধৈর্য ও সংযমের। ধৈর্যের বিনিময় অবশ্যই জান্নাত। এ মাস পরোপকারের। এ মাসে বিশেষভাবে মু’মিন বান্দাদের রিজিক বৃদ্ধি করা হয়। কেউ যদি একজন রোজাদারের ইফতারের ব্যবস্থা করে আল্লাহ তায়ালা তার পাপরাশি ক্ষমা করে দেন, তাকে দোজখ থেকে মুক্তি দেন এবং (রোজাদারের) রোজার সমান তাকে পুণ্য দান করেন। এ সময় সাহাবাগণ জানতে চাইলেন : হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের অনেকেই একজন রোজাদারকে ইফতারের ব্যবস্থা গ্রহণের মতো সক্ষম নই। হযরত জানালেন: এর জন্য বিশেষ কোন আয়োজনের প্রয়োজন নেই। সামান্য দুধ, একটি খেঁজুর কিংবা অপারগতায় পানি দিয়ে ইফতারের ব্যবস্থা করালেও পরওয়ার দিগারে আলম উল্লিখিত পুণ্য দান করবেন। আর যে ব্যক্তি রোজাদারকে পেটভরে তৃপ্তি সহকারে খাবারের ব্যবস্থা করবে আল্লাহ তাকে পবিত্র হাউজে কাউসারের পানি পান করাবেন যার পরে বেহেস্তে প্রবেশ পর্যন্ত তার কোন পানির পিপাসা হবে না। এ মহান পবিত্র মাস তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথমাংশে আল্লাহর বিশেষ রহমত অবতীর্ণ হয়। দ্বিতীয়াংশ ক্ষমা ও মার্জনার এবং শেষ অংশ দোজখ থেকে মুক্তিদানের। যে ব্যক্তি এ মাসে তার কর্মচারীর কাজের বোঝা কমিয়ে দেয় আল্লাহ তার গুনাহর বোঝা কমিয়ে দেন এবং দো’জখের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করেন। বর্ণিত হাদিসটির মাধ্যমে আমরা দেখি, পবিত্র রমজান মাস আত্মগঠনের, সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার, পরস্পর সহানুভূতি ও সহমর্মিতার। এ মাস আধ্যাত্ম্য সাধনা ও কৃচ্ছতা হাসিলের। এ মাস রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের। এর হুকুম আহকামগুলোও সে একই উদ্দেশ্য, লক্ষ্যকে সামনে রেখে তৈরি। যেমন : ইফতার, সাহরী, তারাবীহ, খতমে কুরআন, যাকাত, ফিতরা, ঈদ-উল-ফিতর প্রভৃতি। আমাদের পদে পদে খেয়াল রাখতে হবে, এসব আহকামের দুনিয়াবী, সামাজিক ও ব্যক্তি গঠনের যে দর্শন আর ফায়দা আছে তা আমাদের জীবনে প্রতিফলিত হচ্ছে কিনা। কিন্তু রমজানের এসব ব্যাপক উপকারিতা ও উপলব্ধি থেকে বঞ্চিত হবার কিছু সঙ্গত কারণ আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না। কতিপয় ব্যবসায়ী বণিকের হাতের কারসাজিতে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে হু হু করে, যত্রতত্র ছেয়ে যায় দুই নম্বরী মালামালে। ফলে শুধু রোজাদার নয়, অন্যান্য অধিবাসীদেরও এ মৌসুমে নাভিশ্বাস ওঠে। আমরা যদি কুরআনের মাসের ওয়াসিলায় আল্লাহর রহমত চাই, তাহলে যে করেই হোক সিয়াম পালনের প্রতিবন্ধকতাগুলো সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে রোধ করতে হবে। লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব [email protected]
×